ভারতের সমাজ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটা আপাত বৈপরীত্য বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশকে অনেকেই খুঁজে পেতেন। এই মতের প্রবক্তারা ভারতের সংবিধান আইন কানুন ও প্রধান রাষ্ট্রনায়কদের সিংহভাগের চিন্তাধারাকে বেশ আধুনিক বলে গণ্য করতেন। বিপরীতে ভারতীয় সমাজকে বেশ পিছিয়ে থাকা হিসেবেই তাদের মনে হত, কারণ এই সমাজ জাতপাতে ও ধর্মীয় নানা পরিচিতিতে বিভক্ত। বাস্তবিক পক্ষেই বৈরীমূলক এমনকী রক্তাক্ত ও প্রাণঘাতী নানা দ্বন্দ্বে প্রায়শ লিপ্ত অবস্থায় ভারতীয় সমাজকে আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু এবং অন্যত্রও কোথাও কোথাও এর সঙ্গেই ছিল বেশ কড়া ধরণের হিন্দি বিদ্বেষ ও প্রাদেশিক অস্মিতা।
রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ভারতীয় সমাজের দ্বন্দ্বময়তার দৃষ্টিকোণে ভারতীয় সংবিধানকে মনে করা হত বেশ প্রগতিশীল ও ইনক্লুসিভ চরিত্রের, যাকে নাকি অনুসরণ করত সাম্যপন্থী আইন কানুন। কংগ্রেসকে মনে করা হত এই সাংবিধানিক ধাঁচার মোটামুটিভাবে এক বিশ্বস্ত রাজনৈতিক ধারক বাহক। জাতপাত, ধর্মীয় ও ভাষাগত ভিন্নতাকে মাথায় রেখে কিন্তু সেই বিভাজনকেই সর্বস্ব না করে তুলে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও নিচুতলার ক্ষমতায়নকে তখন শাসক দল কংগ্রেস কাগজে কলমে সামনে রেখেছিল বলে এই মতের শরিকরা মনে করেন।
এই দাবী স্বত্ত্বেও একথা বিশেষভাবেই মনে রাখার কংগ্রেস নেতৃত্বের মূল অংশটা মূলত সমাজের উচ্চবর্গ থেকেই আসা এবং বিশেষ গুরূত্ব নিয়ে দলিত ক্ষমতায়ন তার অ্যাজেন্ডায় কখনোই আসে নি। সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন ও দলিত আন্দোলন কংগ্রেসের ভেতর থেকে কখনো সেভাবে শুরু হতেই পারে নি। সেজন্য একদিকে বামপন্থী কমিউনিস্ট ও অন্যদিকে সমাজবাদী আন্দোলন ও সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন এর ওপরেই বিভিন্ন আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া জাতি উপজাতি জনজাতিদের ভরসা করতে হয়েছে। আর এই সমস্ত আন্দোলন অন্তত নব্বই দশকে বিজেপির উত্থানের আগে পর্যন্ত তার সমস্ত সামাজিক রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে কংগ্রেসকেই তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করতে বাধ্য হয়েছে। কংগ্রেসকে তারা দেখেছে মূলত উচ্চবর্ণ ধনী জমিদার, কুলাক ও বড় বুর্জোয়াদের পার্টি হিসেবেই।
স্থিতাবস্থার রাজনীতিতে অভ্যস্ত কংগ্রেসের সামনে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অন্তত (কোনও কোনও এলাকা বাদে) জাতীয় প্রেক্ষিতে বড় কোনও চ্যালেঞ্জ দেখা যায় নি। সামাজিক ক্ষমতায়নের রাজনীতি নব্বই দশকের আগে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় রাজনীতিতে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকা খুঁজে না পেলেও সত্তর দশকের মধ্যভাগ থেকেই সে কংগ্রেসী রাজনীতির মহড়া নিতে চেয়েছে। স্বাধীনতা লাভের দশ বছরের মাথাতেই কেরালায় অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি (১৯৫৭ সালে) প্রথম অকংগ্রেসী সরকার তৈরি করতে সমর্থ হয় আর সেই সামাজিক রাজনৈতিক জাগরণে পিছিয়ে থাকা জাতির মানুষদের নিয়ে উচ্চবর্গের বিরুদ্ধে নির্ণায়ক যুদ্ধ ঘোষণা অবশ্যই গুরূত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থেকেছে। পাশাপাশি মনে রাখার সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়াদের উল্লেখযোগ্য লড়াই স্বত্ত্বেও শ্রেণি আন্দোলন ও শ্রেণি পরিচিতিই সেখানে সামনে থেকেছে।
