বিশাল এই উদ্ভিদ জগত।এর ব্যাপ্তি পুরো পৃথিবী জুড়ে!কি বিপুল তার বৈচিত্র!কি অপার এর রহস্য!রঙ,রূপে,রসে,সৌরভে,বৈচিত্রে আর রহস্যে উদ্ভিদ জগত সাজিয়ে রেখেছে আমাদের প্রিয় গ্রহটিকে।মিটিয়েছে আমাদের সকল প্রয়োজন সেইসাথে খুলে বসেছে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের ডালি।উদ্ভিদজগতের এক বৈচিত্রময় সদস্য হচ্ছে পতঙ্গভুক উদ্ভিদ।আমরা অনেকেই পতঙ্গভুক উদ্ভিদ এর কথা শুনেছি বা ছবি দেখেছি।আমার এই পোস্টে আমি জানানোর চেষ্টা করবো এইসব বিচিত্র উদ্ভিদ নিয়ে বিস্ময়কর সব তথ্য।
আমরা ছোট থেকেই জেনে আসছি প্রাণী ও উদ্ভিদের মাঝে একটা মূল পার্থক্য হচ্ছে যে উদ্ভিদ চলাচল করতে পারেনা।এই তথ্যটি সাধারন ভাবে ঠিক হলেও ধ্রুব সত্য নয়।কিছু কিছু উদ্ভিদের সীমিত ধরনের চলাচল বা অঙ্গসঞ্চালনের সুযোগ রয়েছে।পতঙ্গভুক উদ্ভিদ হচ্ছে তার উত্তম উদাহরন।এই গোত্রের উদ্ভিদ তার দেহের একটি অংশের সঞ্চালনের মাধ্যমে শিকার করে।আর এসব গাছের শিকারে পরিনত হয় বিভিন্ন পোকামাকড়,ছোট ছোট প্রাণী যেমন ব্যাঙ এমনকি ছোট পাখিও!!!
এখন আসি কেন এসব গাছ শিকার করে এই প্রশ্নে।অবশ্যই তাদের খাদ্যের প্রয়োজনেই তারা এমন কাজ করতে বাধ্য হয়।সবাই অবাক হয়ে ভাববেন আমরা না জেনে আসছি উদ্ভিদ নিজের খাদ্য নিজে তৈরী করতে পারে? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ পারেই তো।পতঙ্গভুক উদ্ভিদ ও তার দেহের সবুজ অংশ দিয়ে সালোকসংশ্লেষন করে খাদ্য তৈরী করতে পারে।কিন্ত তাতে তার সব প্রয়োজন মেটেনা।কারন এই প্রক্রিয়ায় তৈরী হয় গ্লুকোজ যা শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য।উদ্ভিদের বেঁচে থাকার জন্য মোট ১৬টি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান প্রয়োজন।তার মধ্য অন্যতম হচ্ছে নাইট্রোজেন।শর্করা থেকে কার্বন,অক্সিজেন আর হাইড্রোজেন তো পাওয়া গেল আর বাঁকিগুলো উদ্ভিদ মূলের সাহায্যে মাটি থেকে সংগ্রহ করে।কিন্ত মাটি যদি এমন হয় যাতে নাইট্রোজেনের অভাব তবে উদ্ভিদের জন্য শিকারের মত বিচিত্র উপায় বেছে নেয়া ছাড়া উপায় থাকেনা।
সবাই হয়ত ভাবছেন একটা জিনিস না থাকলে কি আর এমন ক্ষতি হয় যার জন্য উদ্ভিদের মত নিরীহ জীবের প্রাণী শিকারের মত স্পর্ধা করা প্রয়োজন হলো?আমরা তো চিনির অভাব গুড় দিয়ে মিটিয়ে ফেলি।আসলে জীবকোষের প্রোটোপ্লাজমের অন্যতম গঠন উপাদান হচ্ছে প্রোটিন।আর প্রোটিন অনুর গঠনের জন্য নাইট্রোজেন না হলে চলে না।তাই যদি নাইট্রোজেন না পাওয়া যায় তবে উদ্ভিদটির জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে।তাই নাইট্রোজেন সংগ্রহের বিচিত্র উপায় বেছে নিয়েছে কিছু কিছু উদ্ভিদ।পোকামাকড় বা প্রাণীর দেহে প্রচুর প্রোটিন থাকে।প্রোটিন মানেই নাইট্রোজেন তাই এগুলো ধরে খেয়ে হজম করে তা থেকে প্রয়োজন মত নাইট্রোজেন সংগ্রহ এই শ্রেনীর উদ্ভিদ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে উদ্ভিদ কিভাবে এমন অভুতপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী হল।আসলে এই ক্ষমতা তাদের অনেক চেষ্টা করে অর্জন করতে হয়েছে।সব জীবই টিকে থাকতে চায়।আর প্রতিনিয়ত বদলানো পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে টিকে থাকা সম্ভব হয় না।তাই পরিবেশের সাথে মিলিয়ে তাদের নিজেদের দেহে এমন পরিবর্তন আনতে হয় যাতে তারা সফল ভাবে নতুন পরিবেশে টিকে থাকতে পারে।একে বলা হয় এডাপটেশন বা অভিযোজন।ধারনা করা হয় নাইট্রোজেন এর ঘাটতি আছে এমন মাটিতে সাধারন উদ্ভিদই অভিযোজিত হয়ে এমন বিস্ময়কর ক্ষমতা অর্জন করেছে।বর্তমান পৃথিবীতেও এসব উদ্ভিদ এমন সব স্থানে জন্মে যেখানে রয়েছে পুষ্টি উপাদান বিশেষত নাইট্রোজেন এর ঘাটতি।এই প্রসঙ্গে একটি রূপকথা রচনা করে ফেলি যেটা উদ্ভিদের এমন অভিযোজন ব্যাখ্যা করতে পারবে।
অনেক অনেক কাল আগে একটা বন ছিল যেখানে ছিল অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ।হঠাত করে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারনে সেখানের মাটির গুনাগুনও পরিবর্তিত হয়ে গেল এবং দেখা দিল নাইট্রজেনের ঘাটতি।তখন যত দিন যেতে লাগল ততই গাছগুলো মরে যেতে লাগল।একধরনের গাছের সহ্যক্ষমতা ছিল বেশী ফলে তারা বেশী দিন টিকে গেল।তারপর একসময় তারাও মরে যেতে লাগল।এর মাঝে দুই একটা সদস্য এমন ছিল যারা টিকে থাকার জন্য তাদের অন্তর্গঠনে কিছু অভুতপূর্ব পরিবর্তন নিয়ে আসল।যার ফলে তারা বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে পতঙ্গ ধরে খাওয়া এবং তার মাধ্যমে পুষ্টি সংগ্রহের বিষয়টি আয়ত্ত করে ফেলল।আর এই পদ্ধতিই তাদের বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করল।যুগে যুগে কালে কালে এমনি সব ঘঠনার মাধ্যমে সৃষ্টি হল বিস্ময়কর এক উদ্ভিদ গোত্রের যার অনেকেই হারিয়ে গেছে কালের স্রোতে আবার অনেকেই হয়েছে আরো অভিযোজিত আর টিকে আছে এখনও।এই অভিযোজনের চেষ্টা এবং তার মাধ্যমে বিবর্তন কিন্ত একদিনের ফসল নয়। প্রকৃতির অনেক দিনের সুচারু সাধনার ফলেই এমন ব্যাতিক্রমী উদ্ভিদের সৃষ্টি হয়েছে।
