দ্বিতীয় জীবন- ১ম পর্ব
পাথরকুঁচির জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের আগের অংশটুকু -২য় পর্ব
পাথরকুঁচি জীবনের দিন ও রাত্রীগুলো - তৃয় পর্ব
পাথরকুঁচি জীবনের স্বপ্ন ও কান্নারা -৪র্থ পর্ব
পাথর চোখে দেখা পাথরকুঁচি জীবন- ৫ম পর্ব
পাথরকুঁচি ও একটি কুঁড়ি -৬ষ্ঠ পর্ব
পাথরেও ফোটে পাথরকুঁচির ফুল- ৭ম পর্ব
দিন যত গড়াচ্ছে, আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার অসুখটাও যেন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। রুপকথার মুখের দিকে তাকালেই এক অজানা আশংকায় বুক কেঁপে ওঠে আমার। এ অনুভুতি বড় অদ্ভুত, বড় কষ্টময়। অজ্ঞাত কষ্ট ও আশংকার এ এক মিশেল অনুভুতি, যা কাউকে কখনও বুঝানো যাবে না। এই অনুভুতির সাথে আমার আগে কখনও পরিচয় হয়নি। শৈশব, কৈশোর বা আমার তারুন্যের প্রারম্ভবেলায় আমার আনন্দ ও উচ্ছলতার দিনগুলির সাথে সাথে আমার কিছু বেদনা ছিলো, কষ্ট ছিলো। কিন্তু এ যেন সম্পূর্ণ অভূতপূর্ব কোন এক অনুভুতি। যা কষ্ট, শঙ্কা ও বেদনার।
রুপকথা যখন খিলখিল করে হাসে,ইদানিং আমার আর হাসি আসেনা। হাসতে গিয়ে থমকে যাই আমি। ভয়ে জড়িয়ে ধরি ওকে। বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে আমার। মনে হয় এ প্রিয় মুখ, এ প্রিয় হাসির সাথে আর দেখা হবেনা আমার। আর কখনও ওকে জড়িয়ে ধরা হবেনা। অভিমানে ও যখন ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না কান্না মুখ করে, আমার তখন মনে হয় স্বর্গেও বুঝি এমন কোনো দৃশ্য দেখা যায়না। সে মুখটা আর কখনও দেখতে পাবোনা আমি। এসব কথা যখন ভাবি, আমার দুচোখে ঝরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ। ওর সাথে আমার নেই কোনো রক্তের সম্পর্ক, নেই কোনো আত্মীয়তার দাবী, কোন অধিকারে ওকে ধরে রাখবো আমি? কোন দাবীতে আমার বুকের কাছটিতে জড়িয়ে রাখবো আমি ওকে সারাটাজীবন? সারাটাক্ষন মনে মনে কোনো এক পন্থা খুঁজে বেড়াই আমি। আমার ধ্যান জ্ঞান ও সকল অনুভুতিতে এখন রুপকথা।
নরওয়েতে আমাদের এনজিও এর সেই হাসপাতালে আমার চাকুরীর ব্যাপারটা খুব শিঘ্রই পাকাপাকি হয়ে যাবে বলে জানলাম। খুব ভয়ে ভয়ে ম্যাডাম প্যাট্রেসিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, রুপকথার কথা। আমি চলে গেলে কি হবে ওর? ওর বাবা মা বা আত্মীয় পরিজনের তো আজও কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ম্যাডাম বললেন ওর ব্যাবস্থাও করা হবে। খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আমার দুচোখ। আমি আনন্দের আতিশয্যে ম্যাডামকে ধন্যবাদ দিয়ে বসলাম।
উনি বললেন রুপকথার জন্য ভালো এক চাইল্ড হোমের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমি যাবার পর ওকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ওর পড়ালেখা বা জীবনে দাঁড়ানোর মত ব্যাবস্থার কোনো অসুবিধা হবেনা । আমার বাক রোধ হয়ে গেলো। বোবা কান্নায় আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কতখন জানিনা। রুপকথা চাইল্ড হোমে চলে যাবে? রুপকথার জীবনে আর কত দূর্ভোগ পোহাতে হবে তাকে? আর কত পরিবর্তনের পথ পাড়ি দিতে হবে আমার ছোট্ট রুপকথাকে? আমি কিছু বলার চেষ্টা করলাম ম্যাডামকে কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দই বের হচ্ছিলো না।
