somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুকুলিমা

১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




।। ১।।
বাড়ি ফিরে মুকুলিমার মনে হলো কখনো এভাবে নিজের ঢোল নিজেকেই পেটাতে হবে তা এতকাল শুধু কল্পনাতীত ছিল। তবে বাস্তবে নিজেকে তুলে ধরতেও খুব কষ্ট হয়নি তার। প্রতি মঙ্গলবারে দৈনিক পত্রিকার সাথে ছ’পাতার ট্যাবলয়েড আরো একটা কাগজ দেয়। সেখানে নানাবিদ শৈল্পিক খবরের সাথে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন থাকে তার মাঝে “পাত্র চাই” কলামের বিজ্ঞাপন কম থাকলেও “পাত্রী চাই” বিজ্ঞাপনটা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ সপ্তাহের বিজ্ঞাপনের পাতায় চার জন পাত্রের সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে। তিন নম্বর পাতায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের পাত্রী চাই তিনটে, আর পাঁচ নম্বর পাতায় চারটি বসবাসরত। নিচের দিকে হিন্দু পাত্র চাই কলামে মুকুলিমা স্বয়ং।

সকাল না পেরুলে এ তল্লাটে খবরের কাগজ মেলে না। তাও আবার কালীবাড়ি মোড়ের জনতা পেপার হাউজ নয়তোবা জেলা স্মরণী মোড়ের দোকান গুলো থেকে কিনতে হয়। মুকুলিমা ছুটির দিনে কোথাও যায় না। আজ বাড়ি থেকে বেরুতে হলো খবরের কাগজটার জন্য। বিভাসকে বললেই বাজার থেকে নিয়ে যেত কিন্তু সে অনেক সময়ের ব্যাপার কাগজ হাতে পেতে পেতে দুপুর গড়াতো।
গেল বুধবার অফিস ফেরতা পথে নিজেই হাজির হয়েছিল পত্রিকার বিজ্ঞাপন বুথে। শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনের বাইরে ভেতরের পাতায় আলাদা করে বিজ্ঞাপনের রেট অনেকটা বেশি, তবুও চোখে পড়ার মতোই যেন বিজ্ঞাপনটি হয় সেটা ভেবেই ট্যাবলয়েডের পাতায় দিয়েছিল। এ্যাড এনকোয়ারিতে যে মহিলাটি ছিলেন তিনি সমস্ত বায়োডাটা নিয়ে হিসেব-নিকেশ করে বিজ্ঞাপন বাবদ যা বললেন তাতে সে শঙ্কিত হয়নি। আজকাল এমনটাই হচ্ছে।
কাউন্টারে বসা মাঝ বয়েসী একজন বললেন বিজ্ঞাপনে অনেকেই নিজের ছবি দিতে শুরু করেছে, আপনি কি ছবি দেবেন? ছবি দিলে একটু সুবিধে হয় যারা দেখবে তাদের জন্য কাজটা সহজ হয়ে যায়। মুকু সাথে ছবি আনেনি। অফিসের পাশেই ষ্টুডিও রয়েছে চাইলে এখুনি তুলে দেয়া যায় তারপরও বললো, না-থাক ছবি দেবার প্রয়োজন নেই তাতে করে, চেনা-জানা সহ এ পাড়ার যারা পড়বে তারা রাস্তায় দেখলেই ওর দিকে রহস্য মার্কা চাওনি দেবে। মেয়েদের তো যন্ত্রণার শেষ নেই। এ হবে আরেক নতুন যন্ত্রনা।

এ্যাড এনকোয়ারিতে বসা মেয়েটি ওর হাতে একটা ফর্ম দিয়ে সেটা পূরণ করে পাশের রুমে জমা দিতে বললেন। মুকুলিমা ফর্মটা পূরণ করে পাশের রুমে পা বাড়ালো। সেখানকার সুদর্শন যুবকটি কে দেখে খানিকটা থমকে গেল, মুখটা কেমন চেনা চেনা লাগছে তবে মনে পড়ছে না। যুবকটি ওর হাত থেকে ফর্মটি নিয়ে কম্পিউটার মনিটরে চোখ রাখলেন। মুকু দাড়িয়ে ছিল, যুবকটি বললো বসুন। খানিকটা লজ্জা নিয়েই ও বসলো। কাউন্টারের মহিলাটি রেজিস্ট্রারে ওর একটা সই নিলো, ছবি দেবে কি-না আরেকবার জানতে চাইলো। মুকু না বলে দিতেই যুবকটি বললো যদি পাত্রী আপনি নিজেই হন তাহলে ওসবের দরকার নেই। মুকু কিছু বলেনি টাকা জমা দিয়ে চুপচাপ চলে এসেছিল।

