আমি একটি গল্প লিখছি।
এ গল্পের নায়িকা চিরায়ত আর দশটা গল্প নাটকের নায়িকাদের মত আকর্ষনীয়া নয়। শুধু তাই নয় আরও কিছু নেতিবাচক বিশেষনাবলী জড়িয়ে রয়েছে তার সাথে। সে সব আমি এখন ঠিক বলতে চাচ্ছিনা। সাধারনত গল্প, নাটক বা সিনেমার নায়িকারা হয় ভীষন আকর্ষনীয়া, সুন্দরী, আভিজাত্যে উজ্জ্বল। অধিকাংশ সময়ই অভাব তাদেরকে স্পর্শ করে না। তারা থাকে আত্মপ্রত্যয়ী, বিলাসী দুনিয়ার যত সৌন্দর্য্য আছে তাই দিয়ে গড়া।
এর বিপরীতও যে নেই তা আমি বলছিনা। অনেক গল্পে নায়িকারা হয় এসবের ঠিক উল্টোটা। তারা হয়তোবা ঠিক ধনীর দুলালী নয় অথবা হত দারিদ্রতার সাথে যুঝে চলে সারাটাজীবন কিন্তু তাদের সেই যুদ্ধ করে চলা বা অদম্য অভিলাসী ব্যাপারটিও হয় দেখবার মত মানে প্রচন্ড আকর্ষনীয়। সেই যে সমরেশ মজুমদারের কালবেলার মাধবীলতা। কাঠিন্য অপরাজেয় মনোবলের মাঝেও যেন বড় কমনীয়। লালচে কোমল আভার মাধবীলতার ফুলগুলি যেমন সবুজ লতাপাতায় জড়িয়ে ওঠে বিলাসী বাড়ির রেলিং বেয়ে, এক অপূর্ব মাধুরীমায় ভরিয়ে তোলে আশপাশ। কালবেলার মাধবীলতার সংগ্রামী জীবনের সারাটা সময় জড়িয়ে ছিলো সেই স্নিগ্ধতার রেশ টুকু। কিন্তু আমার গল্পের নায়িকার এসব কিছুই নেই। না আছে স্নিগ্ধতা না আছে প্রত্যয়।
অথচ সবই তো ছিলো তার।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এ গল্পের নায়িকার নাম দিলাম আমি পাথরকুঁচি। পাথরকুঁচি কখনও কারো নাম হয় বলে আমি শুনিনি। মনে হচ্ছে এটা খুব আনকমন নামই হবে। কিন্তু পাথরকুঁচির জীবনটাও তো বেশ আনকমন। আর তাছাড়া তার হৃদয় এখন পাথরের। শুধু তাই নয় নষ্ট হয়ে যাওয়া একটা চোখের কোটরে খুব সুন্দর করে চিকিৎসকেরা বসিয়ে দিয়েছেন আর একটি পাথর চোখ। বাকী ভালো চোখটা দিয়ে সে দূরের ঝাঁউবন দেখে। বসে রয় জানালার ধারে। খুব আশ্চর্য্যজনকভাবে বিধাতা তাকে অজস্র কঠিন কঠোর নির্মম বাস্তবের মাঝেও খুব মনোরম একটি আবাসস্থল দিয়েছেন। এটি সাধারণ কোনো আবাসস্থল বা বাড়ি নয়। এটি একটি হাসপাতাল।
বিদেশী এনজিও সংস্থার অধীনে তৈরী এই এসিড সারভাইভাল হাসপাতালটিতে আজ প্রায় দেড় বছর যাবৎ বন্দিনী সে। খুব অসাধারণ না হলেও আর দশটা সাধারণ মেয়েদের মতনই কাটছিলো তার জীবন। এস এস সি পাস করে সদ্য কলেজে ওঠা। বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা। হৈচৈ।মায়ের সাথে রান্নাঘরে সাহায্য করা। প্রাচুর্য্য না থাকলেও ভালোবাসা আর স্নেহের অভাব ছিলোনা তার জীবনে।
হঠাৎ এক সর্বনাশা ঝড়ে থমকে গেলো তার পুরো জগৎ। পাথরকুঁচির হৃদয় এখন পাথর। মনটাও তার পাথর। আর ডঃ প্যাট্রেসিয়া তার অপর একটি মায়াকাড়া চোখের আদলে তাকে বানিয়ে দিয়েছেন একটি পাথরের চোখ। স্থির পাথর চোখে সে দূরে তাকিয়ে রয়। পেছনে ফেলে আসা সুখের স্মৃতিগুলি তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। পাঁথরকুচি আয়না দেখে না । দীর্ঘ সুচিকিৎসা ও সুশ্রুসার পরেও এখনও এক দলা মাংস কুচকে রয়েছে ওর মুখের এক পাশে। পাঁথরকুচি সহ্য করতে পারেনা সে বিভৎস্য দৃশ্য। নিজের উপরে ঘেন্না হয়। কাউন্সেলিং ডক্টর রোজ তাকে পাখি পড়ার মত করে শেখায় জীবন কত সুন্দর। চারিদিকের ফুল ফল পাখি। ভোরের মিষ্টি রোদ কিংবা সন্ধ্যার সূর্যাস্ত। পাঁথরকুচির কানে কিচ্ছুই ঢোকে না। সে জানে ডক্টর তাকে যে সুখ ও সৌন্দর্য্যের গল্পগুলি শোনাচ্ছে সে তার অতীত বা প্রথম জীবনের গল্প। সে জীবনে খুব সাধারনের মাঝেও ভোরের মিষ্টি সুবাস ছিলো, জ্যোস্নারাতে আলো ঝলমলে এক আকাশ ছিলো। জীবনের সে অধ্যায়ের শেষ হয়েছে। এখন তার পরবর্তী বা দ্বিতীয় জীবন। এ জীবন নিয়ে আরও কত দূর চলতে হবে বা আরও কতদিন পাঁথরকুচি তা জানেনা।
আমি পাথরকুঁচির গল্পটা লিখবো। খুব ধীরে , সময় নিয়ে। তড়িঘড়ি করতে গেলে আমার খুব কষ্ট হবে । প্রথম জীবনের স্মৃতিটা আমাকে কাঁদাবে। চোখে ঝরবে অবিরল ধারায় অশ্রু। আমার এই একটা মাত্র জীবিত চোখ এত ধকল সইতে পারবেনা।
১ম পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১০