১৯ অক্টোবর, ২০১১। সকাল ৭ টা। সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যাণ্ড, কুমারগাঁও, সিলেট।
দিরাইগামী ’বিরতিহীন’ বাসে উঠে যখন হাতে থাকা ব্যাগগুলো সিটের পাশে রেখে বসতে যাবো, পাশের সিটের যাত্রী হঠাৎ বিনীতভাবে প্রশ্ন করলেন, ”"ভাইয়ের বাড়ি কই?"” এধরণের প্রশ্নের জন্য আমি সবসময়ই প্রস্তুত থাকি। কেননা অপরিচিত কোন জায়গায় গেলে অজানা মানুষের কৌতুহল হয়। আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, কি উদ্দেশ্য আমার, কোথায় যাবো ইত্যাদি জানতে তারা আগ্রহ বোধ করে। কাজেই বিরক্ত না হয়ে তাকে জানালাম যে, ঢাকা থেকে এসেছি, দিরাই যাবো কিছু কাজে।
বাসে ভ্রমণ করার সময় সাধারণত আমি কারও সাথে খুব একটা কথা বলিনা। কিন্তু এবার এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলো। পাশে বসে থাকা মানুষটির ব্যাপারে আমি আগ্রহ দেখালাম। তার ব্যাপারে জানতে চাইলাম। অবশ্যই এর কারণ আছে। কারণটা হলো, আমার পাশে বসে থাকা মানুষটি একজন গুণী ব্যাক্তি। তিনি একজন বাউল শিল্পী। পুরো নাম তার আশিক মিঞা; গুরুর দেওয়া নাম হলো 'আশিক সরকার'। বয়স আনুমানিক ২৫ বছর। হালকাপাতলা গড়ন। মাথার পিছনে চুলগুলো ঝুঁটি করে বাঁধা। পান খেয়ে ঠোঁটগুলো লাল হয়ে রয়েছে। অসম্ভব মায়া ভরা একটি মুখ। বর্তমানে হযরত শাহজালাল শিল্পীগোষ্ঠীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তার থেকে জানলাম যে, হযরত শাহজালাল (র: ) এর ওখানে ওরসে গত তিন রাত ধরে গান গেয়ে এখন বাড়ি ফিরছেন।
বাউল শিল্পী আশিক সরকার
সাধারণত গুণী মানুষদের সংস্পর্শে এলে আমরা কি করবো, তৎক্ষণাৎ বুঝে উঠতে পারিনা। কিন্তু আমি এক্ষেত্রে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলাম। সেই গুণী মানুষটির একটি সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতকার নিলাম। সাক্ষাতকারটি পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো:
আমি: গান-বাজনার শুরুটা কিভাবে হয় আপনার?
আশিক: খুব ছোটবেলা থেকেই আমি গান করি। বাউল এবং মুর্শিদী গানের প্রতি টান আমার জ্ঞান হবার পর থেকেই। আমার বাড়ির কাছেই কালাশাহ্ পীরের বাড়ি। তিনিই প্রথম আমার গান শুনেন এবং আমাকে বলেন, “"তোকে দিয়ে হবে”"। এভাবেই তাঁর সাথে বিভিন্ন ওরসে গান গেয়ে আমার পথ চলা শুরু। ভরা মজলিসে প্রথম গান করি ২০০৩ সালে। ওরসে সেই প্রথম গানটি এত মানুষের সামনে গাইবার পরেই আমার সাহস বেড়ে যায় এবং আমি পরে সেই ওরসে আরও গান করি। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের লেখা ও সুর করা সেই প্রথম গানটি ছিল:
"তুই আমারে করিম নামে পাগল বানায় দিলা
সাধের চার তারের বেহালা...”"
আশিক সরকার
আমি: কি কি বাদ্যযন্ত্র আপনি বাজান?
আশিক: মূলত: হারমোনিয়াম বাজাই। প্রয়োজনে কিবোর্ড, ঢোল, মন্দিরা এবং বেহালাও বাজিয়ে থাকি। কোন ওরস বা অনুষ্ঠানে ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে বেশ কয়েকজন শিল্পী থাকেন। আমি গান গাইবার পাশাপাশি যখন যে যন্ত্র বাজানোর প্রয়োজন হয়, তখন সেই যন্ত্র বাজিয়ে থাকি।
আমি: পরিবারে কে কে আছে আপনার?
আশিক: আমরা চার বোন, তিন ভাই। বোনদের সবার বিবাহ হয়েছে। বড়ভাই কাঠমিস্ত্রী, মেজোভাই কৃষিকাজ করেন। সবার ছোট আমি। আমার বাবাও কাঠমিস্ত্রী ছিলেন, মা গৃহিনী। দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের হলিমপুর গ্রামে আমাদের বসতভিটায় ছোট একটি কুঁড়ে ঘর রয়েছে। দরিদ্র পরিবারে মানুষ হয়েছি আমি।
আমি: পরিবার থেকে গান-বাজনা করার ব্যাপারে কোন প্রকার বাধা আসেনি কখনও?