বিজ্ঞাপনে ছবি দিলে মহা হ্যাপা যে পোহাতে হতো তা জানা কথা। চেনা জানা কারো চোখে পড়লে হাসাহাসির অন্ত থাকতো না। যার চোখে পড়তো সেই ফোন করতো কাজে না হলেও নানাবিদ খেজুরে আলাপে আরো বিতৃষ্ণা যোগ হতো। বিয়ে ব্যাপারটা এখন ফেলনার মতো হয়ে গেছে। আগে অবশ্য হিন্দুদের বিয়েতে ছাড়াছাড়ি ব্যাপারটা একদমই ছিলনা। মনে হতো ওটার কোন নিয়ম বোধহয় নেই। যেখানে স্বামীর ঘর হিন্দু নারীর কাছে কুঁড়ের স্বর্গ সেখানে এখন নতুন রেওয়াজ হয়েছে হিন্দু বিবাহ হবে খাতা-পত্তরে লিখে রেজিস্ট্রি করে। ছাড়াছাড়ির ব্যপারে কয়েকটা শর্ত রয়েছে। তার মানে কতিপয় বিয়ে স্বামীরা বুঝল বউকে ছেড়ে দেবার নিয়ম তাহলে এবার চালু হল। মুকুর কাছে মনে হচ্ছে দিনকে দিন বিয়ের মতো গভীর সম্পর্ক গুলো দিনকে দিন এখন শুধু আলোকসজ্জার মতো খানিক সময়ের সঙ্গী।
মুকুলিমা যে অফিসে কাজ করে সেটার পরিধি বড় নয়। জেলা শহরের অফিস হলেও কুড়ি জন কলিগ, পাড়াতো বন্ধুরা আর কিছু শুভানুধ্যায়ী ছাড়া কারো সাথে ওর তেমন সখ্যতা নেই। যে পাড়ায় থাকে সেখানকার কারো কারো সাথে সপ্তাহে কোন কোন দিন অফিসে দেখা হয় যায়। এদের চোখে বিজ্ঞাপনটা পড়লে নাম, ঠিকানা, সেলফোন নম্বরটা চিনতে পারবে। মুকু জানে এরা দু’চারদিন এ বিষয়টা নিয়ে ফেনাবে ব্যাস্ আর কিছু নয়।
মুকু’র মা মারা যাবার পর বাবা যেন একটু পাথর-পুরুষই হয়ে গেছেন। তার উপর ছোট বোনটা হঠাৎ করেই না বলে একজনের সাথে পালিয়েছিল, তারপর ধরে এনে বিয়ে দিয়ে রক্ষে। মুকুর তখন বিয়ের কথা হচ্ছিল। পাত্রপক্ষ আসবে বলে আর আসেনি। আশে-পাশে সবার মুখেই মুখরোচক চটকদার একটা ইস্যু হয়েছিল। যে পরিবারের এমন ঘটনা থাকে সেখানে পাত্রপক্ষের কথা দিয়ে না আসাটা স্বাভাবিক।

ছোটবোনকে বিদেয় দেবার পর বাবাকে নিয়ে এ বাড়িতে মুকু একা হয়ে গেল। এদিকে বাবার চাকুরীর সময় ফুরিয়ে এলো অগ্যতা জীবন নদীতে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে হলো। মুকু দেখতে একেবারে খারাপ না তবে গায়ের রঙটা উজ্জল নয়। বাবা কয়েকবার বিয়ের চেষ্টা করে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। এরপর মুকুই একদিন বললো বাবা অতো ভেবো না তো! সব দিক গুছিয়ে নিই, তারপর নিজেই নিজের বর খুজে আনবো। বাবা অতটা আশ্বস্ত হতে পারেনি কিন্তু বুড়ো বয়সে আগের মতো সব ব্যাপারে সিরিয়াস হয়ে গেলে প্রেশার মাথায় উঠে যায়।

শুক্রবারের খবরের কাগজ মুকু বাজার থেকে ফেরতা পথে কিনে আনে। সকালের জলখাবারের পর বাবা পেপার নিয়ে বসে। মুকু তখন রান্নাঘরে চলে যায় সপ্তাহের একটা দিন অন্তত ভালো কিছু রান্না করতেই হয় বাবার জন্য। আজ রান্নাঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই বাবার ডাক শুনতে পায় মুকু। তবে কি বিজ্ঞাপনটা এসে গেছে! এত খবরের ভেতর এত বিজ্ঞাপনের ভেতর বাবা কি তবে দেখে ফেলেছে।
সেদিন বাড়ি ফিরেই অবশ্য বাবাকে বলে দিয়েছিল। কোন কালে, এ বাড়ির কোন মেয়ের জন্য এমনটা হয়নি। এখন শেষ পর্যন্ত কিনা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাত্র খোঁজা হচ্ছে। বাবা বলেই ফেললো মুকু, লোকে কি বলবে? তাছাড়া কত লোকের হাজারটা প্রশ্নের ঝামেলা। মুকু ঠোঁট চেপে বলেছিল লোকের কথা না ভাবাই ভালো। তাছাড়া মুকুর জন্য তো কাউকে আসতে দেখা গেলনা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কি যন্ত্রনা মুকু তা বুঝে গেছে এতদিনে। লোকে তো এসব ব্যাপার গাইবার জন্য মুখিয়ে থাকে,‘ হেমন্ত বাবুর মেয়েটার বিয়ে হচ্ছেনা’ আইবুড়ো হয়ে যাচ্ছে। মুকু মনে মনে বলে উঠে বয়েস যাচ্ছে তো তোদের কি? তোরা কেউ তো আশে-পাশে সম্বন্ধ খুঁজিসনি, তবে কথার বেলায় কেন?

বিজ্ঞাপনটায় চোখ বুলিয়ে নিল মুকু। ছ’লাইনের বিজ্ঞাপন কালার মার্কিং করা। নাম, ঠিকানা, সেল ফোন নাম্বার সব দেয়া আছে। সেই সাথে সংক্ষিপ্ত করে বিবরণ। ওর বাবাও দেখলো। ইচ্ছে করেই বাড়ির ঠিকানা দেয়নি মুকু তাতে করে অনেকে বাড়ি বয়ে এসে মেয়ে দেখার নাম করে খরচা বাড়াতো। অফিসের ঠিকানা দেয়া আছে, সেখানে দলবেঁধে মেয়ে দেখবার জন্য কেউ যাবেনা। রান্না ঘরে যাবার সময় মুকু বলে গেল কোন ফোন এলে যা বলার সেই বলবে, বাবাকে কিছু বলতে হবে না। জীবনের পথ বড় কঠিন এখানে ভেবে চিন্তে না পথ চললে যে কোন সময় আশা-ভরসা নিয়ে ডুবতে হয়।

