(১)
জ্যৈষ্ঠের এক নিরব সন্ধ্যায় কান্তনগরের মাটিতে পা রাখলাম। এখানকার ট্রেন আমায় দ্যুম্ করে নামিয়ে দিয়ে
চলে গেলো। এই শহর অচেনা নয়-তবুও বহু বছর বাদে পা পড়লো এই শহরে।
ষ্টেশনে নেমেই আমি একটু শূন্যতা অনুভব করলাম- কেউ আসেনি আমায় এগিয়ে নিতে। অনেকটা চুপচাপ চাদর গায়ে মেখেই এসে গেলাম।
এর আগে যখন ছোট্টটি ছিলাম তখন মার কোল থেকে নেমে এ ষ্টেশনে পা ফেলতেই চারপাশটা কেমন যেন গুমগুম করতো; ভীড় তখন এতো ছিলনা, যাত্রী নামার তাড়া ছিলনা কিন্তু ভীড় ছিলো আড্ডা দেবার মানুষের। আমি কিংবা আমার সঙ্গীরা তখন নতুন নতুন কলকব্জা দেখার নেশায় মত্ত থাকতাম। বেলা বেড়ে গেলে মামা আমায় কাধে করে নিয়ে বাড়ি ফিরতো।
সেইসব দিন গেছে কিন্তু রয়ে গেছে কান্তনগর রেলষ্টেশন।
রেল লাইন দেখলেই মনে পড়ে যায় তোমার কথা। তুমি হাত ধরে হাটতে চাইতে। যেন নদীর এপাড় আর ওপাড়ে দু’জন রয়েছি মাঝখানে সমান্তরাল। কত সকালকে ঝেড়ে ফেলে আমরা দুপুরকে চাইতাম; পড়ার তাড়া থাকতো বলে, কতদুপুর আমাদের পায়ের নিচে বিকেল হয়েছিল তার ইয়াত্বা নেই।
দুপাশের রেল লাইন ধরে আমরা সবাই বহুদুর চলে যেতাম। রোজ ভাবতাম পথের শেষপ্রান্তে যাবো; কোন দিন যাওয়া হয়ে উঠেনি! -আমরা মাঝ পথেইে থেমে গেছি ব্যাটারি হীন ঘড়ির মতো।
তখন তোমার বয়স দশেরঘর পাড় করেনি, আমি তের পার করেছি। সেই বয়সে একদিন তুমি বলেছিলে – পকেটে অনেক টাকা যেদিন হবে সেদিন রেল লাইন পথের শেষপ্রান্তে যাবো? -আমার সঙ্গে যাবে তুমি? সেদিন কিছু বলা হয়নি আমার; আমি তোমার মার্বেল চোখে তাকিয়ে ছিলাম সেখানে তোমার ইচ্ছেরা ছোটাছুটি করছিলো আমি তোমার ইচ্ছের আস্ফালন দেখতে পাচ্ছিলাম।
ট্যাক্সি ওয়ালা কিছুদুর গিয়েই জানতে চাইলো কোথায় যাবেন বাবু ? এই শহরটা চেনা ছিলো এখন অনেকটা পাল্টেছে। রাস্তা কতো চওড়া হয়েছে। একটাও বাইসাইকেল চোখে পড়লোনা!
আমরা বন্ধুরা দলবেঁধে কতো সাইকেলিং করেছি। এই পথ গুলো তখন এতো চওড়া ছিলোনা। কিন্তু তাতে আমাদের সমস্যা হতোনা।
তিন পয়সার মোড় পড়তেই ড্রাইভার জানতে চাইলো বাবু কোথায় নামবেন?
-ভালো হোটেলে নিয়ে যাও?
আগে এই মফস্বল শহরে তিনটে হোটেল ছিলো। থাকার জন্য বিহারি হোটেলটাই ভালো ছিল। ঢালাও বিছানারও একটা হোটেল ছিলো নাম ছিলো রাত্রী নিবাস। একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে ওখানটায় ছিলাম, ছারপোকা সেই আদর এখনও ভুলিনি।
-কোন হোটেলে যাবেন? এখানো তো প্রায় কুড়িটা ভালো হোটেল আছে?
-আচ্ছা রাত্রী নিবাস হোটেলটা কি এখনো আছে ওই যে ছিমছাং নদীর পাড়ে যে ছিল?
-আছে বাবু। এখন তো ওটা মস্ত বড় হোটেল হয়ে গিয়েছে
-তাই!
