বলছিলাম 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি' এর কথা।আসেননি ভালই হয়েছে।আসলে না জানি কি না কি খেতে হতো!
হালের ওয়েব সিরিজ 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেনি' রিলিজ হওয়ার আগে থেকেই বেশ একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল।সেই সুযোগে রকমারি ডট কমও এই সিরিজের দুইটি বই বিক্রি করে বেশ মুনাফা লুটে নিচ্ছে।তো সিরিজটি রিলিজ হলো।নানা লোকের নানা মত আসতে থাকলো মিডিয়ায়।কেউ বলে জঘন্য হয়েছে,কেউ বলে বেশ ভালো। আমি বরবর মূল বই পড়তে বেশি আগ্রহী থাকি তাই রকমারির ডিসকাউন্ট এর ফাঁদে পা দিলাম।পর পর সিরিজের দুইটি বই শেষ করে ওয়েব সিরিজ দেখতে বসলাম।সব শেষ করে বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে তব্দা মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকলো না।ভাবছিলাম রিভিউ লিখি।মাঝে কয়দিন সময় পাইনি।আজ অলস দুপুরে ভাবছি রিভিউটা লিখেই ফেলা যাক।আগেই বলে দিচ্ছি অনেক স্পয়লার আছে।
প্রথমেই বলে নিই মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন এর লেখা রবীন্দ্রনাথ ট্রায়োলজির প্রথম বই বাতিঘর প্রকাশনী থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।বইটির নাম ছিল- রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি। পরেরটি ২০১৮ তে 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো আসেননি'।সিরিজের শেষ বই 'রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন' প্রকাশিত হওয়ার কথা আছে ২০২১ সালে।
নাজিমউদ্দীন সাহেবের বইগুলি স্টুডেন্ট লাইফে দেখতাম কিন্ত দামের কারনে ছুঁতে পারতাম না।তাই এটাই আমার প্রথম পড়া।ভদ্রলোক ভালই লেখেন।তবে বইগুলো পড়তে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে কিছু যেন মিসিং। অন্য বইগুলো পড়লে বুঝতে পারতাম এটাই তার স্টাইল নাকি এই পার্টিকুলার সিরিজএ এই সমস্যা।সেবার মৌলিক বা অনুবাদ বইগুলোতে যেমন জমজমাট ব্যাপার থাকে তা এই বইগুলোতে পেলাম না।সেবা প্রকাশনী সবসময়ই সেরা!
তো কাহিনীতে আসা যাক।কাহিনি জমাট বেঁধেছে মফস্বল শহরে অদ্ভুত নামের এক রেস্টুরেন্ট এবং তার রহস্যময়ী মালকিনকে ঘিরে।রেস্টুরেন্টের নাম- রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি। শুধু নামই নয় এখানকার খাবারগুলোও চমৎকার। মালকিন মুশকান জুবেরী এখানকার জমিদারের নাতবউ ও বর্তমান উত্তরাধিকারী। মুশকান একজন ডাক্তার। তিনি শুধু মালকিনই নন তিনি শেফও বটে।তার হাতেই তৈরি হয় চমৎকার এ খাবারগুলো যার স্বাদে মোহিত হয়ে এলাকা তো বটেই,দূর দূরান্ত থেকে লোক খেতে আসে।