সেদিন বিকালে রুপকথা সামনের বাগানের সবুজ ঘাসের উপর ছুটাছুটি করছিলো। একটা লালরঙের ফড়িং দেখে ভীষন খুশি হলো সে। ফড়িংটা যত ওর উপর বিরক্ত হয়ে উড়ে উড়ে গিয়ে অন্য কোথাও বসে ও তত খিলখিল করে হাসে আর ফড়িংটাকে দৌড়ে দৌড়ে ধরতে যায়। দু একবার উলটিয়ে পড়েও গেলো ও। আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। রুপকথার এই আনন্দগুলো আমি মিস করবো আমার সারাটা জীবন ধরে। ওকে ধরে রাখার কোনো শক্তিই নেই আমার। রুপকথা শুধু ক্ষনিকের অতিথি। সে এসেছিলো আমার জীবনে খুব অল্প সময়ের জন্য। আমার জীবনের পেছনে ফিরে দেখলে আমি একটা জিনিস ভেবে অবাক হই। সব প্রিয় মানুষগুলোর স্থায়ীত্বকাল খুব কম ছিলো আমার জীবনে। প্রিয় মানুষেরা খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে গেছে আমাকে বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আমার ভাগ্যটাই বুঝি এমন।
একদিন আমার প্রয়োজনে রুপকথাকে আমার কোলে তুলে দেওয়া হয়েছিলো। সে ছিল এক অপূর্ব মায়াবী কৌশল। সে কথা জানতে আমার আর আজ বাকী নেই। আমার সীমাহীন নিসঙ্গতা কাটিয়ে কিছু নিয়ে যেন ব্যাস্ত থাকতে পারি আমি। ক্রমশ নিসঙ্গতার কারণে আমার ভেতরে যে Pareidolia টাইপ নানা মানষিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলো। এই নিষ্পাপ শিশুটির সঙ্গ আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো সে কষ্টের অনেকটাই। আমার পেরিডোলিয়া টাইপ অসুখ বলতে গেলে হারিয়েই গেছে একেবারে। যে হীনমন্যতা, হতাশা বা পেরিডোলিয়া অসুখে ভুগছিলাম আমি তার কোনো সিম্পটম বলতে গেলে কিছুই নেই আর আজ আমার মাঝে।
হয়তো আমাকেও প্রয়োজন ছিলো রুপকথার। ওরও প্রয়োজন ছিলো মমতাময়ী মা বা মায়ের মত কারো কোল। আজ সেও বেশ সামলে নিয়েছে, এ পরিবর্তনকে, এ নতুন জীবনকে।। তার নিজ রক্তের আত্মীয় পরিজনহীন মানব সঙ্গ ওকে সারভাইব করতে শিখিয়েছে। যে কোনো প্রতিকূলতাতেই ঠিকই দাঁড়িয়ে থাকবে রুপকথা। আমি যখন থাকবো না আমাকে ছাড়াও সে ঠিকই পেরে যাবে ওর মত করে ওর দুনিয়ায় বাঁচতে।
কিন্তু কি করে সহ্য করবো আমি? রুপকথাবিহীন হাতছানি দেওয়া উজ্জ্বল ভবিষ্যত আমাকে ভেংচি কাটতে থাকে। আমি ভাবতে পারিনা । রুপকথাটা ছাড়া আমি একটা মুহুর্তও ভাবতে পারিনা আর। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। আমি মানতে পারিনা রুপকথা থাকবেনা আমার সাথে। কি করে বাঁচবো আমি রুপকথাকে ছাড়া? রোজ সকালে উঠে ওর ঘুমন্ত মুখটাতে চুমু দিতে পারবোনা আমি। আমাকেও মা বলে ডাকবেনা আর রুপকথা। তবে কি আমাদের দুজনের কাছে দুজনের প্রয়োজন ফুরালো? নিষ্ঠুর নিয়তি কি সবসময় হাসবে কিছু দূর্ভাগা মানুষের পিছে?
কিছুতেই মানতে পারিনা আমি। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমি এবার নিজেই বুঝতে পারি।
অনেকদিন পর আমি নেটে খুঁজতে বসি আবিরকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:১৩