রান্না প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। মুকু আজ একটু তাড়াহুড়ো করছিল কে কখন ফোন করে বসে। রান্নার পাট চুকিয়ে তবে ফোন রিসিভ করলে ভেবে চিন্তে কথা বলা যেত। কিন্তু তা আর হলো না। সেলফোনের রিঙের কর্কশ শব্দ নিয়ে বাবা ফোনটা নিয়ে এলেন। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো রুপু ফোন করেছে।
অফিসের কলিগ রুপু। বড় বেশি মুখ কাটা মানুষ। গত বছর বিয়ে হয়েছে। চেহারায় উপচে পড়া সৌন্দর্য আছে বলে বর খুজতে হয়নি। সুন্দর মেয়েদের একদিক দিয়ে বেশ সুবিধে, বিয়ে আর প্রেমই হোক পেছনে লাইন থাকে। আর বয়েস হয়ে গেলে কিংবা গায়ের বরণে উজ্জ্বলতা কম থাকলে প্রেমিকের সন্ধান তো পাওয়া যায়ই না, আর বিয়ে সে-তো ম্যালা খরচার বিষয়। মুকু ফোনটা কানে চেপে বললো, হ্যা রুপু বল, এই খর দুপুরে হঠাৎ ফোন দিলি? ওপাশ থেকে রুপু বললো তোমার এ্যাডটা দেখতে পেলাম তাই ভাবলাম একটা ফোন দিই। ভালোই হয়েছে এ্যাড দিয়েছো। এবার নিশ্চয়ই ভালো একটা বর পাবে। তাছাড়া শুনেছি দেরিতে বিয়ে হলে নাকি মেয়েরা অনেক সুখি হয়। মুকু কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তাই বললো দেখা যাক কি হয়।



।। ২।।
বিকেলের দিকে প্রথম ফোনটা এসেছিল। খাবারের পর মুকু ভেবেছিল ঘুমিয়ে যাবে, সেজন্যই শুয়ে ছিল। ঘুমটা আসবে আসবে করছিল এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। ভদ্রলোক প্রথমেই নমস্কার জানিয়ে বললেন আমি অরুপ দাস, দিনাজপুরে থাকি আপনার এ্যাডটা দেখেই ফোন দিলাম। পাত্রী নিশ্চয়ই আপনি?
মুকু হ্যাঁ বলতেই ভদ্রলোক আবার শুরু করলেন কথা। -শুনুন আজকালকার কাগজের এ্যাড গুলোতে খানিকটা জলমেশানো থাকে তাই বলছি যা লেখা আছে সব যদি সত্যি হয়, তাহলে আমার কাছে পাত্র আছে। কথার মাঝখানে মুকু বললো পাত্রটি কি আপনি? এমন চড়া গলার মানুষ যদি পাত্র হয় তাহলে মুকুর বিয়ে করবার কোন ইচ্ছে নেই। ভদ্রলোক বললেন, না আমি নই। আমার ভাই। সব ঠিক আছে যেমনটি চান, একেবারে নির্মল মনের শিশুসুলভ আচরনের মানুষ, দেবতার মতো। মুকু ভাবলো, দেবতা হয়ে গেলে তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। কেননা হাজার লোকের কাজের মাঝে ছুঁয়াছুঁয়ি হতে পারে দেবতা তখন আবার বেঁকে বসবেন হয়তো!
ভদ্রলোক আবার বললেন, সব ঠিক; তবে একটু সেক্রিফাইস করতে হবে। মুকু সেটা কি জানতে চাইবার আগেই তিনি বললেন হঠাৎ হঠাৎ মাথার ব্যাথায় উল্টো-পাল্টা কিছু বলে আর কি!
মুকু’র যা বোঝার তা বুঝে গেল। ফোন রেখে দিয়ে বসে পড়লো বিছানায়। তিতকুটে একটা ভাব শরীর জুড়ে ছড়িয়ে গেল। ও হয়তো দেখতে ডানাকাটা পরি নয় তাই বলে শেষ পর্যন্ত কিনা একজন উন্মাদের জন্য ওকে কেউ পাত্রী হবার কথা বলে। এসব কারণের জন্যই কোন কোন মেয়ের মনে হতে পারে মেয়ে হওয়াটা খুব বিশ্রী ব্যাপার। কতিপয় মানুষের কথাবার্তার ধরন আর কার্যকলাপে মনে হয় মেয়েদের অসুন্দর হওয়াটা বোধ হয় অভিশাপ।

মুকু ঘুমিয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যেয় বাবা ডেকে তুললেন। কেউ একজন দেখা করতে এসেছে। বসবার ঘরে বসে আছে। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেড়িয়ে এলো সে। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের কাছেই নিজেকে হাস্যকর মনে হচ্ছিল। ঘুম থেকে উঠলে কেমন ভূতনির মতো দেখায়। ও ভাবছিল অফিসের কেউ বোধ হয় এসেছে। দুপুরেই হয়তো কেউ কেউ বিজ্ঞাপনটা দেখেছে, এখন পাত্রের সন্ধান নিয়ে একেবারে বাড়ি এসে গেছে। ঘুমমাখা মুখ নিয়ে বসবার ঘরে ঢুকেই মুকু খানিকটা অবাক হয়ে গেল। একজন নয়, তিনজন অচেনা মুখ। একজন মহিলা দু’জন পুরুষ।

বাবা পরিচয় করিয়ে দিলেন সবার সাথে। বিজ্ঞাপন পড়ে সোজা বাড়ি চলে এসেছেন উনারা স্বচক্ষে দেখবেন। মুকু হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে বসে পড়লো। অফিসের ঠিকানা দিয়ে হয়েছে আরেক হ্যাপা। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই মুকুর বাসার ঠিকানা জানিয়ে দিয়েছে। এসেছে ছেলে, মামা এবং ছেলের মা। মুখ ভর্তি রহস্যময় হাসি নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নও করে গেলেন মুকুকে। এসব প্রশ্ন-উত্তরের ঝামেলা এড়ানোর জন্যই সে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। যার সাথে ম্যাচিং হবে শুধু তার কাছেই এসবের উত্তর দেয়া যায়, জনে জনে দেয়াটা চরম বিরক্তিকর।
মুকু ভেবে দেখলো ভূতনির মতো বসে না থেকে চা তৈরি করা যাক।

