অন্যদের কাছে কি মনেহয় আমি জানিনা কিন্ত আমার কাছে মনেহয় ঢাকা শহরে যে জিনিসটা সবচেয়ে বড় চার্ম সেটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।আর সেটা হলো অগনিত মানুষের ভীড়।একা একা পথ চললেও আপনি কখনো একা নন।নানা শ্রেণীর মানুষ দেখবেন আপনার আসেপাশে যারা আপনাকে সঙ্গ দেবে।একাকিত্বের চেয়ে এই ভীড়টা কিন্ত অনেক ভালো।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতেও অনেক মানুষ ছিল।একেক বসতবাড়িতে উঠান ঘিরে শরীকদের ঘর।সেইসব ঘর ভর্তি ছেলে মেয়ে।নানা বয়স তাদের,বিচিত্র তাদের স্বভাব।এবাড়ি ওবাড়ি মিলে সমবয়েসী একঝাঁক ছেলে মেয়ে।তারা একে অন্যের ভাইবোন,একে অন্যের খেলার সাথী,বন্ধু।
আমার বাবাদের একটা গ্রুপ ছিল,চাচাদেরও,ফুপুদেরও,আমাদের চেয়ে কিছুটা বড় যারা তাদেরও, ছোটদেরও,আমাদেরও।যদিও আমার বয়েসীদের সাথে মেশার সুযোগ হাইস্কুলে উঠার আগে খুব একটা হয়নি।কারন একদম ছোট বেলায় আমাকে বাড়ির বাইরে খুব একটা মিশতে দেয়া হতো না।আমি তখন পড়তাম শহরের স্কুলে তাই সময় পেতাম কম।আমার বয়েসী কেউ ছিলনা আমাদের বাড়িতে।দুই বছরের ছোট দুইটা চাচাতো ভাই ছিল।ওরাই ছিল আমার খেলার সাথী। ওদের সাথে নিজেদের আঙিনায় খেলতাম,মাঠেঘাটে যেতাম।মাঝেমধ্যে এবাড়ি ওবাড়িতে ঘুরেফিরে বেড়াতাম।তবে একা একা কখনোই না।সাথে ছায়ার মত থাকত সেই দুই ভাই।
এইযে পিঠাপিঠি ভাইবোনের দল- এরা একই সাথে পড়ার সাথি,খেলার সাথি আর বন্ধু।বাড়িতে কর্মঠ যুবক ছেলে আছে মানেই আছে তার নতুন বউ।সেই বউ এই নানা বয়েসি দেবর ননদের প্রধান আকর্ষণ। সারাক্ষণ তারা তাকে ঘিরে থাকে,ফাইফরমাশ খাটে সঙ্গ দেয়।আমাদের বাড়িতে মায়ের সাথে অন্য চাচিদের বন্ধুর মত সম্পর্ক। সবাই কম বয়সে বউ হয়ে এবাড়িতে এসেছে।শাশুড়িকে লুকিয়ে করা কত এডভেঞ্চার আর উদ্ভট কর্মের সাক্ষী তারা একে অপরের।তারা গল্প করতে বসলে প্রায়ই উঠে আসে সে স্মৃতিচারন।
আমার নিজের মাত্র একজন ফুপু।তার বিয়ে হয়েছে অনেক দূরে।তাই মা আর চাচিরাই ছিলেন এবাড়ির সৌন্দর্য। সামনের বাসাতেও কিছু ফুপু- চাচি ছিলেন।তবে ছোট বেলায় আমাকে যেটা খুব আকর্ষণ করত সেটা হচ্ছে পাশের বাড়ির মেয়েরা।প্রায় এক বয়েসের অনেকগুলো মেয়ে ছিল পাশের বাড়িতে তাদের কেউ ছিল সম্পর্কে আমার বোন বা ফুপু,কেউ ছিল চাচি।কি সুন্দর তাদের গড়ন,কি লম্বা লম্বা চুল!শান বাধানো পুকুরঘাটে তারা গোসল করতে আসলে চারিদিক তাদের কোলাহলে মুখরিত হয়ে থাকত।বিকেলে তারা পুকুরপাড়ে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে গল্প করত।আমাদের বাড়ি থেকে সরাসরি তাদের পুকুর দেখা যেত।আমার মনে হতো এক ঝাঁক পরী বুঝি নেমে এসেছে।কাছাকাছি বয়েসের এক ঝাঁক মেয়ে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই দৃশ্যের মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে তা ভাষায় পুরোপুরি প্রকাশ করা যায় না।সাঁতার সেখার পর অনেকদিন তাদের পুকুরের গোসলে যেতাম। তাদের সাথে গোসল করতাম।মনে মনে ভাবতাম ইশ! আমাদের বাড়িতেও যদি এমন এক ঝাঁক মেয়ে থাকত!
