দ্বিতীয় জীবন-১ম পর্ব
পাথরকুঁচির জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের আগের অংশটুকু- ২য় পর্ব
পাথরকুঁচি জীবনের দিন ও রাত্রীগুলো-তৃয় পর্ব
পাথরকুঁচি জীবনের স্বপ্ন ও কান্নারা-৪র্থ পর্ব
এই সেন্টারটিতে একটা ছোট্ট লাইব্রেরী আছে। ছোট্ট বলছি এইজন্য যে তাতে বই এর সংখ্যা খুব কম। এক আলমারীতে শুধুই শিশুতোষ বই পুস্তক। আর দুটি ছোট আলমারীতে নানারকম বই। এখানে আমি কখনও কোনো শিশু দেখিনি। তবুও শিশুতোষ বই কেনো এখানকার আলমারীতে রাখা আছে ঠিক বুঝিনা আমি। কাউকে এ ব্যাপারে কিছু জিগাসাও করিনি কখনও। বসে বসে সেসব ছোটদের গল্পগুলোও পড়ে ফেলি আমি। রুপকথার গল্প, দৈত্যি দানো। ছোটবেলায় কি সাংঘাতিক প্রিয় ছিলো আমার রুপকথা। রুপকথার বন্দিনী রাজকন্যার দুঃখে কত যে কষ্ট পেতাম। ফুঁপিয়ে কাঁদতাম।
নিজেকে বন্দিনী রাজকন্যা ভাবতে ইচ্ছে করে । কোনোদিন কোনো রাজপুত্র আসবে, আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে এ মৃত্যুপুরী থেকে। পরমুহুর্তেই শিউরে উঠি আমি। রাজকন্যারা তো অনেক সুন্দর হয়। এত বেশী সুন্দর যে তাদেরকে দেখলে চোখের পলক পড়েনা। কিন্তু আমি? না না কোনো রাজপুত্র কখনও না আসুক আমার এই পাষানপুরীতে।
এই বাড়িটাকে আমার পাষানপুরীর মতনই মনে হয়। কোন এক অদ্ভুত কারণে এইখানে কেউ কারো সাথে কথা বলেনা, গল্প করেনা। সবাই যেন মন মরা বিষন্ন হয়ে থাকতেই এইখানে এসেছে। অবশ্য মাঝে মাঝে তাদের আত্মীয় স্বজনেরা আসে। ভিজিটরস রুমে তারা খুব আস্তে কথা বলে। কখনও কখনও কান্নার রোল ওঠে।সময় পেরুলে ঘন্টা বাজে যখন তখন সবাই একে একে বিদায় নেয়। আবার পাষান পুরীতে নেমে আসে নিস্তব্ধতা।
এ সেন্টারটিতে শুধুই মেয়েরা রয়েছে। সব মেয়েরাই বয়সে তরুনী। শুধু একজন পৌঢ়া মহিলা আছেন তিনি চুপচাপ বাগানের ধারের সিড়িটার উপর বসে থাকেন। কখনও কারো সাথে কথা বলেন না। অন্যান্য যারা আছে আমি কখনও তাদেরকেও খুব একটা কথা বলতে দেখিনা। আমি কখনও তাদেরকে বলতে শুনিনি, জানতে চাইতে দেখিনি কে কেনো এই অবস্থার শিকার হলো। কি হয়েছিলো তাদের ঠিক। মেয়েরা একখানে হলে কথা বন্ধ রাখতে পারেনা। কিন্তু এখানে কেনো যেন সবাই বোবা হয়ে গেছে।
আমিও বোবা হয়ে গিয়েছি। আমি লিখি। সকালে, দুপুরে বিকেলে রাতে যখন যা মনে আসে লিখে রাখি। আনা ফ্রাঙ্কের মত হয়তো কখনও আমার এ ডায়েরী পড়ে আমার মা বা আমার বোন কাঁদবে। আমি চাইনা তাদেরকে আর কষ্ট দিতে, তারা আমার জন্য কাঁদুক তা আমি একদমই চাইনা। তাই আমি তাদের সাথে দেখা করিনা। আমার কাউন্সেলর বলেন আমি মানষিক রোগে ভুগছি। কি যেন একটা মেডিকেল টার্মও বলেন তিনি। আমি সেটা শুনতেও চাইনা।
ভিজিটরস রুমের পেছনের দিককার যে ছোট্ট বারান্দাটা আছে সেই বারান্দার বন্ধ দরজার খড়খড়িটায় একটু ফাকা করে রেখেছি আমি। ভিজিটরস টাইমে আমি সেখানে চোখ পেতে দাঁড়িয়ে থাকি চুপি চুপি। সবার আত্মীয় স্বজনদেরকে দেখি। তাদের কথা শুনি। আড়িপাতা খুব খারাপ স্বভাব আমি জানি সেটা। তবুও আমি আজকাল সেটাই করি। জেনে শুনেই করি। কারণ আমি দেখি মানুষের কত রকম দুঃখ, কষ্ট, কত রকম তার কারণ, কার কেমন আত্মীয় স্বজন, কেমনভাবে রিএ্যাক্ট করছে তারা অথবা হয়তো কি দেখতে চাই আমি তা নিজেই জানিনা।
