১২ নভেম্বর, ২০১৬, শনিবার
শুরুর কথা:
খুব ছোট বেলায় বাবার মুখে ’গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন’ নামের একটা জায়গার রোমাঞ্চকর এক গল্প শুনেছিলাম। ছোটবেলার সেই গল্পটিই যে মনের মধ্যে গেঁথে যাবে, সেটা ভাবিনি কখনও। আর এটাও ভাবিনি যে, জীবনে কখনও গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন দেখার সুযোগ হয়ে যাবে। হ্যাঁ, আসলেই এবার সুযোগ এলো। অনেকটা আকস্মিকই বলা চলে।
ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলেই বলা যাক। প্রতিবছর সামারে ঘুরতে যাবার নেশাটা আমার বরাবরই। এবারও এসেছি আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গ রাজ্যের ট্যাম্পা বে এলাকায়। টুকটাক ঘোরাঘুরি করছি ঠিই। কিন্তু মন যেন ভরছেনা। সিরাজ মামা, আমার পরিচিত এবং আপন একজন। মায়ামীতে তাঁর বাসায় মাস খানেক আগে আড্ডা দিতে গিয়ে কথায় কথায় তিনি বললেন, "ভাইগনা, লাস ভেগাস বেড়াইতে গেলে কেমন হয়?"
কথাটা শুধু তাঁর মুখ থেকে পড়তে বাকি। সাথে সাথে আমি বলে ফেললাম, "তাহলে গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন বাদ পড়বে কেন?" আমার পাশে বসা রোদেলা, রাজিব আর ফাহিম এক যোগে চিৎকার করে উঠলো "ভেগাস থেকে গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক একদম কাছে কিন্তু মামা!" সিরাজ মামার বউ মানে আমাদের প্রিয় মামী সাথে সাথে আমাদের সবার কথার অনুমোদন দিয়ে দিলেন। আমরা তৎক্ষণাৎ ভেগাস আর গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন দেখতে যাবার উত্তেজনায় প্ল্যান করতে বসে গেলাম। প্রাইসলাইন ডট কম থেকে ভ্যাকেশন প্যাকেজে মোটামুটি সস্তায় প্লেন+ হোটেল+ গাড়িসহ ৩৮৫ ডলার জন প্রতিটিকেট ফাইনাল করা হলো।
ট্যুর প্ল্যানটা দাঁড়ালো অনেকটা এরকম:
১. বারো নভেম্বর, শনিবার ট্যাম্পা এয়ারপোর্ট থেকে ফ্রন্ট্রিয়ার এয়ারলাইন্সে সকাল ৭.১০ এর ফ্লাইটে যাত্রা শুরু এবং ওই দিনই সকাল ৯.১০ এ লাস ভেগাসের ম্যাকক্যারেন এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাব। ডিরেক্ট ফ্লাইট। এখানে একটা টাইম ডিফারেন্সের ব্যাপার আছে। অর্থাৎ, ফ্লোরিডা থেকে ভেগাস ঘন্টা তিনেক পেছানো।
২. ম্যাকক্যারেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে হার্টজ-এর রেন্ট করা গাড়ি নিয়ে সোজা হোটেলে। যদিও হোটেল চেক-ইন-এর টাইম দেওয়া আছে দুপুর ৩ টায়। দেখা যাক, কি হয়।
৩. ওই দিন রাতে 'সিন সিটি' খ্যাত ভেগাসের নাইট লাইফ ঘুরে দেখবো।
৪. তের নভেম্বর, রবিবার কাক ডাকা ভোরে গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন সাউথ রিমের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু এবং রাতে ভেগাসে ফিরে আসা
৫. চৌদ্দ নভেম্বর, সোমবার বিকেলে মাদাম ত্যুসো'র জাদুঘর আর সন্ধ্যা সাতটায় পৃথিবীর অন্যতম সেরা জাদুশিল্পী ডেভিড কপারফিল্ডের ম্যাজিক শো দেখা।
৬. পনের নভেম্বর, মঙ্গলবার সকালে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হুভার ড্যাম ভ্রমণ এবং ভেগাসের আশেপাশে ঘুরে দেখা।
৭. ষোল নভেম্বর, বুধবার দুপুর পর্যন্ত ভেগাসে অবস্থান এবং আজকেই ফেরার দিন। রাত ৯.৩০ এ ভেগাস থেকে ফ্রনটিয়ার এয়ারলাইন্স ছাড়বে, ট্যাম্পা পৌঁছাবো ১৭ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার ভোর ৪.৪০ এ। এটাও ডিরেক্ট ফ্লাইট।
ট্যুরের প্রাথমিক খরচগুলো অনেকটা এরকম:
১. ৮৬৪.৮২ ডলার/ ২জন - ১০ অক্টোবর প্রাইসলাইন থেকে টিকেট কনফার্ম করেছিলাম যেখানে প্লেন ভাড়া+ চার রাত হোটেল ভাড়া এবং রেন্টাল গাড়ি ভাড়া অন্তর্ভূক্ত (ভ্যাকেশন প্যাকেজ)