চার্লস ডারউইন তার জীবনে পতঙ্গভুক উদ্ভিদ নিয়ে বেশ গবেষনা করেছেন এমনকি বই ও লিখে গেছেন।তিনি দেখেছেন এইসব উদ্ভিদের অবাক করা একধরনের সেন্স রয়েছে।তারা যখন ফাঁদ পাতে তখন সেখানে যদি জোর বাতাস,পানির ঝাপটা, কাঁচ,চুলের সুরসুরি ইত্যাদি দেয়া হয় তবে তারা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না।শুধু মাত্র প্রানীর নড়চড়া বা উপস্থিতিই তাদের সচল করে তোলে।অর্থাত তারা জীব এবং জড় বস্তুর পার্থক্য বোঝে!!!এবং এটাও বোঝে কি তারা খেতে পারবে আর কি পারবে না।তাই অন্যসব জিনিসের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে খালি খালি নিজের শক্তি ক্ষয় করে না।তিনি আরো দেখেন যে এসব উদ্ভিদ বেশিরভাগই হচ্ছে বিরুত জাতীয় অর্থাৎ নরম কান্ডযুক্ত উদ্ভিদ এবং সাধারনত এদের পাতা নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে ফাঁদ তৈরী ও হজমের কাজ করে।এদের রুট সিস্টেম অর্থাৎ মুলতন্ত্র খুবই দুর্বল হয় তাই তারা পুষ্টির খোঁজে মাটির গভীরে যেতে পারেনা।এসব উদ্ভিদ্এর গ্রন্থিগুলো সামান্য চাপ এবং সেই সাথে সঠিক ধরনের নাইট্রোজেন যুক্ত জিনিসের উপস্থিতির প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল।তারা ভুল প্রায় করেই না।অর্থাৎ বৃষ্টিপাত বা কোনো গাছের পাতার স্পর্শে বিচলিত হয় না।তিনি আরও দেখেন এসব উদ্ভিদের আছে হজমের জন্য কিছু নির্দিষ্ট এনজাইম যেগুলো প্রায় প্রানীর প্রোটিন পরিপাকের এনজাইমের মত।হজমের পর গাছগুলো দেহের কোষ দিয়ে পুষ্টি উপাদান শোষন করে নেয়।
তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৬৩০ প্রজাতির মাংশাসী উদ্ভিদ আছে সেই সাথে রয়েছে প্রায় ৩০০ প্রজাতির প্যারাকারনিভোরাস(এরা আঠার সাহায্যে পতঙ্গ ধরলেও হজম করতে পারেনা উপযুক্ত অঙ্গের অভাবে।ধারনা করা হয় এরা পুরোপুরি মাংশাসী হওয়ার পথে বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে) উদ্ভিদ পাওয়া যায়।এদের গঠনও বিচিত্র।কারো আছে কলসের মত ফাঁদ,কারো আছে দাঁতযুক্ত চোয়ালের মত ফাঁদ,কারো আছে আগায় আঠা যুক্ত রোম।তবে এদের একটা বৈশিষ্ট লক্ষ্যনীয় যে এদের সকলেরই রঙ বেশ আকর্ষনীয় এবং উজ্জল।কোনোটার আছে মিষ্টি গন্ধের মধু।অর্থাত শিকারকে আকৃষ্ট করার মত সব উপাদানই তাদের রয়েছে।
কলস উদ্ভিদঃ
পিচার প্লান্ট একটা সাধারন নাম সেসব উদ্ভিদের জন্য যেগুলো কলসের মত আকৃতি তৈরী করে।ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির অনেক রকমের গাছ এর অন্তর্ভুক্ত।ছোটবড় নানা বর্নের কলস আকারের অঙ্গ তাদের রয়েছে।যার তলদেশে থাকে মিষ্টি মধু।এই মধুর লোভেই কোনো পোকা বা পিপড়া কলসে প্রবেশ করলে অমনি কলস বন্ধ হয়ে যায় উপরের ঢাকনার মত জিনিস মুড়ে গিয়ে।তারপর আর কি?মনের সুখে হজম এবং পুষ্টি সংগ্রহ চলতে থাকে।কাজ শেষে কলসের মুখ আবার খুলে যায় নতুন শিকারের আশায়।ধারনা করা হয় পাতার দুইপ্রান্ত রোল হয়ে প্রথম এই কলস সৃষ্টি হয়েছিল।