আশিক: কখনই না। আমার পরিবারের প্রতিটি মানুষই খুব মুক্তমনের। বাউল গানের প্রতি তাদের অসীম শ্রদ্ধা এবং আগ্রহ রয়েছে। তাই আমি যখন এই ধারায় (বাউল গান) যেতে চাই, তখন আমার পরিবার থেকে শুধু একটি কথাই বলা হয়েছে, ”"আর যাই করো, নেশা করে নষ্ট হয়ে যেওনা”।" আমি আমার পরিবারের কথা এখনও অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। যে কোন প্রকার নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে নিজে দূরে থাকি এবং অন্যকেও দূরে থাকার পরামর্শ দেই।
মগ্ন আশিক সরকার
আমি: কেন বাউল গানের প্রতি আপনি ঝুঁকে পড়লেন?
আশিক: প্রথমেই বলেছি, খুব ছোট থেকেই আমি বাউল-মুর্শিদী এবং আধ্যাত্মিক গানের পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। আমার চারপাশের মানুষজনকে এ ধরণের গানই বেশি গাইতে দেখেছি এবং ওরসগুলোতে নিয়মিত এ ধরণের গানগুলো শুনেছি। সুতরাং খুব ছোট থেকেই বাউল-মুর্শিদী গান আমার মনে স্থায়ীভাবে একটি জায়গা করে নিয়েছে। দ্বিতীয়ত: বাউল এবং মুর্শিদী গানের মাধ্যমেই আমি স্রষ্টার খুব কাছাকাছি চলে যেতে পারি। অন্য একজগতে তখন আমি বিচরণ করি, সাধারণ মানুষের পৃথিবী থেকে যে জগৎ অনেক ভিন্ন।
আমি: কোন কোন শিল্পীর গান আপনি সাধারণত গেয়ে থাকেন?
আশিক: প্রথমেই যার নাম বলবো, তিনি আমাদের এই দিরাইয়ের কৃতি সন্তান, বাংলাদেশের গর্ব বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। তার লেখা এবং সুর করা প্রতিটি গানই আমার প্রিয়, সবগুলো গানই হৃদয় ছোঁয়া। আমি আমার কণ্ঠে তাঁর গান তোলার চেষ্টা করি। শাহ আব্দুল করিম ছাড়াও যাদের গান বেশি গাই, তাঁদের মধ্যে কবি জালালউদ্দিন, হাছন রাজা এবং রাধা রমণের নাম উল্লেখযোগ্য।
আমি: আপনার জীবনের কষ্টকর মুহূর্তগুলো কি মাঝে মাঝে মনে পড়ে?
মহান আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে আমি এখন বেশ ভালো আছি। অথচ আমার পথচলার শুরুটা কিন্তু অনেক কঠিন ছিল। ২০০৪ সালের একটা ঘটনার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তখন আমি নিয়মিত ওরসগুলোতে গান করি। কিন্তু কোন ও¯তাদ ছিলনা আমার। একবার আমার মনে হলো, নিজের এই চারপাশের জগৎ ছেড়ে বের হই, স্রষ্টার তৈরি দুনিয়াটা দেখি, সংগীতকে খুঁজে যদি পাই, তবে তাই হবে আমার জীবনের সার্থকতা। তখন আমি ঘুরতে ঘুরতে ঢাকা শহরে চলে যাই। কিন্তু দু:খের বিষয় হলো, আমার কাছে যা টাকা ছিল, সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। টানা তিনদিন আমি না খেয়ে ছিলাম। মনে পড়ে, এক ডাস্টবিনের ধারে আমি ক্ষুধার তাড়নায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখি, মানুষ আমার উপরেই প্রাকৃতিক কাজ সম্পন্ন করেছে। আমার এই কষ্টকর অবস্থা দেখে একলোকের মায়া হলো। তিনি সিলেট অঞ্চলেই থাকেন। আমাকে তিনি অর্থ সাহায্য করাতে আমি বাড়ি ফিরে আসতে সক্ষম হই।
গানের মাঝে ডুবে গিয়েছেন আশিক সরকার
আমি: কিভাবে আপনি আপনার ওস্তাদের সন্ধান পেলেন?
২০০৫ সালে আমি দিরাইয়ের ছাবাল শাহ্ পীরের সাথে নেত্রকোণা জেলার ধর্মপাশা উপজেলায় একটি ওরসে গান করতে যাই। সেখানেই পরিচয় হয় আমার বর্তমান ওস্তাদ লোকমান সরকারের সাথে। সেই ওরসে আমার গান শুনে লোকমান সরকার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ”তোমার ওস্তাদ কে?” আমি তাকে জানালাম, এই পর্যন্ত নিজে নিজেই এসেছি। একথা শুনে তিনি আমাকে তার শিষ্যত্ব গ্রহনের প্রস্তাব দিলেন। সেই থেকে আমি তার শিষ্য।
আমি: আপনার জীবনের সবচাইতে আনন্দঘন মুহূর্ত কোনটি?