বাড়ি ভর্তি আরো ছিল রাখাল, কাজের মেয়ে, কৃষিকাজের দিন মজুর।এত লোকের রান্না হবে তার জোগাড়যন্ত্র করতে হয় সকাল থেকেই,মেয়ে বউ রা হাত লাগায়।কাজের মহিলা বড় পাটায় মসলা বাঁটতে বসে। গৃহিণী (দাদি) রান্না বসান।মোটা চালের ভাত হয়,সাথে ভাজি বা ভর্তা আর ডাল।এই খেয়েই সবার দিন শুরু হয়।রুটি খাওয়ার চল তখন গ্রাম দেশে ছিলনা।রুটি হলো গরীবের খাদ্য।যার ঘরে ভাত নেই,অভাব অনটন তারাই রুটি খায়--এই ছিল গ্রামের লোকের ভাবনা।মাঠে খাটা লোকের দু চারটি রুটিতে পোষায়ও না।পেট ভরতে হলে দশ বারোটা রুটি খেতে হবে।কে পোহাবে এত ঝামেলা?তাই তিন বেলা ভাতই ছিল তখনকার মানুষের খাদ্য।সকালের রান্না শেষ হলে দুপুরের জন্য মাছের তরকারি রান্না হতো।সকাল আর দুপুরের রান্না একসাথেই করা হতো।রাতের রান্না হতো বিকালে।
দুপুর হলেই পুকুরপাড়ে সবাই গোছলের জন্যে ভীড় জমাতো।এবাড়ি ওবাড়ির মা,চাচিরা একে অন্যের সাথে গল্প করতে করতে হেসে কুটি কুটি হতো।আমরা ভয়ে ভয়ে মায়ের আঁচল ধরে থাকতাম।সাঁতার সেখার পর অবশ্য নিজেই দাপাদাপি করে গোসল করতাম। বাবা চাচারা বাইরে থেকে ফিরে গোসল করে পরিপাটি হয়ে খেতে বসত।দাদি কাঁসার থালায় ধোঁয়া ওঠা ভাত তরকারি বেড়ে দিতেন।বাবাদের খাওয়া হলে মায়ের সাথে আমাদের খাওয়া।তার পর নিঝুম দুপুরের অবসর।সবাই একটু ঘুমিয়ে নিত এই সময়।বিকাল হলেই দৌড়ে বের হয়ে যেত সবাই খেলার জন্য।আমাদের বাড়ির ফুপুরা বয়েসে বড়।তাদের বিয়ে হয়েছে আমার জন্মেরও আগে।তাই আমাদের বাড়িতে মেয়ে কম ছিল।সামনের বাসায় ছিল দুই ফুপু আর আমাদের তাদের মিলিয়ে কিছু চাচি।বিকেলে তারাও বের হতো এদিক ওদিক।সব বাসার উঠানে,খোলা বাড়িতে,পুকুরপাড়ে নানা দলের মানুষ দেখা যেত।বিকাল হলে বাবা চাচারা সাজুগুজু করে ফিটফাট হয়ে বাজারে যেত আড্ডা দিতে।সেখানে চা সিঙ্গারার দোকানে জমজমাট আড্ডা বসতো।সন্ধ্যার আগেই গৃহিণী রাতের খাবার রেঁধে ফেলতেন।তারপর হাঁসমুরগি খোপে তোলা,শুকনো কাপড়চোপড় ঘরে তোলা ইত্যাদি নিত্যকার কাজগুলো সেরে ফেলতো মেয়ে বউরা হাতে হাতে।রাখাল গরুগুলোকে গোয়ালে তুলে দিত।বাচ্চারা ফিরলে মায়েরা তাদের ধুয়েমুছে ঘরে তুলতেন।কাজের মেয়ে হ্যারিকেন গুলো মুছে চকচকে করে তুলত।এরপর নেমে আসত সন্ধ্যা।ঝিরিঝিরি বাতাস বইত,ঝিঁঝিঁ ডাকতো, জোনাকি ফুটতে শুরু করত একটি দুটি করে।