হয়তোবা দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক ঘেয়ে জীবনটাতে আনন্দের উপকরন আমার এসব নানারকম দুঃখগুলোই দেখে চলা। তবে একটা জায়গায় এসে এই সেন্টারের সকলের দুঃখ একটাই। আমরা সবাই এখানে দ্বিতীয় জীবন কাটাচ্ছি। গ্লানিময় দ্বিতীয় জীবন। প্রথম জীবনটা আমরা ফেলে রেখে এসেছি এক সোনালী অতীতে। সে অতীতটা থেকে কোনো কোনো মানুষ কখনও কখনও এখানে উঠে আসে আমাদেরকে দেখতে। আমি আর প্রথম জীবনের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা।
আমি মাঝে মাঝে চোখ বুজে একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখি। ভয়ংকর বলছি এ কারণে যে, সে দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলেই,ভয়ে সারা শরীরে কাঁটা দেয় আমার। আমি দেখি একদিন এমনই এক ভিজিটরস আওয়ারে আবির আমার মুখোমুখি বসে আছে। আমার হাত দুটো ধরে রেখেছে সে। আমার খুব লজ্জা করছে। লজ্জার কারণ আমার এই কুৎসিত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আবির। আবির কি আমাকে ঘেন্না পাচ্ছে? ভয়ে কেঁপে উঠি আমি। আমার এ কলঙ্কিত মুখ আমি দেখাতে চাইনা আবিরকে। আমি মুখ নীচু করে বসে থাকি।
আবির কি কোনোদিন আমার খোঁজে এই হাসপাতালে চলে আসবে? ভীষন খারাপ লাগতে শুরু করে আবার। হার্টবিট বেড়ে যায়। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। না এটা কিছুতেই সম্ভব না। খুব খারাপ হবে সেটা। আমি মনে মনে সব সময় একটু বিষ খুঁজি। কোথায় যদি পাওয়া যেত। লুকিয়ে রাখতাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস কখনও সেটা প্রয়োজন হবে আমার। আমাকে একটু বিষের ব্যাবস্থা করতেই হবে। যে করেই হোক। আমি মনে মনে বিষ খুঁজে বেড়াই।
আমি সারাটা হাসপাতাল হেঁটে বেড়াই একা একা। এ বিশাল ভবনটির কয়টা জানালা, কয়টা দরজা কোথায় কি আছে সে আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারবো। দোতলা রুমগুলো ফাকা পড়ে থাকে নিরর্থক। অনেক পুরোনো আমলের এ সুবিশাল ভবনটিতে এত উঁচু ছাদ। ছাদে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু ম্যাডাম প্যাট্রেসিয়া ছাঁদের দরজায় তালা দিয়ে রাখার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন কেন যেন। হয়তো উনি আমাদেরকে বিশ্বাস করেন না।
আমি মাঝে মাঝে দুপুরবেলা সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাই ছাদের দিকে। ছাদের দরজার দুই পাল্লার কড়াতে লাগানো রয়েছে বিশাল তালাটা। দুই পাল্লা ফাকা করে যতখানি চোখ যায় তাকিয়ে থাকি আমি। কখনও দুইটা বা তিনটা শালিক। কখনও বা চুড়ুয়েরা কিচির মিচির করে ঘুরে বেড়ায় ছাদে। পাখিদের জীবনটা কি মজার। যেথায় খুশী উড়ে চলে যায়। একদিন একটা চুড়ুই নির্ভয়ে চলে আসলো আমার দরজার পাল্লার কাছে। একটুও ভয় না পেলে ঘাড় কাৎ করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি দরজার ফাকা দিয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। খুব দুঃখ হলো। আমার হাতে কোনো খাবার ছিলোনা?