২. ২৬৫.৯৮ ডলার/ ২জন - ১২ অক্টোবর এম.জি.এম থেকে ডেভিড কপারফিল্ড-এর টিকিট কনফার্ম করেছিলাম
৩. ১৭১.৯৮ ডলার/ ২জন - ১২ অক্টোবর সাউথ রিম বাস ট্যুর, প্যারাডাইস ফাউণ্ড ট্যুরস থেকে টিকিট কনফার্ম করেছিলাম
৪. খাবার খরচসহ অন্যান্য খরচ ট্যুরের পরে হিসাব করা যাবে
ভেগাসের পথে যাত্রা হলো শুরু:
'সিন সিটি' বা পাপের শহর লাস ভেগাস যে শহরটি সর্বদা 'এডাল্ট এন্টারটেইনমেন্ট' দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। ভেগাসকে আমেরিকার নেভাদা রাজ্যের Mojave Desert বলা হয়ে থাকে। এটি এমন একটি শহর যেখানকার রাতগুলো সবসময় আনন্দ উল্লাসে ভরা থাকে। চব্বিশ ঘন্টা ক্যাসিনো, মদ এবং অন্যান্য সকল আনন্দের উপকরণ আপনি পাবেন এই সিন সিটিতে। ভেগাসের মূল আকর্ষণ এর চার মাইল দীর্ঘ স্ট্রীপ যেখানে রাস্তার দু’ধারে সব রঙিন হোটেল, গান-বাজনা আর রঙিন দুনিয়া। সেই রঙিন দুনিয়া ভেগাসের পথেই আমরা অভিযাত্রীরা যাত্রা শুরু করলাম।
সিরাজ মামার বউ মানে আমাদের প্রিয় মামী একটু বেশি-ই সময় সচেতন। সকাল ৭.১০ এ প্লেন ছাড়বে, অথচ রাত দুইটা থেকে তিনি রেডি। শুধু তিনি রেডি হয়ে বসে থাকলে কথা ছিল। আমাদেরও ঘুমের দফারফা করে ছাড়লেন। অবশেষে ঘুম ঘুম চোখে ভোর পাঁচটায় ট্যাম্পা এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম সবাই।
স্টারবাকস থেকে কফি নিয়ে ডিপার্চার লাউঞ্জে বসে যখন সবাই আমরা কফি খাচ্ছি, রোদলো তখন রীতিমতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে! ওকে একটু খোঁচা দিতে যাবো, এমন সময় মাইকে ভেসে এলো যে, আমাদের প্লেনে চড়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তখনও কি জানতাম, কি এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে যাচ্ছি আমরা?
ট্যাম্পা এয়ারপোর্টের ভেতরের স্টারবাকস থেকে কফি নিচ্ছি আমরা
ঘড়ির কাটায় যখন সকাল সাতটা বেজে বার মিনিট, আমাদের প্লেন ফ্লোরিডার মাটি ছেড়ে টুক করে উড়াল দিল আকাশে। আর তার পরেই শুরু হলো বিপত্তি। বাতাসের ঝাপটায় প্লেনটা যেমন করে দোলা শুরু করে দিল, আমরা সবাই আল্লাহ'র নাম ডাকা শুরু করলাম। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট ঝাঁকুনি শেষে প্লেন যখন একটু স্থির হলো, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আমি মেঘের রাজ্যে। যেন হাত দিয়ে ছুঁলেই মেঘগুলোকে ধরা যাবে।
মেঘের রাজ্যে ভেসে চলেছি আমরা
প্লেন থেকে দেখা নেভাদা'র রুক্ষতা
মেঘ দেখতে দেখতে কখন যে চোখে ঘুম চলে এসেছে, টের পাইনি। ঘুম ভাঙলো ফাহিমের গুঁতা খেয়ে। আড়মোড়া ভেঙে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে, ডাকাডাকি করছিস কেন? একটু শান্তি মতো ঘুমাতেও দিবিনা? ফাহিম আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো, "বস্, এইটাতো যাত্রাবাড়ির বাসে উঠছি বইলা মনে হইতাছে।" আমি বললাম, 'মানে?' ফাহিম তারপর যা বললো, তার সারমর্ম দাঁড়ালো অনেকটা এরকম: "প্লেনের অ্যাটেন্ডেন্ট যারা আছে, তাদের একজন খাবারের ট্রলি নিয়ে ফাহিমের কাছে এসে একটা হাসি দিয়ে বললো, স্যার, আপনার কি লাগবে? ফাহিমের মতো বিশ্ব খাদক আমি কমই দেখেছি। কাজেই বলাই বাহুল্য যে সে একের পর এক খাবার অর্ডার করে দিল। কিন্তু খাবারগুলো তার হাতে দেবার আগে সেই ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট ফাহিমকে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, খাবারের ৬০ ডলার আপনি কিসে পে করবেন? ডেবিট? নাকি ক্রেডিট? আমাদের পানিটা শুধু ফ্রি!"
