দ্বিতীয় জীবন
পাথরকুঁচির জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের আগের অংশটুকু
পাথরকুঁচি জীবনের দিন ও রাত্রীগুলো
কাল রাতে ওকে স্বপ্নে দেখলাম। ওকে মানে আবিরকে। দেখলাম আবিরদের গ্রামের সেই বিশাল খেলার মাঠটা। ঝকঝকে দিন। ঘুড়ি উড়াচ্ছে আবির। আমাকে হাত ইশারায় ডাকলো ও। কিন্তু আমি তো ঘুড়ি উড়াতে পারিনা। সে বললো শিখিয়ে দেবে। খুব হাসছিলো ও। আপুর বিয়ের পর যেবার আপুর সাথে তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে গেলাম, একদিন ঠিক একইভাবেই আমাকে ওর সাথে ঘুড়ি উড়াতে ডেকেছিলো আবির।
আপুর দেবর হবার সুবাদে আমার সাথে দুষ্টামীর অন্ত ছিলো না তার।বড়শীতে টোপ বেঁধে মাছ ধরা, কিংবা পুকুরে জাল ফেলা, খেঁজুর গাছ, ডাব গাছে তরতর করে বেয়ে ওঠা আবিরকে আমি যত দেখছিলাম ততই মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আসলে সদ্য কৈশোর পেরুনো আমার সে বয়সে আবিরের দুঃসাহসিক সব কাজকর্ম আমাকে আছন্ন করে ফেলছিলো।
আবির খুব ভালো ছাত্র ছিলো, আমার মত যা তা স্টুডেন্ট না। শুনেছিলাম এসএসসিতে সেবার ঢাকা বোর্ডে ৬ষ্ঠ হয়েছিলো নাকি সে। সেই নিয়ে তার গর্বও ছিলো বেশ ভালোই। তার এত ভালো ফলাফলের কথা শুনে যখন আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে সে বললো, এবারের এইচএসসিতেও নাকি সে ১ম হবে। যদিও কথাটা মজা করে বলেছিলো কিন্তু আমি তার চেহারায় ফুটে ওঠা আত্মবিশ্বাস দেখে আরও বেশি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আসলে আমি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছিলাম। আর প্রেমে পড়বার বয়সই তো ছিলো সেটা।
তাছাড়া আবিরের প্রতিটি কাজকর্ম কথাবার্তায় যে টগবগে তারুন্যভাব ফুটে উঠেছিলো মনে হয়েছিলো পুরো পৃথিবীটাকেই হাতের মুঠোয় পুরে রাখবার ক্ষমতা বুঝি আছে তার। ফেরবার সময় যখন ওদের বাড়ি থেকে আমাদেরকে ট্রেনে তুলে দিতে ওদের আরও কয়েকজন আত্মীয় স্বজনের সাথে আবিরও এলো। আমি আর বাবা তখন ট্রেনে উঠে গেছি। জানালার ধারে আবির আমার হাতে গুঁজে দিলো ছোট্ট এক টুকরো চিরকুট। সেই ছিলো আবিরের প্রথম প্রেম পত্র। অবশ্য সেটা প্রেম পত্র বলা যায় কিনা আমি জানিনা। শুধু একটি লাইনই ছিলো সেখানে। আমিও কিছু না বুঝেই সেটা সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে ফেললাম।
পুরোটা পথ চিরকুটটা খুলিনি আমি। বাড়ি ফিরে বাথরুমে গিয়ে খুলেছিলাম সেই চিঠি। নিজের বুকের মধ্যেই শুনতে পাচ্ছিলাম কামারের হাপর। আমার সেদিন হার্ট এ্যাটাক হবে মনে হচ্ছিলো । ভীষন বুক ব্যাথা করছিলো হঠাৎ, নিশ্বাস আটকে আসছিলো আমার। ঐ একটি লাইন বার বার পড়ে পড়ে আমি রক্তিম হয়ে উঠছিলাম। তারপর সারাটা রাত নির্ঘুম কেটে গেলো। এরপর দিন যায়, রাত কাটে আমার শুধু আবিরকেই মনে পড়ে।মা বললেন তুই আজকাল এত মন খারাপ করে থাকিস কেনো? একটু চমকেছিলাম। মায়ের চোখ ফাঁকি দেওয়া আসলেই কঠিন।
আবিরকে আমি যতবার স্বপ্নে দেখি, সেই বিশাল সবুজ মাঠ আর সেই ঘুড়ির নাটাই হাতে হাস্যজ্বল আবিরকেই দেখি। কোথায় যেন পড়েছিলাম, স্বপ্নে নাকি মানুষ রঙ দেখতে পায়না। কিন্তু আমি আবিরকে নিয়ে দেখা প্রতিটি স্বপ্নেই ঝকঝকে সবুজ ভর দুপুরের রৌদ্রজ্ব্যল এই মাঠটাই দেখি। স্বপ্নে আবির সব সময় হাসিমুখে থাকে। অথচ আবির হয়ত এখন আর হাসেই না। আমার এ ঘটনা শোনার পরে নিশ্চয় অনেক কষ্ট পেয়েছে সে। আচ্ছা আবির আমাকে ভুল বোঝেনিতো? হয়তো ভাবতে পারে অনেকেই যেমন ভাবে অকারনে কি কোনো মেয়ে এমন এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়? নিশ্চয় মেয়েটারও কোনো না কোনো দোষ ছিলো। এতটুকু নয় অনেক টুকুই।
জানিনা...