আমার মনে পড়লো আমার ছোটবেলায় পোষা কবুতরের কথা। ছোট পিচ্চি বাচ্চাদুটোকে বাজার থেকে এনেছিলেন বাবা। তাদেরকে গম খাওয়াতাম আমি। হাত থেকে খাবার খুটে খেত তারা। আমার অনেকগুলো পোষা মুরগীও ছিলো। যদিও সেসব মায়ের শখ ছিলো কিন্তু রোজ সকালে আর সন্ধ্যায় ওদের ছোট্ট ঘরটার হুড়কো খুলে দেওয়া বা বন্ধের কাজটা আমিই করতাম। গুনে গুনে সন্ধ্যায় ঘরে তুলতে হত ওদেরকে। কত কথা মনে পড়ে আমার।
আমি ছাদের সিড়িঘরে সিড়ির উপর একা একা বসে থাকি। একরকম অদ্ভুত শীতলতা এই বন্ধ সিড়িঘরে। একধরনের বদ্ধ সোদা গন্ধও আছে এ সিড়িঘরটিতে। আমার নানাবাড়ির ছাদের সিড়িঘরটাও তালা দেওয়া থাকতো। সেখানেও ঠিক এমনি গন্ধ ছিলো। ধান সিদ্ধ করা ডোল রাখা থাকতো সেখানে। তার এক অন্যরকম গন্ধ। তপ্ত গনগনে ছাদের উপর যখন বৃ্ষ্টি পড়ে তখনও এক পোড়া পোড়া গন্ধ ওঠে। সে গন্ধটুকুও আমি চোখ বুজে মনে করতে চেষ্টা করি। আমি অতীতের মাঝে নিজেকে খুঁজতে থাকি। দ্বিতীয় জীবনে আমার কোনো আনন্দ নেই। সোনালী অতীতের সেই প্রথম জীবনের সুখস্মৃতিগুলিই আমার একমাত্র আনন্দের উপকরণ।
একদিন একটা আশ্চর্য্য ঘটনা ঘটলো। আমার নামে একটা পারসেল এলো। পারসেলের গায়ে বিদেশী টিকেট। বিদেশী ঠিকানা।আমার এত্ত ভয় লাগছিলো। আমি নিশ্চিৎ ভাবছিলাম এটা আবিরই হবে।আবির ছাড়া কে পাঠাবে আমাকে বিদেশ থেকে এমন একটা পারসেল?
ম্যাডাম প্যাট্রেসিয়া আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিনিই প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে মিটি মিটি হাসছিলেন। আমার এত রাগ লাগছিলো। প্যাকেটটা খুলতেই বেরিয়ে এলো একটি বিশাল সুদৃশ্য কার্ড। কার্ডটা খুললেই একটা অদ্ভুত সুন্দর টুং টাং মিউজিক বেজে উঠলো আর তাতে শুভেচ্ছাবাণী লেখা। কিন্তু আরও অদ্ভুত ব্যাপার যেটা সেটা হলো সাথে একটি চাকুরীর অফার লেটার। আমি তো কোথাও চাকুরীর জন্য আবেদন করিনি তাহলে কি এটা? পাঠালোই বা কে?