ফাহিম মিঞাও কম স্মার্ট না। এই কথা শুনে ফাহিম তাকে বললো, আসলে আমি নিজের জন্যে শুধু নয়, আমার বড় ভাইয়ের জন্যেও (অর্থাৎ আমি) অর্ডার করেছি, কিন্তু জানিনা, ভাইয়া কি খাবেন। তাই তুমি যদি পরে আসো, তাহলে ভালো হয়। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট চলে গেল। আর ফাহিম আমাকে জাগিয়ে তার ক্ষুধার জ্বালা আর খাবার না পাবার ক্ষোভ আর হতাশার কাহিনী বলার চেষ্টা করলো। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টকে গালি দিয়ে বললো, "শালারা সস্তায় প্লেন টিকেট দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু দোকান ভালোই চালাচ্ছে!"
একদিকে ফাহিমের অত্যাচার, আরেক দিকে আমার পাশে বসা সাদা এক ছোকড়া দেখি সমানে নাক ডাকা শুরু করেছে। সামনে বসা এক বুড়ি ক্রমাগত বকবক করে চলেছে। এইরকম এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আমি আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। এটাই আমার প্লাস পয়েন্ট, যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়তে আমি ওস্তাদ!
স্থানীয় সময় সকাল নয়টা বেজে বিশ মিনিটে প্লেন নামলো লাসভেগাসের ম্যাকক্যারেন এয়ারপোর্টে। লাগেজ বেল্ট থেকে লাগেজ আর রেন্ট করা গাড়ি তুলে নিয়ে আমরা হোটেলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম।
লাসভেগাসের ম্যাকক্যারেন এয়ারপোর্টে রেন্টাল কার নেবার উদ্দেশ্যে শাটল বাসের জন্যে অপেক্ষা করছি
এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল একদম কাছেই বলা চলে। মাত্র দশ মিনিটের ড্রাইভ। হোটেলের নাম সারকাস সারকাস। এটি লাসভেগাস বুলেভার্ডের ওপরে স্ট্রীপের এক মাথায়। হোটেলে চেকইন করেই সবাই বেড়িয়ে পড়লাম বর্ণিল শহর ভেগাস দেখার উদ্দেশ্যে। একেতো আমাদের সবার জন্যেই নতুন শহর, তার ওপরে চারিদিকের মানুষজন আর বিশাল বিশাল সব আলিশান হোটেল দেখে আমরা সবাই কিঞ্চিত পাজল্ড। জিপিএস সেট করে গাড়ি নিয়ে তাই চরকির মতো ঘুরতে থাকলাম। তখনও জানতাম না যে, আজ আর কাল এই শহরের লাসভেগাস বুলেভার্ডের ওপর দিয়ে কিছু মানুষ ম্যারাথন দৌড় দৌড়াবে বলে আমাদের হোটেল সংলগ্ন পুরো এলাকা জুড়ে জ্যাম থাকবে এবং আমরা একের পর এক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবো।
ছবিতে রাতের ভেগাসের কিছু মুহূর্ত:
এয়ারপোর্টে নেমেই এরকম গ্যাম্বলিং বা জুয়ার মেশিন দেখেছি। জুয়া খেলার এই রকম মেশিনগুলো লাসভেগাসের প্রায় প্রতিটি হোটেল আর পথেঘাটে ছেয়ে রয়েছে।
হোটেল ভেনাশিয়া পালাজ্জো:
লাস ভেগাস শহরের প্রায় সাত কিলোমটিার দীর্ঘ স্ট্রীপের চারদিকে শুধু চোখ ধাঁধানো হোটেলের সারি। সব হোটেলের ভেতরেই চমকপ্রদ সব আকর্ষণ। এই পর্বে আমি শুধু একটি আবাসিক হোটেলের ভেতরের শপিং মল এবং সংলগ্ন কিছু এলাকার ছবি তুলেছি। এটির নাম ভেনাশিয়া পালাজ্জো। পুরো হোটেলটির ভেতরে ইতালির ভেনিস শহরের একটি আমেজ সৃষ্টি করা হয়েছে। মনে হবে আপনি ইতালির ভেনিসেই এসে পড়েছেন। ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন ওপরের আকাশটা কিন্তু কৃত্রিম!
কিছু ছবি আপনাদের জন্যে শেয়ার করলাম:
লাস ভেগাস শহরে আমার নিজের অনভিজ্ঞ হাতে তোলা কয়েকটি ভিডিও সংযুক্ত করলাম আপনাদের জন্যে।
চলুন এবার দেখি রাতের লাস ভেগাসের একটি ভিডিও:
হোটেল ভেনেশিয়ান প্যালাজোর কিছু ভিডিও:
ইতালীর ভেনিস শহরের মাঝিরা যেভাবে গান করে:
ট্রিপ টু লাস ভেগাস - পৃথিবীর আশ্চর্য গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন দর্শন
(চলবে)