রান্নাঘরে ঢুকেই মনে হলো আজকাল চা খাওয়া হয়না বললেই চলে। কফিই হয়। ঝটপট কফি তৈরি করে সাথে আরো কিছু মিক্সড জলখাবার নিয়ে এল। কফি চুমুকের পর কথা হলো ওদের। ছেলের মামা বললেন মেয়ের যেহেতু গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট, সেই সাথে চাকুরীও করছে সব ঠিক আছে, তবে গায়ের রঙটা যদি আরেকটু উজ্জল হতো, বুঝেনই তো বিয়ের পর নেক্সট জেনারেশন যদি মায়ের কালার পেয়ে যায়, তাহলে যাচ্ছে তাই একটা ব্যাপার হবে। আমাদের বংশ আবার গৌরবর্ণ কিনা!
মুকু চুপ করে ছিল। যা বলার বাবাই বললেন। ছেলের মামা ল’ইয়ার। ঘুড়িয়ে-পেঁচিয়ে টাকার কথা বললেন। মানে দাড়াল যৌতুক। ছেলের বৌভাতে এই লাখ তিনেক খরচাপাতি। মুকুর মুখ শক্ত হয়ে আসছিল, ওর ইচ্ছে করছিল সবকটাকে একচোট ঝেড়ে দিতে; কিন্তু সম্ভব নয়। বাবা তবুও লাখ খানেক দেবার কথা জানিয়েছিল। ওরা চলে যাবার আগে বলে গেল পড়ে জানাবে। যদিও এসব ব্যাপারে পড়ে জানানো মানে সম্ভবনা শূন্যের কোঠায়। টাকা-পয়সার বিষয়টা নিয়ে বাবাকে কিছু বলতে গিয়েও মুকু চেপে গিয়েছিল। বাবা হয়তো এখন নিজেকে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। ভাবছেন নিজের শেষ সম্বল খুইয়ে মেয়ের বিয়ে দেবেন।
দ্বিতীয় ফোনটা এসেছিল রাতে শোবার আগে। বাবা শুয়ে পড়েছিল। মুকু টিভিতে সিরিয়াল দেখা শেষ করে সবেমাত্র শুতে যাবে অমনি সেলফোনটা বেজে উঠলো। বাবা জেগে থাকলে সেই রিসিভ করতো। বাবা যেহেতু ঘুমে মগ্ন অগ্যতা মুকুই ফোন তুললো। ওপাশ থেকে একটা পুরুষালী কণ্ঠ বলে উঠলো, প্রথমেই দুঃখিত এত রাতে ফোন দেবার জন্য। এমন নাটকীয় ভঙ্গি মুকু অনেকদিন পর শুনলো। সেই কবে কলেজে পড়বার সময় একজন এভাবে ফোন করে মাঝে মাঝে সরি বলে কথা শুরু করতো। মুকুর অবশ্য তখনকার বয়সে খারাপ লাগতো না। ঝরে যাওয়া ফুলের মতো সেই কণ্ঠস্বর হাওয়া হয়ে গেল। এরপর মুকু’র সেলফোন নাম্বার বদল হলো চাকুরিতে যোগ দেবার পর বাজে বকার কোন সময় নেই। বয়সের সাথে সাথে অনেক আবেগী কাণ্ডকারখানা লুপ্ত হয়ে যায়।

মুকুর নিস্তব্ধতা দেথে ও পাশের কণ্ঠটা বললো শুনতে পাচ্ছেন কি? নাকি ঘুমিয়ে গেছেন? মুকু নিরবতা ভেঙ্গে বললো, কাকে চাইছেন? ও পাশের কণ্ঠটি বলে উঠলো সম্ভবত আপনাকেই। আজকের এ্যাডটা দেখলাম। পাত্র খুঁজছেন। প্রথমে বেশ অবাক হয়েছি। আপনার তো পাত্র খোঁজার কথা নয়। যাই হোক, পাত্র না খুঁজে, একটা প্রেম করে নিলেই পারেন। মুকু বেশ চমকে গিয়েছিল অচেনা মানুষ এতটা দৃঢ়তা নিয়ে কথা বলছে, দ্বিধা সরিয়ে বললো কে বলছেন? ওপাশ থেকে আবার শোনা গেল, আমি খুব অপরিচিত, তবে আবার খানিকটা পরিচিত। এ্যাডে আপনার অফিসের ঠিকানা দেখেই চিনতে পেরেছি। আপনি দূর্জয় মোড় থেকে প্রতিদিন বাসে করে সুর্য কুমারের মাঠ অবদি যান। আবার বাইপাসেও প্রায় বাসের জন্য দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আপনি নেমে যান দুর্জয় মোড়ে আর আমি নামি ব্রীজের সামনে। মুকু কথার মাঝখানে বললো বেশ গোয়েন্দা হয়েছেন তো? আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছিনা একদম। আর ছেলেদের স্বভাবই তো মেয়েদের ফলো করা।
-হুম ছেলেরা বড্ড খারাপ হয়। আমাকে আপনার চেনার কথা থাকলেও সরাসরি কখনো কথা হয়নি, দেখা হয়নি বলেই অপরিচিত রয়ে গেছি। তাছাড়া সবাইকে কি সবাই চেনে? আশে-পাশে চোখ মেলে দেখাবার মতো সেরকম মানুষ তো আপনি নন। মুকু থেমে ছিল ভদ্রলোকের কথা শেষ হতেই বললো, আমার ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন দেখছি, তা কি জন্য ফোন দিয়েছেন? বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করতে চাইলে সকালের দিকে ফোন করতে হবে। ভদ্রলোক খানিকটা দম নিয়ে বললো সেটা পরে হবে, আপাতত আমি আপনার সাথে প্রেম করতে চাই, যদি আপনার আপত্তি না থাকে। মুকু কি বলবে ভাবছিল। আবার কোন উন্মাদের পাল্লায় পরা গেল। নাকি ইচ্ছে করে কেউ মজা করছে। ধারে কাছে এই শহরে তেমন কোন বন্ধু তো নেই। তাহলে কে এই ভদ্রলোক, মাঝ বয়েসী মুকুর সাথে প্রেম করতে চায়। ডিভোর্সি কেউ নয় তো। তবে যাই হোক কণ্ঠটি বেশ চমৎকার। কথা বলতে বেশ লাগছিল।

