প্রাচীন ভারত ইতিহাসচর্চার প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্ত্ব রামশরণ শর্মা [জন্ম – ২৬ নভেম্বর, ১৯১৯, মৃত্যু - ২০ অগষ্ট, ২০১১] চলে গেলেন ৯২ বছর বয়েসে। শিক্ষক ও ইতিহাসকার হিসেবে তাঁর অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষ্য রয়েছে তাঁর লেখা শতাধিক গ্রন্থে। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ইতিহাস এর অধ্যপনার পাশাপাশি তিনি পড়িয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়, টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় এর মতো প্রতিষ্ঠানে। ভারতীয় ইতিহাস রিসার্চ কাউন্সিলের তিনি ছিলেন প্রতিষ্টাতা চেয়ারম্যান। মার্কসীয় বীক্ষায় প্রাণিত হয়ে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনুসন্ধান ও রচনার যে ধারা ডি ডি কোসাম্বীর মত ঐতিহাসিক ‘ভারতীয় ইতিহাসচর্চার ভূমিকা’র মতো বইতে তৈরি করে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে ইরফান হাবিব, রোমিলা থাপার এর মতো রামশরণ শর্মার মত ইতিহাসবিদরা তাকেই আরো প্রসারিত করেছেন।
রামশরণ শর্মার লেখা বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল
• প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রতিষ্ঠান
• প্রাচীন ভারতে শূদ্র
• ভারতের প্রাচীন ইতিহাস
• আর্যদের সন্ধানে
• ভারতের সামন্ততন্ত্র
• আদি মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজ
• প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস
• ভারতে নগর অবক্ষয়
অন্তজ মানুষকে ইতিহাস অনুসন্ধানের কেন্দ্রে স্থাপন করে তাঁর লেখা ‘প্রাচীন ভারতে শূদ্র’(১৯৫৮) ইতিহাসচর্চায় একটি নতুন যুগের সূচনা করে। অন্যদিকে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজ বিশ্লেষণ করে তাঁর লেখালিখি ভারত ইতিহাসের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এর উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাসকেও তিনি সামনে এনেছেন। তাঁর যে মতটি নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে সেটি হল ভারতীয় সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও তার চরিত্র। ভারতে সামন্ততন্ত্রের সূচনা ড. শর্মার মতে মৌর্যত্তরকালে বিশেষত গুপ্তযুগে। তিনি সামন্ততন্ত্রের লক্ষণ বিচার করেছেন তিনটি আমল ধরে। বাংলা বিহারের পাল বংশ, গুর্জর-প্রতিহার এবং গুজরাটের রাষ্ট্রকূট শাখা। এই প্রসঙ্গে উঠেছে মোগল পূর্ব ভারতে জমিতে ব্যক্তিগত অধিকারের প্রসঙ্গ। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক সামন্ততন্ত্র ও তার অর্থব্যবস্থার উত্থান বিকাশ চরিত্র নিয়েও তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে আর্য সংক্রান্ত বিবাদের সময় বিশেষ যুক্তি ও তথ্য সহযোগে তিনি হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিকদের মতগুলি খণ্ডন করছেন। তারা বলার চেষ্টা করেছিলেন ভারতবর্ষই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। এর পেছনে ছিল বৈদিক ধর্মকে হিন্দু ধর্মের পূর্বসূরী ধরে নিয়ে তার মাহাত্ম্যপ্রচার ও সেই প্রচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা। এই ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে ‘লুকিং ফর দ্য এরিয়ানস’ (১৯৯৫) এবং তারপর ‘আর্যদের ভারতে আগমন’ (২০০১) বইতে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণের সাহায্যে সঠিক ইতিহাসকে সামনে এনেছেন। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে প্রতিহত করতে অযোধ্যা সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্যকে সামনে এনেছিলেন। বিষ্ণুস্মৃতি উদ্ধার করে তিনি দেখান সেখানে ৫২টি তীর্থস্থানের তালিকা থাকলেও তাতে অযোধ্যার কোনও উল্লেখ নেই। ১৫৭৪ এ তুলসীদাস তাঁর রামচরিতমানস এও অযোধ্যাকে তীর্থস্থান হিসেবে দেখান নি। ধর্মস্থান হিসেবে অযোধ্যার উত্থান অনেক পরবর্তীকালের ঘটনা। ভারত ইতিহাসচর্চায় তাঁর এক বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে ইরফান হাবিব সঠিকভাবেই বলেছেন, “ ড্যানিয়েল থর্ণার এবং ডি ডি কোশাম্বীর পাশাপাশি রামশরণ শর্মাই প্রথম ঐতিহাসিক হিসেবে কৃষককে ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় গুরুত্বে অধিষ্ঠিত করেছেন।” সাম্প্রদায়িকতা, সামন্ততান্ত্রিকতা, বর্ণব্যবস্থা জর্জরিত ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের কালো দিকগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর তথ্যমূলক ও আলোকসম্পাতি ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক কর্মীদের কাছে পাথেয় হয়ে থাকবে।