১৩ মে, ২০১১। রাত এগারোটা চল্লিশ মিনিট।
রাজারবাগ থেকে সকাল ৭ টায় গ্রীনলাইনের ভলভো এ.সি বাসটা যখন চট্রগ্রামের উদ্দেশ্যে ছাড়লো, তখনো ভাবতেই পারিনি যে, সামনে কি দুর্দশা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। আমরা বলতে আমার সাথে রয়েছেন কলিগ সুস্মি আপা। গন্তব্য চট্রগ্রাম হয়ে কক্সবাজার। যদিও অফিসের কাজ বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায়। লামায় যেহেতু থাকার তেমন কোন ভাল ব্যবস্থা নেই, তাই প্ল্যান হলো, কক্সবাজারে থেকেই প্রতিদিন লামাতে গিয়ে আমরা কাজ করবো।
গৌরীপুর আর মীরেরসরাই-তে দুই দুইটা বিশাল জ্যামের কারণে ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পৌঁছাতে প্রায় ১৫ ঘন্টা সময় লেগে গেল। চট্রগ্রাম থেকে অবশ্য অফিসের গাড়িতে কক্সবাজার পর্যন্ত গেলাম, যে গাড়িটা পরবর্তী তিন দিন আমাদের সাথেই থাকবে। আমাদের আরেকজন কলিগ, সুমন ভাই। চকোরিয়া থেকে কক্সবাজারের পথে তিনিও আমাদের সহযাত্রী হলেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখছি, সুমন ভাইয়ের বাড়ি কিন্তু লামাতেই।
কক্সবাজারে আমরা উঠেছি হোটেল কোরাল রীফে। এখানকার এসি রুমগুলো একটু ছোট সাইজের হলেও খারাপ না। আর দামের দিক থেকে অন্য সব হোটেলের থেকে কমই। প্রচণ্ড কান্ত লাগছে। যাই, ঘুমিয়ে পড়ি।
১৪ মে, ২০১১। রাত ১১:১৫।
সকাল আটটা বেজে ত্রিশ মিনিটে কক্সবাজার থেকে রওনা হলাম লামার উদ্দেশ্যে। প্রায় ৮৫ কিলোমিটার রাস্তা। গাড়িতে সময় লাগলো দেড় ঘন্টার মতো। কক্সবাজার থেকে লামা পর্যন্ত খুব কম বাস চলাচল করে। তবে চকোরিয়া থেকে লামা পর্যন্ত লামা-আলীকদমের রাস্তায় ২৮ কিলোমিটার যেতে চান্দেরগাড়িতে জনপ্রতি ৩৫ টাকা পড়ে। আর বাসে গেলে ৩০ টাকা। যাবার পথে দেখলাম মিরিঞ্জা পর্যটন আর টাইট্যানিক পাহাড়, যেখান থেকে আকাশ পরিষ্কার থাকলে দূরবীণ দিয়ে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া পর্যন্ত দেখা যায়। লামা যাবার পথে ইয়াংছা বাজারের কাছেই চেকপোস্টে নাম লিখিয়ে নিতে হলো।
লামার পথে
মাতামুহুরী নদী
মাতামুহুরী ব্রিজ
যাবার পথের পাহাড়ী উঁচু-নিচু আঁকা-বাঁকা রাস্তার দু’ধারের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সকাল ১০ টা নাগাদ যখন লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছালাম, ওখানকার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: শফিউর রহমান মজুমদার আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন। লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, গ্রাউস (গ্রাম উন্নয়ন সংস্থা) এবং আই.সি.ডি.ডি.আর.বি -এর অফিসে একটা কর্মব্যাস্ত দিন কাটিয়ে আজ ফিরে এলাম কক্সবাজারে।
মাতামুহুরী ব্রিজ থেকে দেখা লামার সৌন্দর্য
অতুলনীয় লামা
বলতে ভুলে গিয়েছি, আজ '’লামামুখ'’ নামের একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। ওখানে ’'মিষ্টিবাবুর দোকানে'র’ বিখ্যাত ছানার মিষ্টি খেলাম।
লামামুখের কাছে ব্রিজের ওপরে
মিষ্টিবাবুর দোকান
এখন যাব একটু সী বীচে, সমুদ্রস্নান করতে।
১৫ মে, ২০১১। রাত ১২:৩০।
গতকালের মতো আজকেও চরম ব্যস্ত একটা দিন কাটলো। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া। এক ফোঁটা বৃষ্টি নেই। এদিক ওদিক যে একটু ঘোরাঘুরি করবো, সেই অবকাশও নেই। খুব সকালে লামা রওনা হয়েছিলাম। নাস্তা করার সময়টুকু পাইনি। তারপরেও কাজের ফাঁকে লামা বাজারের কাছে ছোট্ট বৌদ্ধ মন্দিরটিতে গেলাম একটু। অসম্ভব শান্ত এক পরিবেশ।
বৌদ্ধ মন্দির
সারাদিনের পরিশ্রম শেষে সন্ধ্যায় রওনা হলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে।
১৬ মে, ২০১১। রাত ৮ টা।
আজকের প্ল্যান হলো, তাড়াতাড়ি কাজ শেষে করে লামার কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনটা ঘুরে আসা।
দুপুর একটার দিকে রিজার্ভ চান্দের গাড়িতে কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ড্রাইভার নাসির দক্ষ হাতে লামার পাহাড়ী দুর্গম রাস্তা দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদেরকে। লামা থেকে আমাদেরকে যেতে হবে ২৬ কিলোমিটার দূরে কিয়াজুবাজারে। সময় লাগবে দেড় ঘন্টার মতো। সেখান থেকে ভিতরে আরও প্রায় চার কিলোমিটার গেলেই কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের ক্যাম্পাস।