নূরে সফা একজন ডিবি অফিসার যিনি সাংবাদিকের ছদ্দবেশে সুন্দরপুরে এসে অবস্থান নেন এবং ধীরেধীরে কাহিনির জট খুলতে থাকে।কাহিনিতে রহস্যময়তা আর টুইস্ট ভালই ছিল।তবে ছিলনা জমজমাট বর্ননা।আর কি যেখানে খুব ডিটেইলস বর্ণনা দেয়া দরকার সেখানে নেই কিন্ত আপাত তুচ্ছ জায়গায় বেশি বেশি বর্ণনা রয়েছে।যা বেশ বিরক্তি সৃষ্টি করেছে।যে খাবারের এত নামডাক তার বর্ণনা ভালো করে দেয়াই হয়নি।শেষ অব্দি জানা যায়না কেন খাবারগুলো এত স্পেশাল। এমনকি পরের বইটাতেও এই বিখ্যাত খাবারের বিষয়গুলো একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।আমার মনে হয়েছে লেখকের খাবার বিষয়ে জ্ঞান খুব কম আছে এবং তিনি ভোজন রসিক নন।সবটাই যখন বানানো গল্প তখন খাবারের বিষয়গুলো কি কল্পনা করা যেত না?হুমায়ুন আহমেদ তার লেখায় সিম্পল খাবারের যে বর্ণনা দিতেন বা রেসিপি দিতেন তাতে মুগ্ধ হয়ে ফলো করতে গিয়ে কতোবার যে বেকুব হয়েছে উৎসাহী পাঠক তা তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন।অন্যান্য বিখ্যাত লেখকেরা খাবারের বর্ণনা তার স্বাদের বর্ননা এমনভাবে করেন যাতে লেখার অক্ষর থেকে স্বাদ পাঠকের মস্তিষ্কের কোষে চলে যায়।এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ সিরিজ ফেইল।
এরপর আসি কাহিনির সবচেয়ে সেনসিটিভ অংশে।৭০ এর দিকে আন্দিজের প্লেনক্রাশের ঘটনা হয়ত অনেকেই জানে।এই ঘটনা নিয়ে বই আছে,মুভিও আছে।অনেক ছোটবেলায় টিভিতে একটা মুভি হচ্ছিল তার নাম ছিল 'এলাইভ'।বাবা দেখছিলেন তবে আমাকে দেখতে দেননি শুধু কিছু জিনিস বাদ দিয়ে গল্পটা শুনিয়েছিলেন ।একটু বড় হয়ে একটা বই হাতে পেলাম,নাম আন্দিজে বন্দী।সেবা প্রকাশনীর এই বইটি এখনো আমার সংগ্রহে আছে।আবিষ্কার করলাম গল্পটি সত্য ঘটনা নিয়ে নির্মিত এবং এই ঘটনা নিয়ে তৈরি মুভিটির নামই এলাইভ।ভয়ানক ঘটনা,ভয়ানক বই,ভয়ানক মুভি!
ক্যানিবালিজম এই জগতে নতুন নয়।অনেক জংলী মানব প্রজাতিই শুধু নয় সভ্য জগতেও এর প্র্যাক্টিস ছিল।প্যানাসিয়া বা সর্বরোগের ঔষধ হিসাবে মানুষের মমির গুড়া সমগ্র ইউরোপে ব্যবহার করা হতো।কবরচোররা শতশত মামিকৃত মৃতদেহ তুলে ইউরোপে বিক্রি করত।মিশর থেকে মমি সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে অসাধু ব্যবসায়ীরা তাজা মৃতদেহ প্রক্রিয়াজাত করে নকল মামিয়া(Mummia) তৈরি করে বিক্রি করত।আমার কাছে ক্যানিবালিজম একই সাথে গা শিউরে ওঠা এবং ঘিনঘিনে ব্যাপার।আন্দিজের বিরান পরিবেশে বেঁচে যাওয়া অভিযাত্রীরা তাদের মৃত সহযাত্রীদের খেয়ে বেঁচে ছিলেন ব্যাপারটা খুবই অমানবিক।মানুষ যখন এমন কিছু ঘটাতে বাধ্য হয় তখন দারুনভাবে মানবিক বিপর্যয় ঘটে।এই ঘটনাগুলো ভুলে যাওয়াই ভাল এবং ঘটনার শিকার লোকগুলোকে তা ভুলতে দেয়াই ভাল।এসব জিনিসের চর্চা এবং ছড়িয়ে পড়া মোটেও ভাল কিছু নিয়ে আসে না।রানা প্লাজার নিচে চাপা পড়ে জীবিত উদ্ধার পাওয়া মানুষের ব্যাপারেও এমন কথা রটেছিল।
রবীন্দ্রনাথ সিরিজের প্রথম বইটিতে আন্দিজের ঘটনার উল্লেখ আছে।বলা হয়েছে মুশকান সেই বেঁচে যাওয়া সহযাত্রীদের একজন।রহস্যময় কারনে তার বয়স বাড়েনি। কাহিনি যে বলা হয়েছে তাই না,আন্দিজের অরিজিনাল ছবি এডিট করে সেখানে মুসকানের ছবি বসিয়ে ছাপা হয়েছে বইয়ের পাতায়।আমি হতবাক হয়ে ভাবি লেখক কেন এটি করতে গেলেন!তিনি কি কোনো আইনি জটিলতায় পড়বেন না এই কারনে?হৃদয়বিদারক একটা ঘটনাকে নিয়ে এমন মনগড়া কাহিনি লেখাই তো যথেষ্ট অবিবেচনার কাজ।কল্পিত লেখাকে সত্যি প্রমাণিত করার জন্য এভিডেন্স টেম্পারিং করার দরকার কি ছিল?