পুরো শহর শুধু আলোর ঝলকানি দেখতে পাচ্ছি। এত্তো আলো এই শহরে এখন, অথচ রোজ মোমবাতি জ্বেলে প্রার্থনা ঘরে যেতাম আমরা; আর তুমি তখন সুর করে কোরআনের বাণী আওরাচ্ছ।
বৃষ্টির দিনে মোমের আলো পাশে রেখে ছায়াবাজি খেলতাম। ঘরে তখন মাঝে মাঝে গ্যাসের বাতি জ্বলত তখনও বিদ্যুৎ আসেনি এই শহরে আমাদের দিনগুলো তখনও যান্ত্রিক হয়ে উঠেনি। আমরা তখনও বিষাদের ছায়া গায়ে মাখতে শিখিনি তখন অবদি আমরা ভাবতাম এক সাথেই আমাদের দিন গুজরান হবে সকলের কিন্তু সেটা হয়ে উঠেনি আমরা এলোমেলো হয়ে গেছি খুচরা পয়সার মতো।
ট্যাক্সি এসে গেলো হোটেলের সামনে। রিসেপশনে দাঁড়ালাম। নাম লিখতে গিয়ে বিপত্তি -আপনি রাজনন্দিনী বইয়ের লেখক না? -কি বলবো! একবার ভাবলাম বলে দিই আর একবার ভাবলাম না চেপে যাই; লোকজন চোখ গোল করে তাকানো শুরু করবে সেটাও অস্বস্থিকর। চেপে গেলাম। চাবি নিয়ে সোজা চারতলায় চলে গেলাম। এসি চলছে।
এই শহর সত্যি কেমন ছবির মতো লাগছে। ছোট্ট মফস্বল এই কান্তনগর এতো বদলে গেছে !! বদলায় তো সব; শুধু স্মৃতি থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত তোমার দেখা পাবো তো অনি? হয়তো এই মাটিতে আর পা রাখা হতোনা আমার, কিন্তু আবার পা আমার পড়ে গেল এখানে।
বদলায় সব। চিন্তার জাল সাদা থেকে ঘোলাটে হয়। এই বদলানোর ঘোরপাকে না জানি তুমি কতখানি বদলে গেছ অনি?
পঁচিশ বছর পর পা রাখলাম এই শহরে।
পঁচিশটি বছর তোমার সাথে দেখা নেই। কান্তনগর, ছিমছাং নদী, নবীন চত্ত্বর, দোয়েল মাঠ কত কিছুতেই জড়িয়ে ছিলাম আমরা। হয়তো আমাদের সেই জড়িয়ে থাকা দিনগুলোতে আজকাল অন্য কেউ কেউ জড়িয়ে থাকে, থাক সে সব। ওদের মনেও কি অজানা কোন অভিমান জমে? যেমনটা জমেছিল আমার মাঝে হয়তো অজানা অভিমান আমাকে কষ্ট দিয়েছিলো আর তাই বিমুখ হয়েছিলাম, হয়তো কান্তনগরে পা পড়তোনা আমার কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসতে হলো।
সেদিন রুপগঞ্জের নতুন ষ্টুডিওর উদ্ধোধনী সভায় বক্তব্য রাখছিলাম। পেছন থেকে সুভাষ ঘোষ চোখ ইশারায় ডাকলেন। বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করে আসতেই বললো -এসো তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই বলেই একপাশে নিয়ে এলেন আমায় সদ্য রং করা চুল নিয়ে একজন দাড়িয়ে।
-ইনি হরনাথ চক্রবর্তী। পরিচালক। ওনার বেশ’কটা ছবি ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়েছে কিন্তু কিছুতেই ব্যবসা ধরে রাখতে পারছেন না। প্রায় একমাস ধরে আমরা পিছু নিয়েছেন, কাহিনী একটা চাই-ই চাই। তুমি তোমার ইচ্ছেমতো একটা কাহিনী লিখে দাও তাতেই উনি সিনেমা বানাবেন। বলে কি ! আমি তো ‘থ’
