দ্বিতীয় জীবন- ১ম পর্ব
পাথরকুঁচির জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের আগের অংশটুকু -২য় পর্ব
পাথরকুঁচি জীবনের দিন ও রাত্রীগুলো - তৃয় পর্ব
পাথরকুঁচি জীবনের স্বপ্ন ও কান্নারা -৪র্থ পর্ব
পাথর চোখে দেখা পাথরকুঁচি জীবন- ৫ম পর্ব
পাথরকুঁচি ও একটি কুঁড়ি -৬ষ্ঠ পর্ব
আমার এই প্রায় নির্বাসিত জীবনের এরপরের চার মাসে গুনে গুনে চারটা বড় পরিবর্তন এলো। এক, আমার সন্দেহকে অমূলক করে আমাকে সেই সরু নিসঙ্গ গলিটার পাশের রুমটি থেকে অন্য একটি দোতলার রুমে স্থানান্তর করা হলো। দুই, ঐ আত্মীয় স্বজনের খোঁজ না পাওয়া শিশুটিকে আমার জিম্মায় দেওয়া হলো। আমার রুমে আমার সাথেই এখন থাকছে সে। আর তিন, আমার ইংলিশ টিচার আমাকে কিছু অসাধারণ ইংলিশ বই এবং ইংলিশ ম্যুভির সিডি দিলেন। এছাড়াও কম্পিউটিং এর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য একটি ল্যাপটপ দেওয়া হলো আমাকে। এই ল্যাপটপ দেবার ব্যাপারটাকেই আমি চার নম্বর ও বিশাল এক অভাবনীয় পরিবর্তন বলেই ধরে নিচ্ছি।
আসলে এই চার পরিবর্তনের মাঝে কোনটার চাইতেই যে কোনটার অবদান আমার লাইফে কম, সেটাই বুঝতে পারছিনা। যেমন যদি এক নম্বর পরিবর্তনটার কথাটাই বলি মানে আমার একতলার ঐ কোনার ঘরটা বদলে এই দোতলার আলো ঝলমলে রৌদ্রজ্বল বড় রাস্তার পাশের রুমটা দেবার ব্যাপারটা তাহলে সেটাও কি কম হবে? এই রুম থেকে দেখা যায় বিশাল কালো কুচকুচে পিঁচ ঢালা রাজপথ। অসংখ্য যানবাহন ও পথচারীদের চলাচল। সারাটাদিন যেন চলমান জীবন এই রাস্তাতেই গতীময় হয়ে থাকে। কত রকম গাড়ি। কত রকম মানুষ। হকার, ভিক্ষুক! যদিও বড় রাস্তাটা আগের ঐ সরু একাকী গলিটার মত একদম জানালার পাশেই খুব কাছাকাছি নয়। এটা বাগান পেরিয়ে একটু দূরে তবুও সেই চলমান রাস্তার গতী আমাকে বিমোহিত করে। আমি মুগ্ধ হই এই গতীময় জীবনের চলমান ধারায়। তবুও প্রায়ই বিষন্নতায় মন ভরে ওঠে আমার। বাইরের দুনিয়ার ঔজ্জ্বলতা, গতীময়তা আমাকে উপলদ্ধ করায়, আমি আটকে আছি গতীহীন নিরানন্দ এক বদ্ধ জীবনে। যেখানে পৃথিবীর সব আনন্দ থমকে গেছে কিছু দেওয়ালের গন্ডিরেখায়।
আমার কাউন্সেলর বলেছে Pareidolia নামক এক মানষিক রোগে ভুগছি আমি। তাই ঐ নিসঙ্গ রাস্তা এবং আমার পুরোনো রুমটার আসবাব পত্র দরজা জানালাতে মানুষের মত চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম। এটা এক ধরনের মানষিক বা মস্তিস্কের ভ্রান্তি। আসলে আমি কিচ্ছু দেখিনি, আমার ব্রেইন নিজেই তৈরী করেছে ঐ চোখের ছবিগুলি। উনি আমাকে এ কদিন যাবৎ অষ্টপ্রহর এইসব কথায় কান ঝালাপালা করে তুলেছেন। তার এসব কথা শুনে আমার এখন কাউন্সেলরকেই মানষিক রোগী মনে হয়। আমি তার উপর বিরক্ত হতে শুরু করেছি। মনে মনে ক্ষেপেও থাকি তার উপরে।