ত্রিশ পেরিয়ে গেলে আর প্রেমের বয়েস থাকেনা। আর প্রেম করার সেই ইচ্ছে বা স্বাদ কোনটাই তার এখন নেই। এই মাঝ বয়েসে চলতে ফিরতে পারা সুস্থ্য মস্তিস্কের একজনকে বিয়ে করতে পারলেই তার চলবে। কথাগুলো বলে মুকু লাইনটা কেটে দেবে ভাবছিল কিন্তু ও পাশের ভদ্রলোক বললেন, প্রেমের আবার বয়েস কি? যতদিন না মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে ততদিন সে প্রেম করতে পারে, তা কুড়ি হোক আর ডবল কুঁড়িই হোক। মুকু কিছু না বলে ফোনের সুইচড অফ করে দিয়েছিল ।
সকাল বেলার দিকে ওর বাবা যখন ওকে ডাকছিল, মুকু তখনও ঘুমে বিভোর। অনেকদিন বাদে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন এসেছিল ঘুমের রাজ্যে। মুকু হাতে বরমাল্য নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে ঘুরছে, কিন্তু কেউ ওকে বিয়ে করছে না। অনেক রাজ্য ঘুরবার পর গঙ্গায় ঝাপ দিতে যাবে মুকু, তখন এক সুদর্শন যুবক সাথে একজন আনস্মার্ট যুবককে নিয়ে হাজির মুকুর বরমাল্য নেবার জন্য। একসাথে দুজনকে তো বিয়ে করা সম্ভব নয়, সে জন্য একটা ট্রসের ব্যাবস্থা করা হলো। মুকু যদিও চাইছিল সুদর্শন যুবকটির সাথেই তার বিয়ে হোক কিন্তু আনস্মার্ট যুবকটি নাছোরবান্দা সে মুকুকে বিয়ে করবেই। ট্রসের জন্য পয়সা আকাশে ছুড়ে দেয়া হলো। হেড পড়লেই মুকু সুদর্শন যুবককে বিয়ে করতে পারবে। পয়সা হাওয়া ছুঁয়ে নিচের দিকে পড়ছিল মুকুর উৎকণ্ঠা তখন শীর্ষে, এমন সময় বাবা ডাক দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলেন। অনেকদিন পর বাবার উপর রাগ হয়ে গেল ওর। স্বপ্নের শেষটা দেখতে পেলে ভালো হতো।

তৃতীয় ফোনটা এসেছিল মুকু যখন অফিসে যাবে তৈরি হচ্ছে। ঘুম থেকে উঠেই ফোন অন করে টেবিলে রেখে দিয়েছিল। বিয়ের ব্যাপারে তার চেয়ে বাবা কথা বললেই ভালো হবে। আর সে জন্যই তৃতীয় ফোনটা বাবাই রিসিভ করে কথা শুরু করেছিল। মুকু ফোন ধরতেই ও পাশের পুরুষ কণ্ঠটি বললো, আমি আপনার সাথে সরাসরি দেখা করতে চাই। মুকু বুঝতে পারলো ইনি তো গতকাল রাতের সেই লোকটি। কথা শেষে বোঝা গেল বিয়ের ব্যাপারেই কথা বলবে এই ভদ্রলোক তাও আবার সরাসরি। মুকু ভাবলো বেশ তো। অফিস ফেরবার পথে দেখা হবে। যদি মোটামুটি মিলে যায় তাহলে এবার আর বসে থাকবে না মুকু। বিয়ের কথাবার্তা শুরু করে দেবে।


।। ৩।।
অফিস থেকে বেড়িয়ে দুর্জয় মোড়ে আসতে আসতে একটু দেরীই হয়ে গেল। যদিও ভদ্রলোক বলেছিলেন অপেক্ষা করতে তার এতটুকু কষ্ট হবেনা। সামান্য খানিকটা দেরী হলেও ক্ষতি নেই। মোড়ের এই ভীড়ে ফোন দেয়াটা অস্বস্থিকর। আশে পাশের মানুষগুলো অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে থাকে। ব্যাগ হাতরে সেলফোনটা তুলে নিতেই হঠাৎ রিং বাজলো। ওই ভদ্রলোকটিই ফোন করেছে, আপনি সিএনজি নিয়ে ভৈরব ব্রীজে চলে আসুন বলেই লাইনটা কেটে দিলো। মুকু ভাবছিল থাক না, বাড়ি ফিরে গেলেই বেশ হয় আবার ভাবলো দেখাই যাক না কি হয়। কারো সাথে কথা বললেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছেনা। বিয়ে মানে হাজার কথার বাগড়া।