পিচার প্লান্ট
নিচের ছবি একটা বিশেষ কলস উদ্ভিদের যার নাম কোব্রা লিলি।দেখতে ফনা তোলা সাপের মতই হয় এরা।
ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপঃ
ভারী সুন্দর দেখতে এই গাছ।অনেক্টা ঝিনুকের খোলের মত পাতা থাকে যার কিনারে থাকে অসংখ্য কাঁটার মত জিনিস।এর ভেতরের দিকটা টুকটুকে লাল।যেই কোনো পতঙ্গ পাতার মধ্যে আসে সেখানে থাকা ট্রিগার রোমের মাধ্যমে সঙ্কেত চলে যায় আর মুহূর্তের মাঝে পাতার মধ্যে থেকে ভাঁজ হয়ে পাতা বন্ধ হয়ে যায়।শিকার হজম হওয়ার আগে আর তা খোলে না।এই যে মুহুর্তের মাঝে খপ করে শিকার ধরাকে বলে স্ন্যাপ ট্র্যাপ।মাত্র দুই ধরনের উদ্ভিদের এই জিনিস আছে যার একটি ফ্লাই ট্র্যাপ আর অন্যটি একটা জলজ উদ্ভিদ নাম এলড্রোভান্ডা।
ভেনাস ফ্লাই ট্র্যাপ
এলড্রোভান্ডা
সুর্যশিশিরঃ
সুর্যশিশির,সানডিউ বা ড্রসেরা হচ্ছে সরু সরু আঠালো রোমযুক্ত উদ্ভিদ।রোমের আগায় শিশিরের মত আঠা থাকে।এই রোমে পোকা আটকে পড়লে তা ধীরে ধীরে শোষিত হয় উদ্ভিদ দেহে।কখনো এরা একটু রোল হয়ে পোকাকে ভাল করে আটকে নেয়।
এধরনের আর একটি উদাহরন হচ্ছে বাটারওয়ার্ট।এদের পাতায় আঠালো মিউসিলেজ থাকে যাতে উড়ন্ত পতঙ্গ আটকে যেতে পারে।আর তাহলেই হতে পারে গাছের খাবার।তবে এই দুই ধরনের উদ্ভিদের হজমের গতি খুবই ধীর।
ব্লাডারওয়ার্টঃ
এধরনের উদ্ভিদের বেশীর ভাগ জলজ এবং মূলহীন।এদের অনেক ছোটছোট বেলুনের মত জিনিস থাকে।গাছ এর মাঝে একধরনের ভ্যাকুম তৈরী করে।বেলুনের একটা প্রবেশ মুখ থাকে যাতে অনেক রোম থাকে।যখন ছোট ছোট জলজ প্লাঙ্কটন এই রোম স্পর্শ করে অমনি বেলুনের মুখ খুলে যায় আর শুন্য বেলুনে পানি প্রবেশ করে সেই টানে প্লাঙ্কটনও।তারপর পুরোদমে খাওয়া দাওয়া।
এগুলো ছাড়াও আরো অনেক মাংশাসী উদ্ভিদ আছে বর্তমান পৃথিবীতে।জানি সবার মনে এতক্ষন একটা প্রশ্ন সুরসুরি দিচ্ছে।তার উত্তর হচ্ছে,সিনেমায় দেখা মানুষখেকো গাছ আছে কিনা সে বিষয়ে সঠিক ভাবে কেউ কিছু বলতে পারেনা।এই বিপুল পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা জানি?হয়ত কোনোকালে দৈত্য আকৃতির মাংশাসী উদ্ভিদ ছিল প্রাচীন দুনিয়ায় যার সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়েছে আমাদের কোন পুর্বপুরুষকে।কে জানে যা বলা হয় তা সত্যি কিনা?আসলেই আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে সেসব মানুষখেকো গাছের কোনো প্রজাতি আজও টিকে আছে কিনা?কি জানি!হতেও তো পারে!!!