সন্ধ্যা নামলে এবাসা ওবাসা থেকে শব্দ করে পড়ার আওয়াজ ভেসে আসত।ইলেক্ট্রিসিটি তখন কেবল এসেছে গ্রামে।সব বাসায় কানেকশন নেই।আবার যেসব বাসায় আছে সেখানেও কারেন্ট মাঝে মাঝে আসে।প্রতি সন্ধ্যায় লোডশেডিং তো মাস্ট।অতএব হ্যারিকেন আর কুপি বাতিই ভরসা।কেউ কেউ মোম জ্বালতো।মা আমাকে পড়তে বসাতেন।তবে লোডশেডিং হলেই বাইরে বের হয়ে যেতাম।আমার চাচাতো ভাইবোন গুলোও বেরিয়ে আসত উঠানে।আমরা কখনো চাঁদের আলোয় কখনো তারাভরা আকাশের নিচে উঠোনে ছুটাছুটি করে খেলতাম। এবাসা ও বাসা থেকে ফুপু আর চাচিরা বের হয়ে আসতেন গল্প করতে।কখনো অনেকে দল বেঁধে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াতেন,আমরাও তাদের পিছু নিতাম।দাদা দাদী উঠানে পাটি বা জলচৌকি পেতে বসতেন। চারিদিকে উৎসবের মত লাগত।একটু রাত হলেই বাবা চাচারা বাড়ি ফিরত।তখন শুরু হতো রাতের খাওয়া।
রাতের খাওয়া শেষ হলে যাদের পরীক্ষা তারা পড়তে বসত।বেশিরভাগ বাড়িতেই রাত্রি ১০ টার পরে আর কাওকে জাগা পাওয়া যেত না।আমার বাবা-মা আরোও অনেক রাত জাগতেন।বই পড়তেন বা রেডিও শুনতেন।টিভি কেনার পর দুজনে মিলে রাত জেগে টিভি দেখতেন।সেই টিভির গল্প অন্য কোনোদিন করবো।
তখন বাড়ি ভর্তি লোকজন ছিল।আয় বলে ডাক দিলে এখন ওঘর থেকে দশজন জোয়ান ছেলে বের হয়ে আসত।সাধ্য কার কেউ কোনো ক্ষতি করে?উঠানে, পুকুরপাড়ে,ঘরে ঘরে যুবতী -তরুণী মেয়ে বউ।কোনো কাজ করতে হবে?বাচ্চা দেখতে হবে? পিঠা বানানো, রান্নাবান্না? অনেকগুলো কোমল হাত এসে যুক্ত হতো কাজে।উৎসব পার্বণ না,সবসময়ই যেন উৎসব ছিল বাড়িগুলোর ভেতরে বাহিরে।
মাত্র বিশ পঁচিশ বছরের ব্যবধান।বয়স্করা খোদার ডাকে সাড়া দিয়েছেন।ছেলেরা পড়ালেখা আর চাকরির খোঁজে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচে কানাচে।মেয়েরা বিয়ে করে এলাকা ছেড়েছে প্রায় সবাই।জোয়ান ছেলেরা এখন মাঝবয়েসী বা পৌঢ়,তন্বী তরুনীরা অনেকে দাদি নানি হয়েছেন।আমরা বাচ্চারা প্রায় সবাই ত্রিশ পার করেছি,তারচেয়ে ছোটরাও ত্রিশ ছুঁই ছুঁই করছে।কেওই আর এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নই।বড় বড় দালান উঠেছে অনেক কিন্ত তাতে মানুষ নেই বললেই চলে।ঈদে পরবে,বিয়েশাদি বা শোকের সময় যখন সবাই একত্রিত হয় তখন বাড়িগুলো আবার হেসে ওঠে।কিন্ত সে তো শুধু অল্প কদিনের ব্যাপার।একে একে সবাই আপন ঠিকানায় চলে যেতে থাকলে আবার ফাঁকা হয়ে যায়।আমার মনে হয় সেই দালান, উঠান আর পুকুরপাড় অধির হয়ে অপেক্ষা করে নতুন কোনো উৎসবের,যেমন করে অপেক্ষা করে গ্রামের বাড়িগুলোতে থেকে যাওয়া হাতে গোনা মানুষগুলো।