আমি প্রথমে না বললাম কিন্তু লোকটার মুখের দিকে চাওয়া যাচ্ছিল না তাই রাজি হয়ে গেলাম। তবে আগের মতো উৎসাহ আসেনা বলে আমি কিছুদিন সময় চেয়ে নিলাম। হলঘর ছেড়ে আমি বাইরে এলাম দরজার বাইরে একটা হাসির আওয়াজ আমাকে একটু থমকে দিলো সামনে তাকাতেই আমার চোখ আটকে গেল প্রান সঞ্চার করা একটা উচ্ছল হাসির কাছে। আমি একটু চমকে গেলাম। কিন্তু পরক্ষণেই হারিয়ে ফেললাম সেই হাসির মুখ।
বেশ’কটা টিভি চ্যানেল ক্যামেরা নিয়ে দৌড়াচ্ছে পাশেই একটা মিডিয়া সেন্টারে নতুন চ্যানেলের কনফারেন্স হচ্ছে সেখানে। আমি সুভাস দা’কে নিয়ে ওদিকে যাবো শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে হবে। এখানকার কনফারেন্সে লোকের ভীর যতটুকু তারচে বেশি ভীড় দর্শক পাঠকদের, অটোগ্রাফ শিকারীরা আর চ্যনেলের লোকেরাই জায়গা দখল করে নিয়েছে। সেইসব ভীড়ের মাঝে পুনরায় সেই হাসির ঝিলিক আমার চোখে হঠাৎ ঝলকানি দিলো।
আমার যে বয়স এখন, তাতে উঠতি তরুনীরদের দিকে তাকিয়ে থাকাটাই বেমানান তব্ওু আবারো তাকাতে হলো,বোধকরি হাসিটা দেখার জন্যই।
(২)
-দাদা চারমিনিটের একটা ছোট্ট সাক্ষাৎকার নিব একটু সময় দিতে হবে। আবারো ক্যামেরার সামনে বসতে হবে। হয়তো বসতাম না কিন্তু যখন দেখলাম উচ্ছল হাসির দাঁতগুলো আমায় দাদা বলে ডাকছে তখন একটু সময় করে, সময় দিয়ে ফেললাম। এগিয়ে এলো ও সাথে ক্যামেরা।
-আপনি তো রাজশ্রী’র স্রষ্টা ? আচ্ছা এটা কি কাল্পনিক নাকি বাস্তব কাহীনি? এই প্রশ্নের উত্তর শতবার দেয়া হয়ে গেছে তবুও বলতে হলো- এটা বাস্তব, তবে তারা কি হন আমার- সেটার উত্তর দিতে পারবো না। সেই উচ্ছল মেয়েটি মাইক্রোফোন ধরে স্মিথ হেসে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল; ঘোরের মাঝেই উত্তর দিচ্ছিলাম।
মনের ভেতর তীব্র বাসনা জাগল যে প্রশ্নটির- এই হাসি তুমি কোথায় পেলে? কোথায় যেন এই হাসিটি বহুবার কল্পনা করেছিলাম? কোথায় যেন এই হাসিটি আমি দেখেছিলাম। এই হাসিটা আমার খুব চেনা মনে হলো। মনে পড়ে গেলে এটা তোমার হাসি সেই তুমি যাকে আমি চিরটাকাল মনের পর্দা দিয়ে আড়াল করে রেখেছি। ‘সেই আমাদের অলক্ষ্যে বেড়ে উঠা অনি’
প্রশ্নপর্ব শেষ হয়ে যেতেই আমি উঠে দাঁড়ালাম সাহস করে মেয়েটিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তার আগেই মেয়েটি বলে বসলো, দাদা কান্তনগর শেষ কবে গেছেন?
-কান্তনগর!!
-বিষ্ময় আমার চোখ জুড়ে এলো
সেই তোমার হাসি যেন, এই হাসির মতো। আমার হৃৎপিণ্ড নড়ে উঠলো তোমার হাসি কোথায় পেল ও। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি নাম তোমার?
-আরুশা
-বাহঃ! সুন্দর নাম। এই চ্যানেলে কতদিন?
-তিন বছর। আপনার সব গল্পই আমার পড়া। রাজনন্দিনী কে নিয়ে যে শো’টা হয়েছিলো সেটার নির্দেশনায় ছিলাম।
-তাই নাকি!! বাড়ি কোথায় তোমার?
-কান্তনগর
-সত্যি !! ‘এবার আমার সত্যিই হতবাক হবার পালা’ -কান্তনগর কোন পাড়ায় তোমাদের বাড়ি?
