দ্বিতীয় জীবন
পাথরকুঁচির জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের আগের অংশটুকু
আজকাল আমার একা থাকতেই ভালো লাগে। কারো সামনে যেতে ইচ্ছে করেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় এর চাইতে মৃত্যুই ভালো ছিলো। এই বিভৎস্য জীবন আমি চাইনা। মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার। কয়েকবার আত্মহত্যার প্ল্যানও করেছিলাম। প্রতিবারই বিফল হয়েছি। আসলে প্রথমবার ফ্যানের সাথে ওড়না ঝুলিয়ে মৃত্যুচেষ্টাটা বোকার মত হয়ে গেলো। কাউন্সেলরের নির্দেশে ম্যাডাম প্যাট্রেসিয়া আমার হাতের নাগালের সব দড়ি রজ্জু গায়েব করে দিয়েছেন। আমি বসে বসে নীলনক্সা কষি। আমার মৃত্যুর নীলনক্সা। আসলে মৃত্যু বলছি কেনো? সেই আমার মুক্তি। এ দুঃসহ দূর্বিসহ জীবন থেকে সেই কি মুক্তি নয়?
আমি মুক্তি চাই। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি এ জীবন চাইনা। কি দোষ করেছিলাম আমি যে আমাকে এমন দূর্বিসহ জীবন পোহাতে হবে? খুব ইচ্ছে হয় বিধাতাকে ডেকে জিগাসা করি আমার ভাগ্যে এমন কেনো লেখা হলো? কিন্তু কোথায় বিধাতা? কেমন করে ডাকলে শুনবেন তিনি?
এ হাসপাতালে রুকমনির মা বলে একজন পৌঢ়া মহিলা আসে। ঘর দুয়ার ঝাড়া মোছার জন্য। সে আমাকে দুঃখ পেতে নিষেধ করে। সে বলে এ জীবনে যার যত বেশি দুঃখ পরজীবনে নাকি তার তত বেশি সুখ হয়। এই কথা শুনে আমার খুব হাসি পায়। আমি জিগাসা করেছিলাম, পরকালে আমার ঠিক কেমন সুখ হবে বলে মনে হচ্ছে তার। সে বলে সগ্গে আঙ্গুর বেদানা ফলফলুরি যখন যা চাইবেন তাই খাইতে পাইবেন আপামনি। আপনার চেহারা হবে মা দুগ্গার মত। আপনার আশে পাশে থাকবে শতেক দাসীবাঁদী, আপনার পরনে থাকবে রাণীর লাহান ডেরেশ। কপালে তারা জ্বলজ্বল করবে। আমি আমার অনেক দুঃখের মাঝেও হেসে ফেলি। ওর বর্ণনার জ্বলজ্বলে তারার কথা শুনে আমার তারা হতে ইচ্ছে করে।
স্বর্গ নরক, বেহেস্ত দোযখ আমি বুঝিনা ।শুনেছি মানুষ মৃত্যুর পরে তারা হয়ে যায়। ঐ দূর গগণ থেকে তাকিয়ে দেখে তার ফেলে আসা মাটির ধরণীকে। আমিও তারা হতে চাই। দূর থেকে দেখবো আমার মা, বাবা, বোন, বোনের ছোট্ট মেয়েটিকে। যার জন্য প্রায়ই আমার বুকের ভেতরে এক দলা কষ্ট উথলে ওঠে। আমি গিলে ফেলি। কাউকে কখনও বলিনা। ম্যাডাম প্যাট্রেসিয়া ও আমার কাউন্সেলর প্রায়ই আমাকে জিগাসা করেন আমি কাউকে দেখতে চাই কিনা। আমি দৃঢ়ভাবে বলি, না আমি কারু সঙ্গে দেখা করতে চাইনা। আমার খুব আমার বোনের পিচ্চি মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করে তবুও আমি চাইনা । আমার যে সুন্দর মুখের স্মৃতি ওর মনে আঁকা আছে, সেটা আমি নষ্ট করতে চাইনা। আমি জানি আমার এই বিভৎস্য কলঙ্কিত মুখ দেখলে ভীষন ভয় পেয়ে যাবে সে। সারাজীবন একটা বাজে স্মৃতি নিয়ে কাটাবে। আমি চাইনা আমার জীবনের সবচাইতে প্রিয় ছোট্ট ঐ মানুষটা আমার জন্য একটা বিচ্ছিরি স্মৃতি নিয়ে জীবন পার করুক।