ব্রীজে নেমেই মনে হলো গঙ্গার ধারে এত মানুষ রোজ হাওয়া খেতে আসে। এখানে ওই একজনকে খুজে বের করা মুস্কিল! তার উপর অচেনা। ব্রীজের দুপাশের রেলিং ভর্তি বিভিন্ন বয়েসী মানুষের সমাগম। বেশ ক’জোড়া জুটিও রয়েছে। প্রেমের রাখ-ঢাকের দিন এখন উঠে গেছে। দেখিয়ে প্রেম করাটাই একটা প্যাশন। ব্রীজে নেমে সিএনজি ছেড়ে দিল মুকু। দশ মিনিটের বেশি একদম সময় দেয়া যাবেনা। মুকু সেলফোনে হাত দিল, একটা কল দেয়া যাক। ব্রীজের কোন মাথায় আছে কে জানে? এখানে একা দাড়িয়ে থাকতে নিজেকে কেমন অসহায় দলছুট পতঙ্গের মতো লাগছে।

একটা রিঙ হতেই কলটা কেটে গেল, তার মানে আশে-পাশেই আছেন তিনি। এতক্ষণ গঙ্গার ডানপাশের দিকটাতেই তাকিয়ে ছিল মুকু। বাম পাশটায় তাকাতেই দেখতে পেল, হাতে ছোট একটা ফুলের তোড়া নিয়ে, ছাই রঙা চেক শার্ট পরা, খসখসে চামড়া, রোদে পোড়া গায়ের রঙ নিয়ে হাঁটছেন একজন। ইনিই কি ওমন কথার যাদুতে ওকে এখানে টেনে এনেছে। চেহারাটা বেশ চেনা চেনা মনে হলো। এই শহরেই জেলা স্মরণীর মোড়ে কিংবা বাসস্ট্যান্ডে কখনও কখনও দেখেছে সে।
পুরুষ মানুষদের মুখে সামান্যটুকু শ্রী না থাকলে কেমন বেখাপ্পা লাগে। মুকু তো আর গ্রাম্য কুলবধূ হতে পারবে না এখন। লম্বা ঘোমটা টেনে পথ চলবে, কোন পার্টি বা সেমিনারে স্বামীকে কে নিয়ে যাবার ভয় থাকবেনা। পড়ালেখা করে পুরোদস্তুর শহুরে মানুষে সে। সামান্যতম একটু মুখশ্রী মানুষ না হলে চলবে কি? নাহ্ এমন মানুষকে বিয়ে তো দূরের থাক, ভালোবাসাও যায়না। মন বলে একটা ব্যাপার আছে। তার উপর মেয়েদের ম্যাচিং এর একটা ব্যাপার থাকে।

মুকু একবার ভাবলো লোকটা আসবার আগেই সিএনজি ডেকে চলে যাওয়া যাক, পরক্ষণেই আবার মনে হলো ফোনে যেভাবে কথা বলেছে তাতে ভদ্রলোক মুকুকে বেশ ভালো করেই চেনে। পালিয়ে বেড়াবার চেয়ে, বুঝিয়ে বললেই হবে। ওকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রলোক হাতের ফুল উঁচিয়ে ধরে বললো, আমিই আপনাকে আসতে বলেছিলাম। আমার নাম নিখিলেশ। পৌরসভা অফিসে আছি। নিন ধরুন ফুলগুলো। বিষাদ মুখে কৃত্রিম হাসি এনে ফুল গুলো নিল। ওর মনের ভেতর থেকে একটা বিষাদের স্রোত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
নিখিলেশ খানিকটা মুচকি হেসে বললো আমি কিন্তু দূর থেকেই আন্দাজ করতে পেরেছি আমাকে দেখবার পরই আপনার অনলাইন মুড হঠাৎ অফলাইনে চলে গেছে। জানি সত্যি বলবেন না, তবুও জানতে ইচ্ছে করছে কেন আপনার মুড অফ হলো বলুন তো?
-মুড অফ হয়ে গেল মানে? কেমন করে এমনটা মনে হলো আপনার? আচমকা রাগ হয়ে গেল মুকুর।
-আপনি কিন্তু রেগে যাচ্ছেন। জানি আমাকে দেখবার পর আপনার ভালো লাগছে না। ভেতরে ভেতরে জ্বলে যাচ্ছেন অথচ বিজ্ঞাপনে বলেছেন, ঘর সংসার করবার মতো ভালো মনের একজন মানুষ হলেই চলবে। বন্ধুর মতো জীবন সঙ্গীই আপনার কাম্য। তাই না?
-হ্যাঁ এসব আমার নিজস্ব পছন্দ। মুকুর ভেতর থেকে রাগটা ক্রমশই বাড়ছিল। নিখিলেশ ওর মন খারাপ করা চোখ দুটো নামিয়ে বললো আমি অনেক আগে থেকেই আপনার মুখটা চিনতাম। ঠিকঠাক পরিচয় দিলে আপনার মনে পড়ে যাবে। সেসব আজ থাক। আপনাকে এতটা বিব্রতকর অবস্থায় দেখবো সেটা ভাবতে পারিনি। এখন যদি বলি আমি নিজেই পাত্র! আপনার সাথে প্রেম করতে চাই, বিয়ে করতে চাই! তাহলে হয়তো এখন আপনি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।
মুকুর মাথাটা সত্যিই একটু ঘুরে উঠল। এমন রুপ-রসহীন, শীর্ণ, রুগণ্ ছেলেকে কে বিয়ে করবে? কিছুই তো নেই। আর সাহসই বা পেল কোথায়? মুকু কিছু বলবার আগেই নিখিলেশ বললো আমি জানি আপনার ভেতরের অবস্থা। আপনার এখন ইচ্ছে করছে আমাকে কঠিণ ভাবে তিরস্কার করতে। আমার মতো এমন হাটুভাঙ্গাকে কে বিয়ে করবে? নিত্যান্ত কোন গ্রাম্য মেয়ে ছাড়া। কোন শহুরে সুশ্রী মেয়ে বিয়ে করবার অধিকার হয়তো আমার নেই।
-আসলেই নেই। এ কথা বলে, চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল মুকু, ‘আমি নিজেও কিন্তু অতটা সুশ্রী নই, তারপরও পছন্দ বলে একটা কথা তো আছে তাইনা ?
-আপনার কথা ঠিক। সবারই একটা পছন্দ থাকে। আমি জানি আমার দেখাবার মতো কিছু নেই। আমার দিকে কোন মেয়ে ফিরেও দেখেনা। কারো কল্পনাতেও কখনো আসি না। তবুও আমি কি দুর্দান্ত স্বপ্ন দেখি। কাউকে ভালোবাসার, রুপময়ী কারও প্রেমে পড়বার অধিকার আমার নেই। বোকার স্বর্গে বাস করছি আমি তাই না?
অথচ দেখুন আমার এই অসুন্দর মুখায়ব ছাড়া খেয়ে পড়ে চলবার মতো সবই আছে। বয়সে আমি আপনার চেয়ে সামান্য একটু বড় হবো এই যা। ঘর সংসার করবার মতো ভালো মনের মানুষ চেয়েছিলেন বলেই এসেছিলাম। তবে ভুল করেছি, কারণ মানুষের ভাবনার সাথে জীবনের পথচলা এক হয়না।