তার দেওয়া ঔষধগুলো খেতে চাইনা আমি। আসলে আমি মুক্তি চাইনা। আমার ব্রেইনের উপর আমার পূর্ণ অধিকার থাকবে। পুরোপুরি ১০০% নিয়ন্ত্রন থাকবে আমার নিজের। সে কে যে ঔষধ দিয়ে তা বদলে দিতে চায়! এ ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ হয়না। মনে মনে ক্ষুব্ধ হতে থাকি আমি। প্ল্যান করি ঔষধগুলো জানালা দিয়ে ফেলে দেবো অথবা কমোডে ফ্লাশ করে দেবো। কিন্তু আরেক উৎপাত শুরু হয়েছে এই রুমে আসার পর থেকে। আমার মেডিকেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে একজন মোটা মত নার্সকে । তার চেহারাটা সে সারাটাক্ষন এমনই গম্ভীর করে রাখে যে মনে হয় ঔষধ না খেলে আমাকেই খেয়ে ফেলবেন তিনি। রোজ নিয়ম করে তিন বেলা ঔষধগুলো আনেন আর না খাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়েই থাকেন পাশে।
দুই নম্বর পরিবর্তনটাই সবচেয়ে মজার। সেটা ঐ আহত শিশুটিকে আমার জিম্মায় দেওয়া। এ চারমাসে সে বেশ সেরে উঠেছে। হাতে ও গলায় কিছু আঁকিবুকি রেখা ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা দেখা যায়না আর। ডক্টর বলেছেন এটুকুও মিলিয়ে দেবেন তিনি। দরকারে প্লাস্টিক সার্জারী করা হবে তার। শিশুটিকে রাস্তা থেকে এক দল লোক একদিন সকালে এ হসপিটালে রেখে গিয়েছিলো। তারা কেউই তার আপনজন নয়। তার সংবাদ ও ছবি দিয়ে নানা নিউজপেপারে নিখোঁজ সংবাদ ছাপানো হয়েছে। টিভি শো হয়েছে বেশ কয়েকটা। তবুও শিশুটির কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।
আপাতত আমরা দুজন মানে একজন আপনজন থেকেও না থাকা গৃহহীন মানুষ, অপরজন কোথাও আপনজনদের সন্ধান না পাওয়া গৃহহারা মানুষ, আমরা একই ঘরে বাস করছি। দুজন অসম বয়সী বন্ধু আমরা। এবং আমার বন্ধুটি এতই ছোট যে মনের ভাবও ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারেনা। আধো আধো বলে কেবলই কথা বলা শিখছে সে। মাঝে মাঝে সে মা মা করে ডাকে। এদিক ওদিক খোঁজে কাউকে। মাঝে মাঝে তারা বুজি, তারা বুজি বলে কাউকে ডাকে একা একা। আমার কষ্টে বুক ফেটে যায়। ও কাকে খোঁজে বলতে পারেনা। ওর ঠিকানা বলারও ক্ষমতা নেই। একদিন দুপুরে ঘুম ভেঙ্গে উঠে ও মোতালেব মামা মোতালেব মামা বলে কাকে যেন খুঁজছিলো। আমি বললাম কি হয়েছে সোনা? সে আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে উঠলো, আধো আধো বোলে বললো, মোতালেব মামা আততিলো।
আমার দুচোখ দিয়ে পানি পড়ে। কি যে কষ্ট লাগে! কোথায় পাবো আমি তার মা, তারাবুজি বা মোতালেব মামাকে? আমি যদি পারতাম ওকে ভুলিয়ে দিতাম ওর সকল পুরোনো স্মৃতিকে। নিজের এত বড় ক্ষতির পরেও আমি কখনও নিজের নিয়তি ছাড়া বিধাতাকে দোষ দেইনি। কিন্তু আজ আমার বিধাতার উপর ক্রোধ জন্মাতে থাকে। এই শিশুটির কষ্ট ভুলিয়ে দিতে তার কি উচিৎ ছিলো না তার সকল স্মৃতি মুছিয়ে দেবার?