-দোয়েল মাঠ
-তাই
আমি আরো হতবাক হতে থাকলাম যতক্ষণ না বরফ গলে যায় দুর্দান্ত রোদে। চারপাশের ভীড়ে আমি নিজেই কেমন চিরিয়া হয়ে গেছি তার উপর এতদিন পরে এই বরফ গলা অবস্থা। আমি ভাবিনি এতো তারাতারি আমি লুকিয়ে রাখা খাচার পাখির জালে আটকে যাবো। সাক্ষাতকার পর্ব শেষ করে মেয়েটি চলে গেল কিছু বলতে পারলাম না। বাইরে বেরুতে যাবো মনটা ডুবে যাওয়া পাতার মতো হাবুডুবু খাচ্ছে বয়ে যাওয়া অজানা হাওয়ায়।
সামনের গেট পেরুবো গাড়ি দাড়িয়ে আছে উঠতে যাবো এমন সময় সেই মেয়েটি আবার এলো এবার ক্যামেরা বিহীন।
-দাদা একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি? কিছু মনে করবেন না তো?
-নাহ্
-আপনার সব বন্ধুদেরকে নিয়েই তো আপনি লিখেছেন- কিন্তু একটা বন্ধুকে আপনি বরাবরই আড়াল করে এসেছেন; তার উপর কি এমন অভিমান আপনার?
‘আমি থমকে যেতে পারতাম কিন্তু গেলাম না তাতে আমার বিষাদ ছিটকে বেড়িয়ে যাবে’ তাই বললাম সময় তো ফুরিয়ে যায়নি লিখে ফেলবো একদিন! কিন্তু সে কথা তুমি কি করে জানলে বলো দেখি? মেয়েটি এবার চোখ মুড়িয়ে বললো- অনিলা চৌধুরী আমার খালা!
-আমার কথা ক্যামন যেন জড়িয়ে গেল। আর কিছু বলতে পারছিলাম না। আরুশার ফোন নম্বর নিয়ে কোন রকম পালিয়ে এলাম।
-পচিশ বছরের পুরোনো সেই মুখ। অনি। আমাদের বুদ্ধু-টিমের অনি। শান্ত নিরব একটা মেয়ে। ছোট বেলায় ব্যাথা পেয়ে কোনদিন কেঁদেছে কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে । খুব ভালো সাইকেল চালাতে পারতো। আমরা বুদ্ধুর দল রোজ বিকেলে বসে থাকতাম ট্রেনের জন্য। ট্রেন দেখবো লালরঙ্গা ট্রেন।
(৩)
রোদ উঠেছে সবে, বৃষ্টির পানিতে সব ধুয়ে মুছে গেছে। পথঘাট পরিস্কার কাল রাতে বয়ে গেছে ঝড় দূর্দান্ত দাপটের সাথে। কতদিন পর একটানা বৃষ্টি দেখলাম।
বৃষ্টি দেখতাম বেড়ে উঠার বয়সে। আমরা তখন স্কুলে পড়ি। তোমাদের বাড়ির দেয়াল টপকে যেতাম তোমার জানালার ধারে।
-অনি বাইরে আসো আজ বৃষ্টি নামবে? তুমি হাত নেড়ে বলতে আব্বু ঘরে আছে বকবে?
আমি তবুও থামতাম না। অনি তোমাকে আসতেই হবে? তুমি ভয় মাখা চোখে চেয়ে রইলো কিন্তু এলেনা। এই সময় বৃষ্টি নামলো আমি উদাস হয়ে ভিজলাম তোমাদের ঘরের কোনে। চোখে তখন চাররঙা স্বপ্ন তাই তোমার উপেক্ষা কষ্ট পেতাম না। ভালো লাগতো এই ভেবে যে, কোন একদিন তুমি হয়তো বকুনি উপেক্ষা করে আমার সাথে বেরুবে বৃষ্টিতে ভিজতে। তোমার হাতে হাজার ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে বহুবার কিন্তু আমার সাথে তোমার আর বৃষ্টি ভেজা দূর্বা মাড়ানো হয়নি।
অনি আগের ঠিকানায় ই আছে।
আজকাল কত কিছু লেখা হয়, কত চরিত্র রচনা করি কিন্তু অনি কে নিয়ে কোন কিছু লেখা হয়নি কখনো। এমনকি দু’লাইনের কবিতাও না অথচ আমরা কতো ভালো বন্ধু ছিলাম। ঠিক হাতের উল্টো পিঠের মতো। নীল সাগরের বন্ধু হলো চারপাশে থাকা অসংখ্য দ্বীপ আমি নীল সাগর ছিলাম চারপাশে ছিলো দ্বীপের মতো অনেক বন্ধু। অজানা অভিমান ছিন্ন করে আজ এসেছি সেই রেখে যাওয়া ছেড়াদ্বীপ টাকে দেখতে।
বাইরে বেরুলাম। রিক্সা নিয়ে চলে এলাম রূপশ্রী নাট্যশালায়। এখানেই তো আমার শুরু হয়েছিলো জীবন সাধনা। নাট্যকার রথীকান্ত’র খোজে ভেতরে ঢুকলাম। একজন পাখাওয়ালা এখানে দড়ি টেনে বাতাস করতো তার বদলে এখন এসি দেখে খানিকটা অবাক হলাম।