ইন্দিরা পরবর্তী সময়ের ভারতীয় রাজনীতিতে, আরো বিশেষভাবে বললে আশির দশকের শেষ থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসী ও বাম রাজনীতির বাইরে দুই বিপরীত ধারার ক্রমবিস্তার লক্ষ্য করা যায়। ভি পি সিং ও তার জনতা দল এর মণ্ডল তাস ও ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) র রাম মন্দির আন্দোলন – উভয়েরই উত্তাল সময় ছিল এটা। এই দুই পরিচিতি ভিত্তিক রাজনীতির ঢেউ কিছুদিনের জন্য কংগ্রেসকে দূরে রেখে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তা ভিন্ন দুই মেরুতে পৌঁছে যায় ও পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কংগ্রেস ভারতীয় রাজনীতিতে মণ্ডল ঢেউ ও মন্দির আন্দোলনের ঢেউ এর মোকাবিলা করতে চেয়েছে তার বদলে যাওয়া অর্থনৈতিক নীতির মধ্য দিয়ে। সোভিয়েত ধাঁচের সমাজ ব্যবস্থার পতন ও চিনের মোড় ফেরার পর্বে কংগ্রেস মিশ্র অর্থনীতি থেকে ক্রমশ সরে এসেছে মার্কিন মডেলের নব্য উদার অর্থনীতির দিকে এবং কর্পোরেট পুঁজি ও সংস্কৃতিকে আমদানির মধ্যে দিয়ে ভারতীয় সমাজ অর্থনীতিতে সে মৌলিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আর এস এস এর পুরনো ধরণের স্বদেশিয়ানাবাদকে সে নিজেই বিশ্বায়নের জমানায় সাগ্রহে বাতিল করে দিয়েছে এবং তার রাজনৈতিক মুখ বিজেপি কংগ্রেসের মতো একই ধরণের নব্য উদারপন্থী রাজনৈতিক অর্থনীতি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন রাজ্যে সক্রিয় থাকা সমাজবাদী আন্দোলন ও সামাজিক ন্যায় আন্দোলনের প্রতিভূ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি বিশেষ করে প্রশাসনিক ক্ষমতায় থাকার পর্বে এই বিশ্বায়ন/উদারীকরণের নীতিকেই কম বেশি এবং মূলত প্রতিরোধহীনভাবে গ্রহণ করেছে। এমনকী সরকারী ক্ষমতায় থাকা সি পি আই, সি পি এম এর মতো কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের রাজ্য সরকারগুলি প্রাথমিক পর্বে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর (১৯৯১-৯৪) তার সঙ্গে খানিকটা আপোষরফায় চলে আসে এবং একুশ শতকের প্রথম থেকে পশ্চিমবঙ্গের মতো তাদের সামাজিক রাজনৈতিক দুর্গে একে আগ্রাসীভাবে রূপায়ণ করতে এগোয়।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী কুড়ি বছরের পর্বটায় কোনও একক রাজনৈতিক দল আর কেন্দ্রীয়ভাবে ক্ষমতা দখল করতে পারে নি। পরিবর্তে জোট সরকারের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভারতীয় রাজনীতি অগ্রসর হয়। অর্থনৈতিক নীতিতে মোটামুটি একটা সাধারণ সামীপ্য রেখে সংরক্ষণ ও অন্যান্য সুবিধা লাভের জন্য সামাজিক বিভিন্ন শক্তির দরকষাকষি এই পর্বের ভারতীয় রাজনীতিতে এক বিশেষ তাৎপর্যে আত্মপ্রকাশ করেছে। বিভিন্ন সামাজিক বর্গের প্রতিনিধিত্বমূলক বিভিন্ন শক্তি এই সময় জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির নির্ধারক বা গুরূত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি হয়ে উঠেছে। মুসলিমদের সরাসরি ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে সংরক্ষণ দেওয়া সম্ভবপর হয় নি সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এর কারণে কিন্তু অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে (ওবিসি) তাদের একটা বড় অংশকেই স্থান করে দিয়েছে অনেক রাজ্য সরকার। মুসলিম সহ বিভিন্ন জাতি উপজাতি ও পশ্চাদপদ জাতিদের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের রাজনৈতিক শক্তিবিন্যাস নির্ধারণে বড় ভূমিকা রয়েছে। বিহারে যাদব, বিভিন্ন দলিত ও মহাদলিত অংশ এবং মুসলিমরা, উত্তরপ্রদেশে দলিত ও মুসলিমরা, কর্ণাটকে লিঙ্গায়েতরা, পাঞ্জাবে জাঠরা, রাজস্থানে জাঠ, গুর্জর ও রাজপুতরা নির্বাচনের ফলাফলকে বড়ভাবে প্রভাবিত করে থাকেন। তামিল অস্মিতাকে পেরিয়ে কংগ্রেস বা বিজেপির পক্ষে তামিলনাড়ুতে কোনও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেওয়া এখনো সম্ভবপর হয় নি, ডি এম কে বা এ আই ডি এম কে র মতো তামিল অস্মিতাভিত্তিক রাজনীতিই সেখানে পর্যায়ক্রমে প্রধান ও বিরোধি শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কেরালায় অবশ্য মুসলিম ও খ্রীষ্টান – দুই ধরণের সংখ্যালঘুদেরই রাজনৈতিক শক্তিবিন্যাসে ভালোরকম ভূমিকা আছে। সেখানে কংগ্রেস ও বামেদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে শাসক বিরোধী চরিত্রের অদল বদল আমরা দেখে আসছি।
স্বাধীনতার পরের বেশ কয়েকটি নির্বাচনে অন্যান্য অংশের সঙ্গে দলিত ভোটের সিংহভাগ কংগ্রেসের দিকেই গিয়েছিল। ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে এবং সত্তরের দশকের প্রথম দিকে এই ধারায় প্রথম একটা বদল আসে রিপাবলিকান পার্টি অব ইন্ডিয়ার হাত ধরে। ১৯৭৭ এর পর দলিত ভোট কংগ্রেস ও জনতা পার্টির (ও বিভাজনের পর বিভিন্ন জনতা দলের) মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। ক্রমশই দলিত ভোটের মূল দাবিদার হয়ে উঠতে থাকেন কাঁসিরাম, তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী মায়াবতী ও তাঁদের বহুজন সমাজ পার্টি (বি এস পি)। ২০০৪ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে বি এস পি একাই সমস্ত দলিত ভোটের প্রায় ২২ শতাংশ নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিল। ২০০৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের মোট প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে দলিত ভোটের অংশ যেখানে মোটামুটি ১৪ শতাংশ ও বিজেপির ১০ শতাংশ, সেখানে বি এস পির মোট প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে দলিত ভোট ৫২ শতাংশ, যা ২০০৪ এর নির্বাচনে ছিল ৬৫ শতাংশ। অবশ্য এটাও ঠিক উত্তরপ্রদেশের বাইরে দলিতরা খুব সংগবদ্ধভাবে বি এস পি কে ভোট দেন, নির্বাচনের ফল তেমন বলছে না। এটাও মনে রাখার বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের প্যাটার্ন যথেষ্ট বদলে যায়, কোনও দীর্ঘমেয়াদী সাধারণীকরণ করা মুসকিল হয়ে পড়ে। ২০১৪ র লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এর বিস্তারিত পরিসংখ্যান এখনো হাতে আসে নি, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে বিজেপি তার ব্যাপক উত্থানের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের অন্যান্য অংশের পাশাপাশি দলিত ভোটব্যাঙ্কেও ভালোরকম থাবা বসিয়েছে এবং বি এস পির ভোট প্রাপ্তির শতাংশমাত্রা কমিয়ে তাকে সংসদের নিম্নকক্ষে আসন শূন্য করে দিয়েছে।
[প্রথম পর্বের সমাপ্তি এখানেই। এটি বিস্তৃতভাবে লেখার পরিকল্পনা থাকায় কয়েকটি পর্বে লেখা জরুরী মনে হচ্ছে।]