দেশের ও দেশের বাইরের কোটি কোটি মানুষের দোয়া ও প্রার্থনায় সাভারের ধসে পড়া ভবন থেকে অসংখ্য মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে। উদ্ধার কাজ এখনও চলছে। আশা করা যায়, আজকের মধ্যে আরও অনেককে উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
কোন একটি আকস্মিক দুর্ঘটনায় স্বভাবতই যেটা ঘটে, প্রথমে আশেপাশের সাধারণ মানুষ ছুটে আসে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধারে। তারপর আসে প্রশিক্ষিত বাহিনী ও সরকারী সাহায্য। সাভারের এই দুর্ঘটনাও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে যেটা খুব স্পষ্ট করে বলা যায়- প্রশিক্ষিত বাহিনী যেমন ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, সেনাবাহিনী বা বিশেষ উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের থাকে উদ্ধারের প্রশিক্ষণ- কিন্তু যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকলে এদের অধিকাংশই নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে চাইবেন না, চাওয়ার কথাও নয়- কারণ ওরাও রক্তমাংসের মানুষ- ওদেরও পরিবার আছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে কিছু মানুষ পাবেন যাদের হয়ত অন্যসময় কোন বিশেষত্ব চোখে পড়বে না- কিন্তু কোন দুর্ঘটনায় বা দুর্যোগে এই মানুষগুলো অকুতোভয় সিংহের মত নিজের জীবন বিপন্ন করে অন্যের সহায়তায় ঝাপিয়ে পড়ে। (একাত্তরে এই মানুষগুলোই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অগ্রভাগে ছিল এবং এরাই বাকীদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আর রাজনৈতিক নেতারা ছিল আত্মগোপনে।)
যাহোক, যে কথা বলছিলাম। দুর্ঘটনার প্রায় ৫৫ ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। প্রশিক্ষিত বাহিনীর থাকে প্রশিক্ষণ আর সাধারণ মানুষের থাকে আবেগ। সাভারের দুর্ঘটনায় সাধারণ আবেগী মানুষ যারা উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন তারা তাদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাখে পালন করেছেন। এখন তাদের একটু সচেতন হতে হবে। কারণ ধ্বংসস্তুপের গভীরে যেতে হলে সবারই প্রয়োজনীয় নিরাপত্ত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তাই এখন প্রশিক্ষিত বাহিনীকে কাজ করতে দেয়া উচিত।
আমরা দেশের বাকী মানুষ যারা সশরীরে যেতে পারছি না বা কোন সহায়তা করতে পারছি না তারাও বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি। কেউ রক্ত দিচ্ছি, কেউ হাসপাতালে আহতদের সেবা করছি, কেউ প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাদ্য কেনায় অর্থ সাহায্য করছি। কেউ সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছি।
তবে টিভিতে যেটা দেখতে পেলাম- ঐ ভবনের সামনে বোতলজাত পানি, বিস্কিট, পাউরুটি ইত্যাদির বিশাল স্তুপ জমে গেছে। অথচ আমরা চিন্তা করছি না- যারা এখন উদ্ধার হবেন তাদের ঐ মুহূর্তে এসবের দরকার আছে কিনা। অপরদিকে যারা উদ্ধারকাজে অংশ নিচ্ছেন তারাও নিজ নিজ খাদ্য ও পানীয় ব্যবস্থা নিজেই করে নিচ্ছেন। তাই এখন আর এই জিনিসগুলো কিনে পাঠানোর দরকার নেই বলে আমার ধারণা।
আজকে যেটা সবচেয়ে জরুরী ছিল সেটা হল অক্সিজেন সরবরাহ। সকাল থেকেই অনেকে সেগুলো পৌঁছে দিয়েছেন।
তবে হতাশার কথা হল- দেশের এত বড় রাষ্ট্রযন্ত্র, এত দাপুটে সরকার- এখানে এরকম দুর্যোগে জরুরীভিত্তিতে কি কি করণীয় এবং কিভাবে সবকিছু সম্বন্বয় করা উচিত সেরকম কোন তৎপরতা চোখে পড়ল না। আমার মতে, বাংলাদেশে অসংখ্য ভবন এরকম দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে আছে। কিন্তু আমাদের সরকারের এইরকম ঝুঁকি মোকাবেলার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি বলতে গেলে শূন্য।