২য় বইয়ে অর্ধেক খালি আজেবাজে আলোচনা।তারপর আসল কাহিনি আর টুইস্টের পর টুইস্ট।প্রথমে বলা হলো মুশকান মানব দেহের কোনো একটা অঙ্গ কয়েকবার খাওয়ার পর লক্ষ্য করে তার বয়েস বাড়ছে না।পরে সে এডিক্টেড হয়ে যায়।তাই আসল বয়স ৭০ এর ঘরে হলেও তাকে দেখতে লাগে তরুণীর মতো।রেস্টুরেন্ট দেয়ার পর প্রায় পাঁচজন এদিকে খেতে আসার পর নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই নিখোঁজের লিস্টে উচ্চপদস্থ লোকের ভাগনে আছে বলেই এব্যাপারে তদন্ত করতে আসেন ডিবি অফিসার নূরে ছফা।তারপর বলা হয় এই মুশকান আসলে আন্দিজের আসল মুশকানের মেয়ে। বয়স না বাড়ার কাহিনি ভুয়া।তারপর আবার বলা হয় আসলে ঘটনা সত্য।ঘটনা যে সত্য শুধু তাই না,মুসকানের সাথে মানব অঙ্গ খাওয়ার দোসর আরো কয়েকজন আছে।যাইহোক ২য় পর্বে কাহিনি কোলকাতা ঘুরে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে,শেষ হয়েছে খুলনায় রবীন্দ্রনাথের আদিবাড়িতে।আমার বিশ্বাস শেষ পর্ব কুষ্টিয়া ঘুরে আবার কোলকাতায় ফিরবে।
যাইহোক প্রথম বইটি তুলনামূলক ভালো।সেখানে মুশকানকে রহস্যের মধ্যে রেখেই কাহিনি শেষ করা হয়েছে।২য় বইয়ে মুশকান গা শিউরে ওঠা সব কাজকর্ম করে।তাকে লোভী আর ভয়ংকর হিসাবে দেখানো হয়েছে।শেষ বইটি না আসলে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা বোঝা যাবে না।এক্ষেত্রে লেখক রহস্য তৈরীতে সাকসেসফুল।
এবার আসি জনাব সৃজিতের তৈরি ওয়েব সিরিজে।এত বড় নাম নেয়া কঠিন তাই নেটিজেনরা এটির নাম সংক্ষেপে রেখেছেন 'রেক্কা'।বইটিতে বর্ণনা ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও যে স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে জনাব সৃজিত তার গুষ্টি উদ্ধার করে ছেড়েছেন।পুরো সিরিজেই রাতের দৃশ্যগুলো ঘোলা,রেস্টুরেন্টটির সেটাপ জঘন্য। হলদে আলোয় কিছুই ভালো করে দেখা যায় না।এই গুরুত্বপূর্ণ সেটগুলো এত অযত্ন করে বানানো হয়েছে যে শুরুর দিকে চরম বিরক্ত আর তাজ্জব হয়ে ছিলাম।তবে শকড হওয়ার আরো কিছু বাকি ছিল।জনাব সৃজিত আন্দিজের দৃশ্যগুলি এত দীর্ঘ আর বর্ণনামূলক করেছেন যা বইতেও ছিলনা।কয়েকজন মিলে মৃতদেহের পাঁজর কামড়াচ্ছে,নাড়িভুড়ি টেনে বের করে খাচ্ছে এমন সব দৃশ্য তিনি দেখিয়েছেন সিরিজে। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন আমিষ নামক অসমীয়া ছবিটির মত কিছু একটা তৈরি করে ফেলবেন।তিনি এটা বোঝেননি যে বইটির সেই প্লটই নেই যা এটিকে আমিষের মত উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পারে।আমিষ দেখে আপনার ভাল লাগবে না,চিন্তা জগৎ ভীষন নাড়া খাবে আবার এটিকে আপনি পুরোপুরি খারাপ বলতেও দ্বিধা করবেন।