আমাদের দুজনের জন্য দুটি আলাদা বেড রয়েছে রুমে। ওর দেখাশোনার জন্য আলাদা সেবিকাও আছে কিন্তু আমি ওকে আমার সাথে নিয়েই ঘুমোই। ওর সব কাজ আমি নিজেই করে দেই। ওকে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো সব। এতটুকু বাচ্চা কি একা একা ঘুমোতে পারে? ও আমাকে জড়িয়ে ধরে যখন ঘুমিয়ে থাকে আমার মনে হয় এই পৃথিবীর অন্তত একটা মানুষের কাছেও হয়তো এখনও আমার এতটুকুও মূল্য আছে।
আমি ওকে গল্প শুনাই, ছড়া শেখাই। বারান্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে ওকে আমি চাঁদ দেখাই। গান শুনাই আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা। সে এই ছড়া শুনে সে আবারও মামা মামা করে খুঁজতে থাকে চারপাশে। আমার দুচোখ ফেটে কান্না আসে। আমি আর ওকে চাঁদমামার গান শুনাই না। ওকে বুকে চেপে ধরে আমি ওর সব টুকু কষ্ট নিয়ে নিতে চাই আমার বুকের মধ্যে। ও চুপ করে কি যেন ভাবে। আমার দুচোখের পানি গড়িয়ে পড়লে আমার মুখের দিকে মাথা তুলে ওর ছোট্ট দুহাতে আমার চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। ওর ছোট্ট ছোট্ট হাতের চেটো কি যে মোহনীয় সুন্দর। নরম তুলতুলে বিড়ালের মত আঙ্গুলগুলোতে চুমু খাই আমি।
আমি ওর জন্য লাইব্রেরী থেকে রুপকথার গল্প, ফেইরী টেল নিয়ে আসি। রোজ দুপুরে ওকে আমি গল্প শুনাই। ও র্যাপুনজেলের গল্পের বন্দিনী রাজকন্যার ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আমি অবাক হই ওর এত টুকু বয়সে ও কি করে বুঝলো ওর আর আমার মত র্যাপুনজেলও বন্দিনী ঐ গল্পের বই এর উঁচু টাওয়ারের ছবিটার মাঝে? আমার সাথে ওর দিন বেশ কাঁটে নানা রকম আনন্দে , গল্পে আর খেলায় । আমার মনের অনেক কথাই আমি ওকে বলি। ও কিছুই বোঝেনা শুধু হাসে। এখন আর সবকিছু খালি খালি লাগেনা আমার। সব সময় মনে হয় আমার একটা কাজ পড়ে আছে। কোথাও আমাকে প্রয়োজন। কারু একজনের জীবনে আমি সবচাইতে মূল্যবান যার আমি ছাড়া এই দুনিয়ায় আপনজন কেউ নেই।
ও আর এখন ঘুমের মধ্যে মা মা করে কেঁদে ওঠে না। তারা বুজি বলে কাউকে খোঁজে না। ও আমার গলা জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে। যে কোনো প্রয়োজনে বা দুঃখ পেলে বা রাগ হলে সে ঠোঁট ফুলিয়ে আমাকে খোঁজে । ও আমাকে আজকাল মা বলে ডাকছে। এটা নিয়ে আমার যদিও একটু লজ্জা লাগে তবুও আমার প্রানটা ভরে যায়। ও আমাকে যতবার মা বলে ডাকে ততবার আমি ছুটে এসে ওকে চুমু খাই। আমার মনে হয় আমার জীবনে আমি ওর মত করে আর কাউকেই ভালোবাসিনি। রুপকথাকে নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছে আমার জীবন। আমি ওর নাম দিয়েছি রুপকথা। ও তো আমার রুপকথাই । আমার রুপকথার রাজকন্যা।
আমার বিদেশে চাকুরীতে যোগ দেবার ব্যাপারটার বেশ অগ্রগতী হয়েছে। ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রেনিং মাদাম তেরেসা টিচার আমাকে দারুন ভালোবাসেন। আমি এখন অনায়াসে ইংলিশ নিউজ পেপার বা যে কোনো ইংলিশ বই এর প্যারার পর প্যারা গড় গড় করে পড়ে যেতে পারি। উনি অবাক হন। এত তাড়াতাড়ি এত ইমপ্রুভমেন্ট আশা করেননি তিনি। কিন্তু আমার তো আসলে এসব ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই কাজেই মন দিয়ে ইংলিশ পড়াটা তেমন দুসাধ্য ছিলোনা। কম্পিউটারে চিঠি টাইপ করা বা ওয়ার্ড, এক্সেল টাইপ ছোটখাটো কাজগুলোও বেশ শিখে ফেলেছি আমি। আর ইন্টারনেট ব্রাউজিং এর মজার দুনিয়া আমাকে এক অন্যরকম আলোর পথ দেখায়। কত কিছু যে জানার ছিলো আমার তাই ভাবি বসে বসে।
শুধু মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে কাঁটার মত একটা সংশয় ফোটে। আমি চলে গেলে কি হবে আমার রুপকথার? আমাকে না পেলে ও তো বাঁচবেই না। বুক কেঁপে ওঠে আমার। তবে কি ওকে ছেড়েই চলে যেতে হবে আমাকে?
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:৩২