চিঠিটা পাঠানো হয়েছে এই হাসপাতালটি যে এনজিও এর অধীনে চলে তার সদর দপ্তর থেকে। তারা আমাকে তাদের এনজিওতে একটি চাকুরীর অফার দিয়েছে। এখুনি নয় সেখানে যেতে হলে আমাকে ৬ মাসের কম্পিউটার কোর্স আর ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স করতে হবে। সব ব্যাবস্থাই করবেন এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আমি একই সাথে খুশি হলাম আবার বিমর্ষও হলাম। বিমর্ষ হবার অনেক কারণ আছে আমার কিন্তু খুশির কারণটা বলি।
আমার এ চেনা পৃথিবী থেকে অন্তত আমি পালিয়ে যেতে পারবো। অজানা কোনো দূর দেশে। আমার প্রিয়জনেরা আমাকে ভেবে আর কষ্ট পাবেনা। তারা জানবে আমি ভালো আছি। সুখে আছি। চোখের সামনে এই জলন্ত অভিশাপ দেখে অহর্নিশ যে কষ্টে তারা ভুগতো। আমাকে না দেখে দেখে সে কষ্টের তীব্রতা কেটে যাবে একদিন। আবিরও আমাকে ভুলে যাবে। আবিরের সংসার হবে। সন্তান হবে।আমি ওদের কাছে হয়ে যাবো কোনো এক মৃত মানুষ।
সন্তান! সন্তানের কথা মনে হতেই মনে পড়লো একটা ঘটনা। আপুর যেবার মেয়ে হলো। আপুর শ্বাশুড়ি মানে আবিরের মা আক্ষেপ করছিলেন, প্রথম নাতনী মানে বড় ছেলের প্রথম সন্তান ছেলে হলেই তিনি খুশি হতেন বেশি, আবির দুষ্টুমী করে বলেছিলো, বড় ছেলের মেয়ে হইসে তো কি হইসে আপনার ছোট ছেলে আছেনা? তাড়াতাড়ি বিয়ে দেন ছোটছেলের নিশ্চয় ছেলে সন্তান হবে। কথাটা বলে আবির হাসছিলো, চোখ টিপ দিয়েছিলো আমার দিকে। আমার তখন লজ্জায় ধরণী দ্বিধা হও অবস্থা।
আচ্ছা আবিরের সন্তান কি ছেলে হবে নাকি মেয়ে? সেদিন কি তার মনে পড়বে সেই কথাটা। যে সন্তানের মা হবার কথা ছিলো আমার আর সেটা নিয়েই দুষ্টুমী করেছিলো আবির একদিন। ছেলে হলে তার নাম কি হবে? অথবা মেয়েটা? তারা কি আবিরের মত দেখতে হবে। ছেলেটা কি হবে ওর মত? ঝাঁকড়া বাবড়ী চুলের গোলগোল বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ। আবিরকে আমার খুব মনে পড়তে থাকে। আমার খুব কষ্ট হয়।
আমার চোখ দিয়ে অবিরল পানি ঝরছে। আমি চোখ মোছার চেষ্টা করিনা। মনের অর্গল খুলে কাঁদি। বুকের ভেতরে পাষান হয়ে জমে থাকা সব কষ্টগুলো গলে যাক। জল হয়ে বের হয়ে যাক চিরজীবনের জন্য আমাকে ছেড়ে। সবাইকেই ছাড়তে হলো শুধু এই চোখের জলটাই আমাকে ছাড়লোনা।
আমি যখন কাঁদি-
আমার পাথর চোখের কোনা দিয়েও জল গড়িয়ে পড়ে। অক্ষিবিহীন পাথর চোখে জল গড়াতে পারে এ আমার জানা ছিলো না।
তবে কি আমার জীবন্ত চোখটির দুঃখে আমার পাথর চোখও কাঁদে?
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:০৪