আমাদের চান্দের গাড়ি
কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশন-এ যাবার পথে
স্থানীয় বাজারে খানিক বিরতি নিয়েছিলাম
স্থানীয় বাজারে
বেলা সোয়া দুইটার দিকে আমরা কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনে পৌঁছালাম। ভিতরে দর্শনার্থী হিসেবে প্রবেশের জন্যে সুমন ভাই আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন। তাই তেমন কোন সমস্যা হলোনা ঢুকতে। পূর্ব অনুমতি না নেয়া থাকলে শুধুমাত্র প্রতি রবিবার বিকাল ৩-৫ টা দর্শনার্থীদের জন্যে উন্মুক্ত থাকে।
কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনে যাবার রাস্তা
কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনে যাবার পথে
কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনে ঢোকার মুখেই ওখানকার একজন সদস্য রাশেদ ভাই আমাদেরকে অভিনন্দন জানালেন। তার আন্তরিকতায় সত্যিই আমরা মুগ্ধ হলাম। তিনি আমাদের পুরো ক্যাম্পাসের অংশবিশেষ ঘুরিয়ে দেখালেন। একে একে আমরা দেখলাম দরবারান, ধ্যান ঘর, রহমগিরি পাহাড়। কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের মূল গেইট দিয়ে ঢোকার পরেই অদ্ভূত শান্ত, স্নিগ্ধ এবং মনোরম একটা পরিবেশ আমাদেরকে সত্যিই মুগ্ধ করলো।
কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনে ঢোকার মুখে
রাশেদ ভাই আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন
এরপর কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের আরেকজন সদস্য ইফতেখার ভাই আমাদের তোকমার শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। এই প্রচণ্ড গরমেও মুহূর্তের মধ্যে আমাদের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এরপর বারান্দায় বসে ইফতেখার ভাইয়ের থেকে জানলাম কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের অজানা অনেক কথা।
এখানে বসেই ইফতেখার ভাইয়ের সাথে কথা বললাম
শান্ত পরিবেশ
এরকম ছোট ছোট ব্রিজ পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে রয়েছে
এখানে প্রায় ৬০০ জনেরও বেশি কর্মী রয়েছেন। প্রত্যেকেই নিবেদিত প্রাণ। সবাই একই পরিবারের সদস্য। কোয়াণ্টাম মেথডের মেডিটেশন ছাড়াও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তাঁরা পরিচালনা করছেন। কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের ভেতরে ঢোকার সময় দেখেছিলাম দরবারানে প্রায় ৪০০ ছোট শিশুরা একসাথে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। ইফতেখার ভাই জানালেন, এখানে পাহাড়ের উপরে ’কোয়ান্টাম কসমো স্কুল’ রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষানীতির অধীনে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ৪০০ জন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদেরকে বিনা বেতনে পড়ালেখা করানো হয়। তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশন থেকেই করা হয়ে থাকে। প্রতি বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কোটা অনুযায়ী সারা বাংলাদেশ থেকে সাড়ে তিন বছর থেকে ৫ বছর বয়সী ছাত্র ভর্তি নেয়া হয়। যদিও আদিবাসী সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরকেই ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। দশম শ্রেণীর পরে পরবর্তী পড়ালেখার জন্যে যাবতীয় খরচাদি কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশন থেকেই বহন করা হয়। আর কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের মূল চালিকা শক্তির একটি হলো ’মাটির ব্যাংক’ যেখানে হাজার হাজার মানুষ তাদের সাধ্য অনুযায়ী দান করছেন অবিরত। ইফতেখার ভাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, কোয়ান্টাম কসমো স্কুলটি ইতিমধ্যে চট্রগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ স্কুলগুলোর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। এ স্কুলেরই একজন কৃতি সন্তান বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত।
