দ্বিতীয় জীবন -১ম পর্ব
আমি পাথরকুঁচির গল্পটা লিখবো। খুব ধীরে , সময় নিয়ে। তড়িঘড়ি করতে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে । প্রথম জীবনের স্মৃতিটা আমাকে কাঁদাবে। চোখে ঝরবে অবিরল ধারায় অশ্রু। আমার এই একটা মাত্র জীবিত চোখ এত ধকল সইতে পারবেনা।
যদি কেউ কখনও আমার এই লেখাটা পড়ে। মানে খুব হেলাফেলায় বা খুব মন দিয়ে। তবে এ জায়গাটিতে এসে সে যত বড় অমনোযোগী বা বিরক্ত পাঠক হোক না কেনো ঠিক ঠিক বুঝে যাবে এ গল্পের নায়িকা এবং লেখিকা একই ব্যাক্তি। আর সেটা আমি। হ্যাঁ এটা আমার গল্প এবং আমিই সেটা লিখতে চাই। যদি কখনও কেউ নাও পড়ে তবুও আমি নিজের জন্য লিখবো। নিজের জন্য আমাকে লিখতে হবে। ডক্টর প্যাট্রেসিয়া আমাকে বলেছেন আমার কাউন্সেলরের কথা শোনা উচিৎ আর আমার এই দ্বিতীয় জীবন নিয়ে সকল হতাশা ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য কাউন্সেলর আমাকে সর্বদা যা কিছু উপদেশ দেন তার মধ্যে এই গল্প লেখার আইডিয়াও ছিলো।
কিন্তু তার কথাটা আমার কাছে খুব হাস্যকর লেগেছে। আমি কি গল্পকার নাকি লেখক নাকি কবি বা সাহিত্যিক যে চাইলেই লিখে ফেলতে পারবো? সে কথা উনাকে বলতে উনি এ্যানা ফ্রাঙ্কের কথা বলেছিলেন। এ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি, যা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং অসংখ্য পাঠকের অশ্রু ঝরিয়েছে। ১৯৪২ এর বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই ছোট মেয়েটি তার পরিবারসহ দখলদার বাহিনীর হাত হতে রক্ষা পেতে আত্মগোপন করে। ১৩ বছরের জন্মদিনে পাওয়া ডায়েরীতেই লেখা শুরু করে তার দিনপঞ্জী। দিনের পর দিন তার আবদ্ধ জীবনের দুঃসহ দিনগুলো লিখে গেছে সে তার ডায়েরীর পাতায়। ডায়রীটা পড়লে মনে হয় সেই সব দৃশ্যগুলি চোখের সামনে দেখছি।
উনি আমাকে এ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরীটা পড়তে দিয়েছিলেন। ডায়েরীটা পড়বার পর থেকে মাঝে মাঝেই আমার নিজেকে ঐ ডায়েরীর কিশোরী এ্যানা ফ্রাঙ্ক মনে হয়। মনে মনে হিসেব কষি, এ্যানা ফ্রাঙ্কের চাইতে আমি ঠিকঠাক কয় বছরের বড়? বা সে আমার চাইতে ঠিক কয় বছরের ছোট ছিলো? অবাক লাগে আমার থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট হয়েও সে কি অসাধারণ করেই না মনের ভাব প্রকাশ করতে পেরেছিলো। সে তার হতাশা,ক্ষোভ, দুঃখ, ভালোবাসা বা চারপাশের অভিজ্ঞতার এক নিঁখুত বর্ণনা একেছে। যা আমি কখনই পারবোনা। আমার অনুভুতিকে আমি ঠিকঠাক ভাষায় আনতে পারিনা।
তবুও সৃস্টিকর্তার প্রতি আমি এতকিছুর পরেও কৃতজ্ঞ যে উনি আমাকে আমার এই দ্বিতীয় জীবনটা বহন করে যাবার জন্য একটা চোখ এখনও অক্ষত রেখেছেন। আর এক চোখের আলো কখনও ফিরবেনা আমার । সব কিছু যেন মেপে মেপে দুভাগ করে দিয়েছেন তিনি। অর্ধেক জীবন, অর্ধেক দৃষ্টি। তবে অর্ধেক সৌন্দর্য্য বলে আসলে মানুষের কিছু নেই তা শুধু একটাবারই আমার বিভৎস্য কদাকার অর্ধেক চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি বুঝে গিয়েছি তাই আমি আর কোনোদিন আয়না দেখিনা।
আয়না ছাড়াও মানুষ চলতে পারে। চুল আঁচড়াতে পারে, খেতে পারে।চুপচাপ বসে অতীতের কথা ভাবতে পারে। আসলে মানুষ পারেনা এমন কিছু নেই। জীবন এক আশ্চর্য্য অধ্যায়। এক সেকেন্ডের পর কোথা থেকে সে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা কেউই কখনও আঁচ করতে পারেনা।
আমিও বুঝিনি সেদিন যে আমার আজন্ম পরিচিত বাড়ির সরু গলিটিতেই ওৎ পেতে বসে আছে কোনো দানব। মানবরূপী দানব। এক সেকেন্ডেই যে আমাকে টেনে নামালো আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে...দূর্বিসহ দ্বিতীয় অধ্যায়। অথচ তার মিনিট কয়েক আগেও আনন্দ উচ্ছল প্রজাপতির মত প্রিয় বান্ধবী রুনুর বিয়ের আসরে উড়ে উড়ে কেটেছিলো কিছু অভূতপূর্ব মুহুর্ত। অনেক ভেবে ভেবে দেখেছি আমি আমার আঠেরো বছরের জীবনে সেই সময়টুকুই ছিলো সবচাইতে আনন্দের এবং ঠিক তার পরবর্তী মুহুর্তটুকুই ছিলো সবচেয়ে বেদনাময়।
মায়ের বিয়ের লাল টুকটুকে শাড়িটা পরেই রুনুর বিয়েতে গিয়েছিলাম সেদিন। মা অনেক নিষেধ করেছিলো। কুমারী মেয়েদের নাকি বিয়ের শাড়ি পরতে নেই। আমি কিছুতেই সে নিষেধ শুনছিলাম না। সারাজীবন আমার অন্যায় আবদার মেনে নেবার প্রধান জায়গাটা, সে আমার দাদী। শেষে দাদীর কথায় মাকে রাজী হতে হলো। আমি মায়ের লাল টুকটুকে বিয়ের শাড়িটা পরে চুলে লম্বা বেনী করে বেলী ফুলের মালা জড়িয়ে সেজেছিলাম সেদিন। নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমার জীবনের এক সোনালী অতীত সেই স্বল্প সময়ের আনন্দঘন মুহুর্তটুকু।
ঐটুকু আনন্দঘন মুহুর্তের বদলে জানিনা কত দিন এই চির বেদনাময় দীর্ঘ জীবনটা বয়ে নিতে যেতে হবে আমাকে। কবে হবে এ বেদনার অবসান। কিছুই জানিনা আমি। আমি এখনও পুরোপুরি সুস্থ্য হতে পারিনি। কখনও পারবো কিনা জানিনা। আমার কাউন্সেলর বলেছেন, শাররিক সমস্যার চাইতেও নাকি আমি মানষিকভাবে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমাকে এসব কাটিয়ে উঠতেই হবে। জীবন হেরে যাবার জন্য নয়। জীবন মানে যুদ্ধ। আমি তার কথা মন দিয়ে শুনি আর মনে মনে হাসি পায় আমার । অট্টহাসি.....
কিন্তু আমি হাসতে পারিনা.....
২য় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৭