খুব সহজ করে বলি। প্রথমদিন দরকার ছিল পানি। সরকার চাইলে ঘটনার ১ ঘন্টার মধ্যে আশেপাশের বোতলজাত পানির কোম্পানী বা গুদাম থেকে হাজার হাজার বোতল পানি সরবরাহ করতে পারত। দরকার ছিল ওষুধ ও ফার্স্ট এইড। সরকার চাইলে এটাও ১ ঘন্টার মধ্যে পৌঁছতে পারত। দরকার ছিল লোহা কাটার যন্ত্র গ্রাইন্ডিং মেশিন, ড্রিল মেশিন ইত্যাদি। সরকারের পুলিশ বা র্যাদব বাহিনী শুধু নবাবপুরে কয়েকটি দোকানে হানা দিলে কয়েকশত মেশিন সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারত। দুপুরের পর চিন্তা করার দরকার ছিল রাতে আলোর উৎস কি হবে। ঢাকার যে কোন ইলেকট্রিক মার্কেটে হানা দিলে শত শত মেটাল হ্যালোজেন, উচ্চ ক্ষমতার এলইডি লাইট ও প্রয়োজনীয় ক্যাবল নিয়ে যাওয়া যেত। ধসে পড়া ভবন সহ পুরো এলাকা আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দেয়া যেত।
প্রথমদিন থেকেই যদি এভাবে পরিকল্পনা করে কাজ করা যেত তাহলে হয়ত আরও কিছু জীবন বাঁচানো যেত। উদ্ধারকাজও দ্রুতগতিতে চলত।
এতে কত টাকা ব্যয় হত?- ৪/৫ কোটি। এতগুলো মানুষের জীবনের দাম অবশ্যই ঐ অর্থের চেয়ে বেশি। আর যদি বলি আমাদের গার্মেন্টস খাতের যে দুর্নাম বিশ্বব্যাপী হয়ে গেল সেটা টাকার অঙ্কে মাপা সম্ভব নয়।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল- নানা অপ্রয়োজনীয় খাতে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয়, দুর্নীতি করতে সরকারের এক মুর্হূত সময় লাগে না। কিন্তু এরকম একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার সময় সরকারের দ্রুতগতিতে ব্যবস্থা নেয়ার কোন চিহ্নই দেখতে পেলাম না।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আমরা ছুটছি নিজের জীবিকার একটি অংশ নিয়ে ঐ মানুষগুলোকে সাহায্য করতে। অথচ আমরা ঠিকমত জানিও না, আমরা যা করছি সেটার এই মুর্হূতে আর প্রয়োজন আছে কিনা। একটু আগে এক বন্ধু ফেসবুকে মেসেজ দিল যদি কিছু টাকা দিই তবে ওরা কয়েকজন আজ কিছু খাবার পানি, ওষুধ ও অক্সিজেন নিয়ে যাবে। আমি বুঝতে পারলাম- এরকম অসংখ্য তরুন, যুবক হয়ত আজকে মানুষের প্রতি ভালবাসা থেকে ছুটে যাবে সাভারে যেটা হয়ত আর প্রয়োজন হবে না।
সবার প্রতি অনুরোধ, এভাবে এলোমেলো ও বিক্ষিপ্তভাবে কাজ না করে মোস্তফা কামাল পলাশ ভাইয়ের মত সবাই অর্থ সংগ্রহ করুন। এই দুর্ঘটনায় অন্তত হাজার খানেক মানুষ বাকীজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে, শত শত মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য একাধিক অস্ত্রপচার করতে হবে। কমবেশি সবাইকে আগামী কয়েকমাস ওষুধ ও খাদ্য জোগাড় করতে হবে।
আমাদের সংগ্রহীত সমস্ত অর্থ আমরা পরে হয়ত কোন একটি সংস্থার মাধ্যমে ঐ দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের আবার সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য ব্যয় করতে পারব। কারণ, আমরা নিশ্চিতভাবে জানি- খুব অল্প দিনের মধ্যেই সরকার, মিডিয়াসহ সবাই এই ‘নগণ্য’ মানুষগুলোর কথা ভুলে যাবে।
আমি নিজেও এই গার্মেন্টস শিল্পের সাথে জড়িত এক নগণ্য ব্যক্তি। সাভারের এক প্রতিষ্ঠানেই আমি কাজ করি। এই মানুষগুলোর প্রতি আমার মমতা অনেক। আমরা গতকাল আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ বেশকিছু টাকা এনাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। এরপর আমরা সমস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেটাও দুর্ঘটনার শিকার মানুষগুলোর কাজে ব্যয় করার আশা রাখি।
সবাই ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করার অনুরোধ রইল।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৩০