একজন এসে বললো দাদা কাউকে খুজছেন? -রথীকান্ত বাবু আছেন? -ও বড়দা তো ভেতরে
পা চেপে এলাম। নৃত্যের সাধনা হচ্ছে। পুরোনে সেই মঞ্চে রিহার্সেল হচ্ছে কোন এক নাটকের। রথীকান্ত আগের চেয়ে বুড়া হয়ে গেছে। চামড়ার ভাজ পুরো শরীর জুড়ে সেই মোটা ফ্রেমের চশমা।
-নমস্কার
-আরে তুমি কতদিন পর!! উনি উঠে এলেন আমি হাতজোড় করলাম
-তোমার হাতে তো ফুল ফুটছে আজকাল। চারিদিকে শুধু তোমার নাম। ভালো বাংলা সিনেমা মানেই তোমার কাহিনী। আমি তো চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি তোমার লেখনি দর্শকের হৃদয়ে নাড়া দেবেই-রথীকান্ত বাবুর কথা বেশ ক’জন শুনে ফেলেছেন, ইতি মধ্যে লোক জমে যাচ্ছে আবারও অস্বস্থি।
নীল ফতুয়া একজন হ্যান্ড শ্যাক করলেন ইতিমধ্যেই। সুদন্তি কি নিয়ে আপনার সব কটি লেখাই আমার প্রিয়, -ও তাই?
আমি এখান থেকে পালাতে চাইলাম পাছে কেউ না আবার লেখার কোন বিষয়ে কৈফিয়ত চায়।
কিছুটা সামলে বেড়িয়ে এলাম এবার অনি’র কাছেই যাবো।
তুমি কখনো চিঠিতে লিখতে না। তোমার কখনো মন খারাপ হয় না কি-না। আজকাল আমারও আর মনটন খারাপ হয় না। এই পঁচিশ বছরে তুমি চিঠি লিখেছো ছয়টি আর আমি পাচঁটি ‘তার মানে এখনো একটি চিঠি তোমার পাওনা রয়ে গেছে’। আমি চিরকালই তোমার কাছে ঋণী রয়ে গেলাম অনি?
পঁচিশ বছর আগে সেই ছিমছাং নদীর ধারে তুমি দাড়িয়ে বলছিলে এই নদী যে দিন সাঁতরে উপারে যেতে পারবো সেদিন নাকি আমি রাজা হবো! তখন ছোট ছিলো কত কি-যে বলতে।
তুমি হয়তো জানেনা আমাকে নদী পাড়ি দিতে হয়নি আমি এমনিতেই রাজা হয়ে গেছি তবে সেটা মনে মনে আমার রাজত্ব শুধু কাগজে কলমে।
তোমার শেষ চিঠিতে লিখেছিলে কখনো যেন মন খারাপ না করি তাহলে লেখায় সেটা ফুটে উঠবে; নিজে কাঁদবে অন্যকেও কাঁদাবে-এটা ঠিক না? চোখের জলটা বৃষ্টির পানি নয় যে মাটিতে মিশে গেলে সেটা জলরাশি হবে। ক্ষুদ্র কনা কয়েক ফোটাতে শুধু কষ্টই বাড়ে।
তারপর থেকে আমি মন খারাপ করিনা কিন্তু আজ কেন যেন মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি যতদুর ছিলাম তোমাকে আমার চোখের মধ্যে রেখেছিলাম। এখন তোমার খুব কাছে চলে এসেছি ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে তুমি সামনে এসে দাড়িয়ে পরেছ।
রিক্সা নিলাম। দোয়েল মাঠে যাবো।
পথ পেরুলেই নদী, আগে এখানে মানুষেরা আসতো দল বেঁধে।
নদীর ধারে নৌকার উপর সারি সারি ঘর। সন্ধ্যে হলেই মনে হতো কারা যেন প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। আমরা গুনতাম এক, দুই, তিন আমরা আরো গুনতাম ক্যালেন্ডারের পাতা-কবে আসবে নবীন চত্বরের মেলা কবে দু’জন সিনেমা দেখবো মেলার সিনেমা ঘরে। অমিতাভ, উত্তম, রেখা, নার্গিস আমাদের চোখ ধাধিয়ে তুলতো পটের পুতুল যদি হতে তুমি আমি আঁকাতাম তোমায়।
দোয়েল মাঠে নেমে তো হতবাক সারি সারি দোতলা বাড়ি। এর ভেতর থেকে তোমাদের বাড়ি খুজে বের করা মুষ্কিল। তবুও হাল ছাড়তাম না। আমি সামনে এগোলাম, কতজনকে না জানি জিজ্ঞেস করতে হয় এই ভাবছিলাম মাথার উপর সূর্য তখন ফুসছে সামনের গলিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম অনিলা চৌধুরীর বাড়ি যাবার রাস্তাটি কোন দিকে।
-কোন অনিলার কথা বলছেন ডাঃ অনিলা চৌধুরীর?