রঙ টার্ন নামক একটি ভয়ানক মুভি সিরিজ আছে।আমার বিশ্বাস এই টাইপ কন্টেন্ট খুব অল্প লোকই পছন্দ করে।সৃজিতের তৈরি দৃশ্যগুলো সেই টাইপ ফিল দিয়েছে।আমার মনে হয় এলাইভ,আন্দিজে বন্দী বা অন্যকিছু নিয়ে উনি সিরিজ তৈরির আগে স্টাডি করেন নি।করলে বুঝতে পারতেন আন্দিজের ঘটনা পিকনিক ছিলনা,নিতান্ত বাধ্যতামূলক ছিল।
এরপর আসি কাস্টিং এর কথায়।একমাত্র আতর আলিই এখানে ভাল অভিনয় করেছেন।রাহুল বোস সিটকে লাগা মমির মত মুখ করে এমন অভিনয় করলেন যাতে মনে হলো সৃজিত তার বউবাচ্চা কিডন্যাপ করে ব্ল্যাকমেইল এর মাধ্যমে অভিনয় করাচ্ছেন।মূল চরিত্রের কথা বলতে গেলে তো কান্না আসে।বাঁধন প্রমাণ করেছেন তিনি অভিনেত্রী নন।তিনি আরও প্রমাণ করেছেন চরিত্রের ভেতরে ঢোকা ব্যাপারটি তিনি মোটেও বোঝেন না এবং যেকোনো ভাল চরিত্রের বারোটা বাজানোর জন্য তাকে কাস্টিং করাই যথেষ্ট। মুশকানের ধীরস্থির,ম্যাচিউর, কনফিডেন্ট,ট্যালেন্ডেট,সুন্দরী কিন্ত ভয়ংকর চরিত্রটির সাথে তিনি একেবারেই জাস্টিস করেননি।তার আচরণ কখনো টিন এজার আবার কখনো স্লাট টাইপ!তার খোলামেলা প্রায় ব্লাউজহীন সাজগোজও ভাল লাগেনি।মেয়েরা যে কাপড়চোপড় পড়েও সুন্দর হতে পারে সেটি বোধহয় তিনি এবং পরিচালক দুজনেই বিশ্বাস করেন না।এছাড়াও প্রথম বইয়ে এবং সিরিজে শেষের দৃশ্যগুলো খুব জরুরি সেখানে তার অভিনয় দেখে মনে হচ্ছিল হয় সবাই খুব আন্ডার পেইড নয়ত পরিচালক সাহেব সেটে উপস্থিত ছিলেন না।আমার কাজিন অবশ্য ভিন্ন থিওরি দিয়েছে।তার ধারণা তখন সেটে মিথিলা আপা উপস্থিত ছিলেন তাই এই অবস্থা।
রবীন্দ্রনাথের সাথে মানুষখেকো ডাইনীর ব্যাপারটি একেবারেই খাপ খায়না।তবুও লেখক প্যাচ ঘোচ দিয়ে ব্যাপারটি লিখেছেন।পরিচালক সাহেব মনেহয় তা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন।কারন পুরো সিরিজে একটু পরপর রবীন্দ্রসংগীত। গান আর আন্দিজের কাহিনি দিয়েই বেশিরভাগ শেষ হয়েছে।এসব না করে যদি মূল কাহিনী, রেস্টুরেন্ট আর মুশকানের অভিনয়ে জোর দেয়া হতো তবে সিরিজটা মন্দ হতো না।আমার রেটিং ২/১০
ভাব দেখে মনে হচ্ছে অনেকেই বাঙালিদের ক্যানিবালিজম এর সাথে ভাল করে পরিচিত করে দিতে চাইছে।আমি ভেবে পাইনা এর দরকারটা কি।এমন আনইথিকাল নেগেটিভ জিনিস ছড়িয়ে আদৌও কি লাভ আছে?ক্রিমিনাল,বিকৃতমনা, পাগল ছাগল কি দেশে কিছু কম আছে?আন্দিজের বেঁচে যাওয়া অভিযাত্রীরা এমনিতেই অনেক কষ্ট পেয়েছে।বেঁচে ফিরলেও তারা সামাজিকভাবে হেও হয়েছেন,জীবন কেটেছে দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে।লেখক নাজিমউদ্দীন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে উনি কি কাহিনিটা এই প্লটকে না জড়িয়ে লিখতে পারতেন না?তিনি যদি সেভাবে লিখতেন তাহলে থ্রিলারটি আমার কাছে আরও উপভোগ্য হতো।
ছবিঃইন্টারনেট