অসাধারণ রেজাল্ট করে অস্ট্রেলিয়া যাবার আগে আবির লুকিয়ে আমাকে ওর হাতের একটা আংটি দিয়ে গিয়েছিলো। সোনার আংটি। আংটিটা ওর নিজের। এস এস সিতে ভালো রেজাল্ট করবার কারণে ওর নানু নাকি ওকে বানিয়ে দিয়েছিলেন। ও যেদিন বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাবার হেতু এক বাক্স মিষ্টি নিয়ে আমাদের বাসায় দেখা করতে এলো। সেদিন দুপুরে সবার অগোচরে আমাকে সে এই আংটিটা দিলো। সেদিনটা ভাবতে আমার খুব লজ্জা লাগে। কারণ সেদিনই ছিলো আমার জীবনের প্রথম চুম্বন। হয়তো বা শেষও।
এই একটি দিন আমার অতীত, আমার প্রথম জীবনের একদম অন্যরকম ভালোলাগার অনুভুতির স্মৃতি বহনকারী অন্যরকম একটি দিন।
মাঝে মাঝে অনেক রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে আমি আমার ছোট্ট টিনের বাক্সটা খুলে বসি। এই বাক্সটা আমি ম্যাডাম প্যাট্রেসিয়াকে অনুরোধ করে বাড়ি থেকে আনিয়ে নিয়েছি। এখানে আমার ছোটবেলার জলরঙের বাক্স থেকে শুরু করে আমার কচিচাচার জার্মান থেকে এনে দেওয়া চোখ পিটপিটে পুতুলের মাথা পর্যন্ত আছে। এটাই ছিলো আমার সতেরো বছরের জীবনের একমাত্র ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। আমি এ বাক্সটা তালা দিয়ে রাখতাম, কাউকে ধরতে দিতাম না।
বাক্সটার একটা মজার ইতিহাস আছে। এটা আমার দাদীর তোরঙ্গ। উনার থেকেই চেয়ে নিয়েছিলাম সেটা আমি ছোটবেলায়। টিনের ছোট্ট একটা নীল রঙের তরঙ্গের ডালায় বেগুনী পদ্মফুল, আমার দারুন ভালো লেগেছিলো। এই বাক্সের সবচেয়ে নীচে আমি লুকিয়ে রেখেছি আবিরের দেওয়া সে আংটিটা। এখানে আবীরের লেখা ১৯৯টা চিঠিও আছে। শেষ চিঠিটা খুব ছোট। সেটাও এক লাইনের। আবির লিখেছিলো "আমার জন্য অপেক্ষা করো"। অথচ আবির জানেনা, এ অপেক্ষার শেষ নেই আছে শুধু শুরু আর নিরন্তন বয়ে যাওয়া- দীর্ঘশ্বাস।
সারাটা দিন যাও বা কাটে, যখন রাত্রী নামে চারিদিক শুনশান তখন যেন রাতের আঁধার গ্রাস করে আমাকে। আঁধারের মনে হয় এক ধরনের শূন্যতা আছে। তখন আমার আবিরের জন্য খুব কষ্ট হয়। আমি ওর দেওয়া আংটিটা চুপি চুপি বের করে বসে থাকি হাতে নিয়ে। মনে হয় আবির আমার হাত ধরে আছে। আমার চোখ থেকে পানি ঝরে। কত কত চোখের পানি যে শুকিয়ে আছে এই আংটির গায়ে! আমি একদিন এই আংটিটা আবিরকে ফিরিয়ে দেবো। সে যদি আমার মৃত্যুর পরেও হয়ে থাকে তবুও আমি বলে যাবো এই আংটিটা যেন কোনো না কোনো একদিন আবিরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
আংটিটা পেয়ে হয়তো আবির খুব অবাক হবে। কিন্তু ও কোনোদিন জানবেনা কত রাত্রীর কান্নার জল শুকিয়ে আছে ঐ আংটিটার গায়ে.....
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৩১