- হুম! কিন্তু অনিলা ডাক্তার হলো কবে? তাই তো কোন দিন জিজ্ঞেস করা হয়নি? বড় অন্যায় হয়ে গেছে। আবারও ভুল’ বৃদ্ধা গেট অবদি পৌছে দিলেন। সেই পুরোনো গেট। ভেতরে ঢুকলাম এক কিশোরী জিজ্ঞেসা করলো কাকে চাইছেন? আনিলা আছে? ডাক্তার আপা তো এখনো ফিরেনি? ওহ্ তাহলে বসি।
আমি বাড়ি থাকলে হয়তো এই সময়টা লেখাতেই কাটিয়ে দিতাম। আমি খুব আলসে ছিলাম বড় হবার কোন ইচ্ছে ছিলনা কিন্তু তোমার কথায় খুব অভিমান হয়ে যেতেই এমনটা হলো।
(৪)
আমি ওপাশ ফিরেছিলাম। তুমি বুঝে উঠতে পারনি হয়তো তাই আমার মুখের দিকে না তাকিয়েই বললো- দেখুন, এখন তো রোগী দেখতে পারবোনা কাল সকালে আসুন?
এমন সময় নাফিজা তাড়িয়ে ,এলো কাকে কি বলছিস অনি? তোমার গায়ে সাদা এপ্রেন, হাতে ডাক্তারি ব্যাগ পড়নে নীলডোরা শাড়ি সেই ছোট্র বেলীটির মতোই আছো। ছিমছাম প্রসাধনী বিহিন।
- তুমি হঠাৎ
- তোমায় দেখতে এলাম।
- দেখবার মতো তো কেউ নই আমি। পথে ভুল করে এলে না তো?
- অনেক টা সে-রকমই
আমাদের কথা চলছিলো রেল গাড়ীর মতো যেন গতকালও আমাদের কথা হয়েছে কিংবা আমরা খুব কাছাকাছি কথার তরী রোজ ভেরাই এমনটাই মনে হচ্ছে অথচ কথা বলছি পঁচিশ বছরে পর
- আমার কথা মনে ছিলো তোমার?
- থাকবেনা কেন? এই তো মনে করেই এলাম
- আরুশা নিশ্চয় বলেছে তোমায়?
- না এমনিতেও মনে ছিলো।
- মিথ্যা বলোনা পড়ে অস্বস্থি হবে?
-আমি থেমে গেলাম। এটা তো বোঝানো সম্ভব না। আমি যে অনিলাকে মনে রেখেছি এখনো আগের মতোই।
-আরুশার কাছে বলেছো আমি নাকি তোমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ? তা প্রিয় মানুষটির জন্য কিছু করেছিলে কখনো?
- নাহ্ তা করিনি মনেই রেখেছি মাত্র।
- সেই ভালো।
এমন সময় মাথা ভর্তি চুলওলা একটা ছেলে ব্যাট বল হাতে নিয়ে এলো মামনি ইনি কে?
তুমি শাড়ীর আঁচল টেনে বললে ইনি তোমার প্রিয় লেখক? – ওর নাম অরুপ। অরুপ হেসে বললো আপনি ঢিসুম ঢিসুমের গল্প লেখেন না কেন?