দরবারান
ছায়া ঘেরা পরিবেশ
কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের এই ক্যাম্পাসের সকল সদস্যই সকাল-বিকাল নিয়মিত মেডিটেশন করেন। ছায়ায় ঢাকা শান্ত পরিবেশের ধ্যান ঘরটিতে একসাথে প্রায় ২০০ জন মেডিটেশন করতে পারেন।
ধ্যান ঘর
ধ্যান ঘরের ছবি
রহমগিরি পাহাড়ের উপরেও পাথর বিছানো আছে, যার উপর বসে ক্ষণিকের জন্যে ধ্যানে মগ্ন হয়ে যান মেডিটেটররা।
রহমগিরি পাহাড়ে
পুরুষ এবং মহিলা সদস্যদের জন্যে রয়েছে পৃথক আবাসিক ব্যবস্থা। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থান থেকে যারা মেডিটেশনের উদ্দেশ্যে এখানে যান, তাদের জন্যেও রয়েছে থাকার সুব্যবস্থা। কেউ এখানে থাকতে চাইলে সে ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়। এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের ঢাকা শান্তিনগর হেড অফিসে যোগাযোগ করতে হবে।
শান্ত পরিবেশ
আনারসের বাগান
পায়ে হাঁটা রাস্তা
প্রায় ১৫ একর জমির ওপরে প্রতিষ্টিত কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের এই ক্যাম্পাসটিতে বিদ্যুত ব্যবস্থা বলতে জেনারেটর এবং সোলার সিস্টেম রয়েছে। এই ১৫ একর ছাড়াও প্রায় ১৫০ একর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছাড়াও রয়েছে পোলট্রি ফার্ম। কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনেই নির্মাণাধীন রয়েছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্লে গ্রাউণ্ড, যেখানে ছোট্ট শিশুরা নিয়মিত খেলাধূলা করে।
মনোরম দৃশ্য
ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে তোলা ছবি
সময় স্বল্পতার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেশিক্ষণ থাকা হলো না কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের অবর্ণনীয় সুন্দর পরিবেশে। তবে সুযোগ হলে আবার যাবো কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের অপূর্ব মায়াঘেরা পরিবেশের সান্নিধ্যে, যার স্পর্শে হয়তোবা হাজারো মানুষের মতো প্রশান্তি, নিরাময় এবং সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে বদলে যাবে আমার জীবনটিও।
না বলা কথা:
১. লামাতে বিদ্যুত সরবরাহের অবস্থা খুবই করুণ। বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুত থাকেনা।
২. লামা থেকে কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশন পর্যন্ত রিজার্ভ চান্দের গাড়ি ভাড়া ২০০০-২৫০০ এর মধ্যে পড়বে।
৩. লামা থেকে কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশন পর্যন্ত চান্দের গাড়ি ভাড়া করতে হলে নাসিরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন: ০১৫৫৩ ৬৩৬০৯৮, ০১৮১৩ ৫২৯৫৯০
৪. লামা বাজার থেকে খুব কাছেই সাবেক বিলছড়িতে অবস্থিত পাহাড়ের উপরের বৌদ্ধমন্দিরটিতেও ঘুরে আসতে পারেন।
৫. কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের ক্যাম্পাসের ভিতরে গ্রামীণফোন, এয়ারটেল বা বাংলালিংক-এর সংযোগ পেলাম না। শুধুমাত্র রবি-ই ভরসা।
৬. বান্দরবানের রুমা উপজেলার মতো লামাতেও দেখলাম পাহাড়ে তামাক চাষের প্রচলনটা বেশি।
৭. লামাতে থাকার ব্যবস্থা বলতে একটি মাত্র ভালো মানের হোটেল রয়েছে। নাম ’হোটেল মিরিঞ্জা’। এখানে নন এ.সি রুমসহ ৭০০ টাকার এ.সি রুমও রয়েছে। ফোন নম্বর: ০১৫৫৩ ২৪৪৮২৬, ০১৫৫৩ ৭৫৭৪৭৫, ০১৫৫৩ ৬৫৫০৯৪, ০১৫৫৬ ৬২৪৪৮৩
৮. লামাতে খাওয়া দাওয়া করার জন্য মোটামুটি মানের হোটেল জব্বারিয়া এবং হোটেল মেহমান।
৯. কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশনের সাথে যোগাযোগের জন্য ফোন নম্বর: ৯৩৪১৪৪১, ৮৩১৯৩৭৭, ০১৭১১৬৭১৮৫৮, ০১৭১৪৯৭৪৩৩৩
(কোয়ান্টাম ফাউণ্ডেশন নিয়ে আমার এ লেখাটি সম্পূর্ণরূপেই আমার ব্যাক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে ফ্রেমবন্দি করা। লেখাটিতে তথ্যগত অনাকাঙ্খিত কোন প্রকার ভুল-ত্রু“টির জন্য অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা করছি।)