কেনো বেঁচে আছি? কেনো আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হলো এসব শত শত ভাবনা আছন্ন করে আমাকে। রুকমনির মায়ের কথাই কি ঠিক তাহলে? এইভাবে কি বিধাতা পরীক্ষা করছেন আমাকে? কিন্তু কিসের পরীক্ষা? কি সে পরীক্ষার নাম? মাঝে মাঝে যখন আমার কিশোরীবেলার কথা ভাবি, দু বেনী দুলিয়ে স্কুলবেলা, এক্কা দোক্কা আর চি বুড়ি খেলার দিনগুলো, প্রতিবছর বার্ষিক পরীক্ষার পর মামাবাড়ি বেড়াতে যাবার দিনগুলি। অদ্ভুত ভালো লাগা আর কষ্ট ঘিরে থাকে আমাকে। মন্দ মধুর স্মৃতির দোলাচলে দুলতে থাকি আমি।
মনে করি এসব স্মৃতি নিয়েই কাটিয়ে দেওয়া যাবে বাকীটা জীবন। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে। আরও কতটা কাল বাঁচতে হবে আমাকে? কি নিয়ে বাঁচবো আমি? মানুষের জীবন কাল পরিক্রমায় গড়ায়। ছেলেবেলা, কিশোরবেলা, যৌবন, তারুন্য, বার্ধক্য বা পৌঢ়ত্ব। এসব প্রতিটি বেলায় সে আস্বাদন করে জীবনের নানা মধুর আস্বাদ। রোজ ঠিক বেলা দশটায় এ হাসপাতাল গলিটার পথ ধরে একটি মা দুটি ছোট ছোট শিশুকে নিয়ে যায় স্কুলে।
এ পথটি এমনিতে নির্জন । কখনও কদাচিৎ ফেরিওয়ালা বা আইস্ক্রিমওয়ালা ভুল করে ঢুকে পড়ে এ নির্জন গলিতে। কখনও তারা আর ফিরেও আসেনা। শুধু এই দুটি বাচ্চাকে নিয়েই এই মা রোজ চলে যায় এ পথ ধরে। আমি চুপি চুপি পর্দার আড়াল থেকে ওদেরকে দেখি। বাচ্চা দুটি কি যে মিষ্টি। একটা ছেলে একটা মেয়ে। মাঝে মাঝে ওদের হাতে ধরা থাকে রঙ্গীন হাওয়াই মিঠাই, কখনও বা বেলুন। আমার কি যে ভালো লাগে ওদেরকে দেখতে। আমি রোজ বেলা দশটা বাজার আগ দিয়েই দৌড়ে আসি জানালায়। চুপি চুপি দাঁড়িয়ে থাকি পর্দার আড়ালে। ওরা কখনও আমাকে দেখতে পায় না। বড়জোর ২০ সেকেন্ড। এর মাঝেই পার হয়ে যায় ওরা এ পথ টুকু।
এরপর আমি ওদেরকে নিয়ে ভাবতে বসি। মাটা স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি বাড়ি ফিরে রান্না বসাবে ওদের জন্য? বাচ্চারা নিশ্চয় ঝাল খেতে পারেনা। মা ওদের জন্য রান্না করবে মুরগীর কোর্মা বা মিষ্টি পায়েস। আমার বোনের মেয়েটার কথা মনে পড়ে। আচ্ছা আমি এখানে চলে আসার পরে ও কি আমাকে খোঁজে? ওতো খুব ছোট ছিলো। ওর কি মনে আছে আমার কথা?
ভেতরে ভেতরে আমি মাতৃত্ব অনুভব করি। কিন্তু এসব কথা কাউকে বলিনা আমি .....
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৬