নাফিজা চা নিয়ে এলা। চা মুখে নিলাম কিন্তু মনে হলো সব কিছুতেই তেতো মিশে যাচ্ছে; সব স্বাদ নষ্ট হয়ে আসছে।
- অনিলা কেমন আছো?
- যেমন দেখছো।
- বাহির থেকে ভেতর বোঝা যায়?
- চোখ তো আছে। কবি হয়েছো কেন?
- তুমি যেন অনেকটা খাপছাড়া হয়ে আছো?
- পঁচিশ বছর আগেও তাই ছিলাম?
- মানুষ বদলায়।
তুমি চোখ থেকে চশমা নামিয়ে টেবিলে রাখলে তারপর বললে, আমি জানি তুমি ভালো আছো জীবনে যা না পেয়েছো তা কাহিনী-সিনেমায় ফুটিয়ে তুলেছো। জীবনে আকাশ ছুঁতে পারনি কিন্তু সিনেমায় পেরেছ। দেখ কি ভাগ্য আমার এতদিন পেরুলে ছবির এ্যালবামের মতো কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি শুধু বেচে থাকার জন্য রোগীর পাশে দাড়াই সেবা করি। এই পর্যন্তই।
আমার নাক দিয়ে দীর্ঘশ্বাস বয়ে গেল। আমি বললাম অনিলা তুমি ভালো নেই?
-মানুষকে কতখানি জানতে পেরেছ তুমি?
-কিছুটা
-তাই এ কথা বললে। এই শহরে কি কোন কাজে এসেছ?
- না এমনিতেই
- কদিন আছো?
-এখন আর থাকতে ইচ্ছে করছেনা। কাল চলে যাব।
-ঠিক আছে যাও।
আমি বুঝতে পারলাম তুমি আমার কথা এড়িয়ে গেলে
তোমার বিয়ের একটা কার্ড তুমি পাঠিয়েছিলে তাতে সবুজ কালিতে লিখেছিলে প্রতিমা দেখতে এসো বিসর্জনের আগে শেষ একবার হাসি মুখ দেখে নাও তখন ভেবেছিলাম তুমি হয়তো রহস্য করে লিখেছ কিন্তু এখন দেখছি তা সম্পূর্ন ভুল তুমি সত্যিই বিসর্জন হয়ে গেছ।
-তুমি কবে যে ডাক্তার হলে সেটা তো আমি জানি ই না
-তুমি কবে কবি হয়ে গেলে সেটা কি আমি জানতে চেয়েছি
-ডাক্তার আর কবি কি এক হলো
-রোগের চিকিৎসা আর মনের চিকিৎসা দুটোই সারাতে উপাদান লাগে
-মুখে সবসময় বিষণ্ন রঙ মেখে আছো যে?
-সুখের রঙ গুলো তোমাদের উঠোনে পড়ে আছে তো তাই
-তুমি সেই আগের মতোই আছো চিঠিতে কত অভিমান ছিলো এখনও রয়ে গেছে।
-তুমি তো জননী হওনি কিন্তু যে ছেলেটি মা ডাকলো সে কে?
-জননী না হলে বুঝি মা ডাক শোনা যায় না? ও আমার বোনের ছেলে
-জীবনটা নতুন করে সাজাতে পারতে?
-ঝরনা নদী হয়ে গেলে সাগরে চলে যায় কিন্তু সে কি নদীতে ফিরে আসতে পারে?