আনন্দ মুহুর্ততো অনেকগুলো। যেখানেই বাউল আর মুর্শিদী গান করি, মানুষের ভালোবাসা পাই। একবার সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে গান গাইবার পর মানুষ ভালোবেসে আমাকে ২০ হাজার টাকা দিলো। আর আমার গানে পাগল হয়ে এক অল্প বয়স্কা সুন্দরী রমণী আমাকে প্রেম নিবেদন করলো। কিন্তু আমি তাকে 'না' বললাম। তাকে জানালাম যে, আমার সব ভালোবাসা, সব চিন্তা-ভাবনা আমি সংগীতের মধ্যে দিয়ে দিয়েছি। এই মুহুর্তে অন্যকাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমি: সংগীত নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?
আশিক: সংগীত হলো সাধনার ফসল। কিন্তু একই সাথে অত্যন্ত কষ্টকর পথ। ব্যাক্তিগতভাবে আমি পরিচিতি লাভ করতে চাই, আমি চাই, আমার গানের মাধ্যমে পৃথিবীবাসী আমাকে জানুক। বাউল এবং মুর্শিদী গানকে আমি পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে চাই। কুরবানীর ঈদের পর ব্যাক্তিগত একটি অ্যালবামের কাজ শুরু করার ইচ্ছা আছে। যদিও একটি অ্যালবাম বানাতে অনেক টাকার প্রয়োজন। আমার এক বন্ধু লণ্ডন থেকে আসবে। সে আমাকে কথা দিয়েছে যে, আমার ব্যাক্তিগত অ্যালবামটি করার ক্ষেত্রে সে আর্থিক সাহায্য প্রদান করবে।
শাহ আব্দুল করিমের গানে মগ্ন আশিক
আমি: আপনি নিজে কি গান রচনা করেন?
আশিক: অবশ্যই করি। যদিও গান লেখাটা অনেক কষ্টের একটা কাজ। অনেক জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। গান লিখতে হলে অনেক কথার অর্থ জানতে হয়। আমার নিজের লেখা এবং সুর করা দু'টি গান আপনাকে দিচ্ছি।
(এরপর আশিক সরকার তার নিজহাতে লেখা দু'টি গান আমাকে দিলেন যেগুলো হুবহু তুলে দিচ্ছি পাঠকদের উদ্দেশ্যে)
ভালোবাসার গান:
ওই সোনার ময়নায়, দেখলে আমারে আই লাভ ইউ জানায়
আমি করি কি উপায়, আমারে আই লাভ ইউ জানায়।
১. ওরে দেখলে ময়নায় ইংরেজিতে বলে আই লাভ ইউ
প্রেম করিতে ইংলিশ নাকি মডেল হইছে নিউ
আমারে ইংলিশ বলিয়া টেংকইউ, ধন্যবাদ জানায়।।
২. আর বলে ইংরেজিতে ইউ মাই লাভার মেন
তুমি ভালোবাসার মানুষ আমার বুজেও বুজনা কেন?
বারে বার কইয়া আণ্ডাস্টেন আমারে বুজায়।
৩. ওরে মোবাইল ফোনে বলে ময়নায় হ্যালো মাই লাভ
বুজলাম আমার সাথে সোনার ময়নার প্রেম করিবার ভাব
আশিক সরকার বুজলাম হিসাব তোমার যন্ত্রণায়।।
বাউল গানে মগ্ন আশিক
শাহজালালের গান:
ওরে শাহ্জালাল বাবা তুমি আল্লারও আওলিয়া
ও তুমি দয়া কর জালাল আমায়, বিকারি জানিয়া।।
১. ওরে এয়ামেন হইতে আইলায় বাবা তিনশ সাইট জন লইয়া
বাবা সুরমা নদী পার হইলেন জায়নামায বিছাইয়া
২. তখন গর্গবিন্দ পাগল হইল বাবার খবর পাইয়া
জালালের আযানের সুরেতে গেল সাত তালা বাঙ্গিয়া
৩. বাবা সিলেটবাসী ধন্য হইল তুমার পরশ পাইয়া
ওরে আশিক সরকার কান্দে তোমার চরণের লাগিয়া।।
ফেরার আগে আশিক সরকারের কণ্ঠে গাওয়া বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের বেশ কয়েকটি গান শুনলাম। "কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি...বন্ধে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে, দিওয়ানা বানাইছে..."
তার উদার কণ্ঠের বাউল সঙ্গিতে মনটা উদাস হয়ে গেল। এই অন্যভুবনের মানুষটির সান্নিধ্যের স্পর্শে আসতে পেরে অন্যরকম এক আত্মপ্রশান্তির ছোঁয়া অনুভব করলাম নিজের মাঝে।