মুকুর বেশ খারাপ লাগা থেকে বিব্রতকর অবস্থার চরম পর্যায় চলে এসেছিল। ফুল গুলো একপাশে রেখে দিয়ে বললো, আপনার কথা নিশ্চই শেষ হয়েছে। আমাকে এবার যেতে হবে।
সিএনজিতে উঠবার সময় নিখিলেশ বললো আমাকে ক্ষমা করবেন। অনেক বেশি বিব্রত করলাম আপনাকে। জানি আপনার জীবন সঙ্গী হবার কোন যোগ্যতা নেই। প্রেম তো বহুত দূর কি বাত! তবে মাঝে মাঝে বন্ধু হিসেবে কথা বলতে পারি নিশ্চয়ই। মুকু বললো আমার বন্ধুর প্রয়োজন নেই। তাছাড়া আশে-পাশে চেষ্টা করলে কথাবলার লোক জুটিয়ে নিতে পারবেন।
নিখিলেশ আবার বললো। আপনার মতো মুকু দুটো যদি হতো, তাহলে তাকেই বিয়ে করে নিতাম। সে অন্ধ হলেও কোন ক্ষতি ছিলনা কিন্তু আপনার মতো আরেকটা মুকু পাওয়া তো সম্ভব নয়। খুব ইচ্ছে ছিল একদিন সামনা-সামনি কথা বলবো তাই এসেছিলাম। -অনেক বেশি বিরক্ত করবার জন্য দুঃখিত, আমাকে মাফ করবেন বলেই নিখিলেশ উল্টো পথে হাটা ধরলো। সিএনজিতে সারা পথ মুকু মাথা তুলেনি। একেবারে বাড়ির গেটে এসে মাথা তুলে নেমে সোজা ঘরে ঢুকেছিল। বিজ্ঞাপনের সব কথাই যে ধ্র“ব সত্য হয়না সেটা নিখিলেশের মতো কিছু লোকের মাথায় ঢুকে না। বাস্তব সিনেমা নয়। সেটা বড় কঠিন তবু এরা মনের ভেতর অর্থহীন স্বপ্নের জাল বুনে। শ্রীহীন মানুষের বুক ভর্তি প্রেমের কোন দাম নেই।

বাড়ি ফেরবার পর মুকুর মনে হলো নিখিলেশ সেই ছেলে নয়তো! চার বছর আগে যাকে না দেখেই ভালোবেসেছিল সে। কণ্ঠটা অনেকটা সেরকম। তবে ওর নাম তো ছিল ভিন্ন । তখন প্রথমবারের মতো সেলফোন নিয়েছিল সে। অপরিচিত নাম্বারের কণ্ঠ ওকে সচকিত করে তুলেছিল। কথায় কথায় সখ্যতা তারপর ভাসা-ভাসা ভালোবাসা। না দেখেই ভালোবাসা জন্মে গেছিল। মাঝে মাঝে মনে হতো এটা নষ্ট আবেগ। তারপর একদিন সেই কণ্ঠ হাওয়া। নাম্বার বন্ধ। রাগে দুঃখে মুকুও নাম্বার বদলে ছিল। পুরুষ মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতে নেই। মেয়েদের মন নিয়ে হোলি খেলে। এরপর অনেক চরাই-উৎরাই পেরিয়ে এসেছে মুকু। এখন তার কাছে এসব আগের কোন মূল্য নেই।

মনটা বিষিয়ে ছিল রাতের রান্না শেষ হবার পর বাবা বললো, কাল কয়েকজন লোক আসবে সন্ধ্যের পর মুকুকে দেখতে। আজ দুপুরে এসেছিল মুকু তখন অফিসে। কাল আবার আসবে। ও বললো বাবা পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়ে মনে হয় ভুল করেছি। অনেক উটকো লোকের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। বাবা কিছু বললেন না। বিজ্ঞাপনের কথাটা মাথায় আসতেই মুকু ভার হয়ে গেল। নিখিলেশের মুখটা চট করে মনে পড়ে গেল। অনিবার্য অপ্রাপ্তিতে ডুবে ডুবে অনুভূতিহীন-বুদ্ধিহীন হয়ে গেছে সে। বাস্তবকে স্বীকার করতে কষ্ট হচ্ছে। সংসার কোন ধর্মশালা নয়, এখানে নিজের মতো করে সবাই কে ভাবা ঠিক নয়। আয়নার নিজের মুখ মাঝে মাঝে দেখতে হয়। সব মানুষের ইচ্ছে পূরণের জন্য ঈশ্বর ভান্ডার খুলে বসে নেই। সব সম্পর্ক ইচ্ছে মতো হবার জন্য পৃথিবী সৃষ্টি হয়নি। এসব নিখিলেশকে বুঝতে হবে। মুকু কোন মহামানবী নয় সব আপদকে হাতে তুলে নেবে।

পরদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরবার পর মুকু বসবার ঘরে ঢুকতেই দেখলে টেবিলে একটা সবুজ রঙা চিঠির খাম। এ যুগে সহজে কেউ চিঠি লিখে না। হয়তো কোন বিয়ের কার্ড হবে। খামে চোখ রাখতেই দেখতে পেল গোটা গোটা অক্ষরে ওর নাম লিখা, প্রাপক, মুকুলিমা রায়। চিঠিট হাতে নিয়ে বসে পড়লো সে। বাবা জানালো দুপুরে একজন লোক এসে দিয়ে গেছে। খুব সম্ভবত কোন কুরিয়ার অফিসের লোক হবে। মুকু চিঠি নিয়ে নিজের ঘরে এলো। শাড়িটা পাল্টে চোখ মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চিঠির খামটা খুললো। এত বছর পর কে ওকে চিঠি দেবে? আর কেনই বা দেবে? এসব ভাবতে ভাবতেই খাম খুলে চিঠিটা বের করে নিয়ে এলো।

চিঠি শুরুতেই লেখা, প্রিয় মুকু, আমি রুপম। যাকে তুমি ভালোবাসতে। এ অবদি পড়ে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো ওর। যাকে একদিন আবেগে ভালোবেসেছিল অবশেষে তার পুনর্বার সন্ধান মিললো। চিঠির বাকী অংশে চোখ রাখলো সে। গতকাল অফিস ছুটির পর আমিই তোমাকে ডেকেছিলাম। এতকাল যাকে ভালোবেসেছি, তার সামনে দাড়িয়ে ভালোবাসার কথা বলবো বলে। পুরোনো সিমকার্ড হারানোর সাথে সাথে তোমাকেও হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেদিন বিজ্ঞাপনে নাম, বাবার নাম, দেখে চিনতে পারলাম। তুমি-আমি দুজনে আজ এক শহরেই আছি ভেবে দিন দিন পুলকিত হচ্ছিলাম। ব্রীজে দাড়িয়ে সরাসরি কথা বলে ঠিক বুঝে গেলাম তুমিই সেই মুকু। সেই মুকুলিমা।

চিঠির এ পর্যন্ত পড়ে থমকে, বিহ্বল হয়ে বিছনায় উঠে বসলো মুকু। নিখিলেশকে ভালোবাসতো সে। ওমন একটা রুগন্ ছেলেকে। হায়-রে আবেগ। সব অনুভূতিপ্রসূত মানুষই সব সময় মনের ভেতর পুষে রাখবার মতো মানুষ হয়না। কেউ কেউ এভাবেই মনের ভেতর বিব্রতকর ঝড় তুলে। চিঠির শেষ অংশে চোখ রেখে মুকু দেখতে পেল শেষ প্যারায় লেখা- মুকু তুমিই বোধহয় আমাকে ভালোবেসে বলেছিলে, অর্থ, রুপ, ঐশ্বর্য থাকলেই ভালবাসা হয়না। ভালোবাসার জন্য একটা নির্মল মনই যথেষ্ট। আমার বিশ্বাসের মাত্রা বোধহয় তোমার প্রেমের চেয়েও বড়। সে জন্যই আজ ডুবতে বসেছি। মিথ্যে করে- ‘ভালোবাসি বলাটা যত সহজ, সত্যি করে ভালোবাসা ততটাই কঠিন’। আয়নায় আমার মুখটা দেখতে বলেছিলে? সময় পেলে কোনদিন নিজেকে আয়নায় দেখে নিও। আমার কোনদিনই বলা হলোনা, মুকুলিমা তোমাকে ভালোবাসি। একদিন ভোরের সূর্যের মতো তোমার জীবনে এসেছিলাম, এবার রাতের আঁধারের মতো তোমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলাম। ভালো থেকো।

চিঠি হাতে নিয়ে বিমুঢ় হয়ে বসে রইল রইল মুকু। হঠাৎ হু-হু করে বুকের ভেতর থেকে কান্নার ঢল নামল চোখে। রাতের নীরবতায় বিষণ্নতার ঝড় উঠল পাশের দেয়ালগুলোতে। মুকু কতক্ষণ কেঁদেছিল মনে নেই। দরজায় বাবার ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়েছিল।
- কি হয়েছে তোর? কোন স্বপ্ন-টপ্ন দেখেছিস নাকি? আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তোর কান্নার শব্দে জেগে উঠলাম।
মুকু দরজা না খুলেই বললো, কিছু হয়নি বাবা, এমনিই। তুমি যাও। আমি ঘুমুবো। মাঝ রাত্তিরে সত্যি সত্যি মুকু আয়নায় নিজেকে দেখলো। কেমন বিবর্ণ। মায়াভর্তি এই মুখটা, এই চোখগুলো কত সহজেই ভেতরের স্বত্বটাকে গুড়িয়ে দিল। কারো ভালোবাসার কাছে নিজের সৌন্দর্য কতটা মূল্যবান?
আজ নিজের কাছেই নিজেকে অচেনা ঠেকছে মুকুর। সে, তো এমন ছিলোনা? তার ভেতরে তো এমন কঠিন দগদগে আগুন ছিলো না? চোখের চাওয়ার কাছে মনের চাওয়ার কোন দাম নেই। নিজের মুখটা ক্রমশই নিজের কাছে বিভৎস্য হয়ে আসছে। ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে কাঠ-কয়লার মতো। ভালো চেহারার চেয়ে ভালো একটা মনের মূল্য হয়তোবা অনেক বেশি কিন্তু এই সত্যটা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না মুকুর মন।
তবে কি মুকু হারতে হারতে অহঙ্কারী হয়ে গেছে?

______
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:১১
৩৮টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×