-নদী কিন্তু তার সমস্ত কিছু নিয়ে সাগরে ঝাপ দেয়
-তাতে নদীর স্বপ্নরা আর নিজের জগতে থাকেনা, মিশে যায় সাগরে
-তাই বলে নিজেকে তুমি এভাবে শাস্তি দিতে পার না
-পারি! ‘কেননা সৃষ্টিতে বৃষ্টি পড়ে সব ধুয়ে গেছে’
(৫)
আমি ঘাটের পাশেই বসে ছিলাম। ছিমছাং নদী
সন্ধ্যেয় আমার ট্রেন, ব্যাগ গুছনো হয়ে গেছে। রাতটা আমি কাটিয়েছি নাট্যশালায় ওদের নাটকের সংলাপে সংলাপে নিজেকে খুব করে সাজিয়েছি কখনো বাদশা, কখনো অনাহারি, কখনো সুপারম্যান, কখনও অন্ধ বালক সব চরিত্রেই নিজেকে তুলে ধরেছি কিন্তু কোনটাতেই মনে হয়নি আমি উপযুক্ত। আমি শুধু মানুষের জীবনকথা দিয়ে গল্প সাজাই কিন্তু নিজের জীবনের কথা দিয়ে একলাইন ও লিখতে পারলাম না কেননা আমি যখনই কিছু লিখতে যাই তখনই মনে হয় নিজের জীবনটা ছকে সাজানো হয় নি।
দুপুর শেষ হয়ে আসছে আমি উঠবো কিন্তু পা ধরে আছে পুরোনো স্মৃতিতে। কেন জানি মনে হচ্ছে আজ রোববার অনিলা একবারের জন্য হলেও ঘাটে আসবে সেই ছোটবেলার স্মৃতিটাকে মনে করতে। আমরা সবাই জানতাম আমরা সব বন্ধুরা মিশে আছি ছিমছাং নদীর ঘাটে রোববারের আড্ডায়। যে যেখানেই থাকি কান্তনগরে থাকলে রোববার আসবে স্মৃতিটাকে ঝালিয়ে নিতে। ঘণ্টাখানেক কেটে গেল আমি ডুবে রইলাম অজানা তন্দ্রায় আমাদের সব বন্ধুরা অজানা সব অভিমানে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে হয়তো কৈশরের সেই ঘটনাটাকে কেউ আমরা ভুলতে পারিনি।
গাড়ির হর্ন শুনে পেছনে তাকালাম অনিলা গাড়ি থেকে নেমে এপাশ-ওপাশ চাইলো। হয়তো ও জানে আমি আজ ঘাটে আসবো ওর জানা থাকলেও আমাকে খুজতে আসবেনা সে আমি জানি। কিছুক্ষণ ঘাটের পারে দাড়ালো আমি তখন নিজেকে আড়াল করেছি তারপর কি ভেবে গাড়িতে উঠে বসলো আমি ইচ্ছে করেই সামনে গেলাম না। রোদ পরে আসছে বিকেল হবে। গাড়িটা পাশ কাটাতেই উঠে দাঁড়ালাম। পোষ্ট অফিসে যাবো। হয়তো খোলা পেয়ে যেতে পারি।
যে কথা বলতে পারিনি আবার তাই কলম নিয়ে চিঠিতে আঁক কষলাম।
অনিলা একটা চিঠি তোমার পাওনা ছিলো।
তোমাকে দেখে মনে হলো আসলে মুখে তোমার হাসির ছটার আড়ালে একটা দুখী বন আছে যেখানে তুমি নিত্য উত্তাপ ছড়াও। তোমার যে অকাল বৈধব্য হয়েছে সেটা কিন্তু কোনদিন চিঠিতে জানাওনি। হয়তো তুমি কখনই হারতে চাওনি তাই।
আমি তোমাকে দুর থেকে একটা সুখী রমনী ভাবতাম হয়তো সে জন্যই তোমাকে নিয়ে কিছু লেখা হয়ে উঠেনি। আমার গল্পের নায়িকারা খুব দুখী হয় কিন্তু আজ দেখলাম তোমার দুখের কাছে তারা কিছুই না।
অনি বলতে পারো আমাদের সেই লালরঙা ট্রেনটা কেন জং ধরে ষ্টেশানে শুয়ে আছে? বলতে পারো কেন আমাদের হাত ধরে ট্রেন লাইনের শেষ আর দেখা হলোনা? জানি তোমার মুখে উত্তর নেই
নিজের জীবনের গল্প দিয়ে এবার নিশ্চই তুমি বিশ্বাস করবে ইচ্ছে শক্তিরা কখনো কখনো উপায়ের হাত ধরেও দুর্বল হয়ে পড়ে। জীবনকে কাগজের নৌকা করে ভাসানো ঠিক নয়; সে নৌকা ডুবে গেলে আশাগুলো ভাসে নদীর জলে সেখানে শুধু কষ্টরা ভেংচি কাটে রোজ দিনরাত্রি।
চিঠিটা দীর্ঘ করতে গিয়েও কেন জানি থমকে গেলাম। তাই কলমটা অনেকক্ষণ ধরে রেখে শেষে লিখলাম অনিলা আমি তোমার চোখ দেখেই বলে দিতে পারি আসলে তুমি ভালো নেই
______________________________________________
উৎসর্গ
অনি তোমাকে,