মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ফ্রান্স ও জার্মানিতে ধ্বনিতত্ত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন কিন্তু তাঁর ওই জ্ঞান কালানুক্রমিক-তুলনামূলক পদ্ধতিতে ভাষার ইতিহাস পুনর্গঠন প্রয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। অথচ আধুনিক ধ্বনিতত্ত্বে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম বাঙালিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। বাংলাদেশের ‘আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ সম্পাদনা এবং বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা—এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কর্মও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র বাংলা ভাষাতত্ত্বে বিশেষ অবদান। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের বিশ্লেষণে প্রখ্যাত ইংরেজ ধ্বনিবিদ ড্যানিয়েল জোনসের ইংরেজি ভাষার ফোনিম নির্ণয়ের পদ্ধতি অনুসরণে শিষ্টকথ্য বাংলার ফোনিমগুলো নির্দেশ করেছিলেন, তিনি বিচ্ছিন্নভাবে বাংলা ধ্বনিমূলগুলো শনাক্ত করলেও ভাষায় ব্যবহারে ওই ধ্বনিমূলগুলোর মধ্যে যে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয় তার আলোচনাকে সে বিশ্লেষণে সম্প্রসারিত করেননি।
সে কাজটি সম্পন্ন করেন বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় বর্ণনামূলক ধ্বনিতাত্ত্বিক আলোচনার পথিকৃত মুহম্মদ আবদুল হাই। তিনি বিলেতে অধ্যাপক জে. আর ফার্থের তত্ত্বাবধানে বাংলার নাসিক্যধ্বনি এবং নাসিক্যভবন সম্পর্কে যে ধ্বনিতাত্ত্বিক গবেষণা করেন তার ফল ইংরেজি ভাষায় A phonetic and phonological study of nasals and Nasalization in Bengali. (১৯৬০) গ্রন্থে প্রকাশিত। দেশে প্রত্যাবর্তন করে অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই Standard বা শিষ্ট কথ্য বাংলা ভাষার ধ্বনি এবং ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণে ব্রতী হন এবং তাঁর গবেষণালব্ধ ফল ‘ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ (১৯৬৫) নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের এই গ্রন্থটি অদ্যাবধি বাংলা ভাষায় রচিত বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব পর্যালোচনার সর্বাধিক গভীর বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ। আবদুল হাই এ গ্রন্থে বাংলা স্বরধ্বনির সংখ্যা, দ্বি-স্বর এবং অর্ধস্বরের গঠন, ব্যঞ্জনধ্বনিগুলোর ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিচয়, বাক্প্রবাহে ধ্বনির রীপ, সন্ধি ও সামগ্রিকীভবন, ধ্বনিগুণ এবং স্বরতরঙ্গ বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। এই বিশ্লেষণে বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে তিনি যে দৃষ্টান্তের পর্যালোচনা করেন, তার অজস্রতা ও ব্যাপকতা সত্যিই বিস্ময়কর। এতে বোঝা যায় যে, আলোচ্য গবেষণাটি যথার্থ ফিল্ডওয়ার্ক বা ক্ষেত্রীয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে সম্পন্ন।
মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ধ্বনি বিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব বাংলা ভাষায় বাঙালির মুখের ভাষার Standard বা শিষ্ট রূপের প্রথম বিস্তৃত ফোনেটিক বিশ্লেষণ। এ গ্রন্থে যদিও তিনি মূলত উচ্চারণ স্থান ও উচ্চারণ রীতির মাপকাঠিতে কথ্য বাংলার ধ্বনিগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু সে কাজে তিনি নকল তালু ও কাইমোগ্রাফ যন্ত্রের সহায়তা গ্রহণ করেন। শুধু বিচ্ছিন্ন ধ্বনি শনাক্তকরণ নয়, বাক্প্রবাহে বিভিন্ন অবস্থানে অন্যান্য ধ্বনির সংস্পর্শে তাদের যে রূপান্তর, তাও তিনি বিস্তৃতভাবে পর্যবেক্ষণ এবং ধ্বনিগুলোর সে বৈশিষ্ট্যকে ‘ধ্বনিগুণ’ শীর্ষক অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করেছেন। মুহম্মদ আবদুল হাই বাংলা ভাষায় প্রথম বাংলা ধ্বনিগুলোর ধ্বনিগুণের পরিমাপক, অধ্যাপক জে.আর ফার্থের ‘প্রসডিক’ পদ্ধতিতে তিনিই প্রথম বাংলা ধ্বনিগুলোর বিস্তৃত ধ্বনিতাত্ত্বিক বিশ্লেষণকারী। অধ্যাপক আবদুল হাইয়ের পর অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বের প্রবর্তক লিওনার্ড ব্লুমফিল্ডের পদ্ধতির অনুসরণে অধ্যাপক চার্লস ফার্গুসনের সঙ্গে মিলিতভাবে বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের বিশ্লেষণ করেন। ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরীর বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব বিশ্লেষণ ফোনেমিক পদ্ধতিতে সম্পন্ন, এই বিশ্লেষণে তাঁরা নতুনভাবে বাংলা অর্ধস্বরধ্বনি নির্ধারণ ও বিশ্লেষণ এবং প্রাগ স্কুলের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য পদ্ধতি অবলম্বনে সর্বপ্রথমে বাংলা ধ্বনিগুলোর বৈপরীত্যসূচক বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু তাঁদের আলোচনা ছিল ইংরেজি ভাষায় এবং 'খধহমঁধমব' পত্রিকায় প্রকাশিত। সুতরাং বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের এই অভিনব বিশ্লেষণটি বাংলাভাষী পাঠকদের জ্ঞানের বাইরে থেকে যায়। মুনীর চৌধুরী পরবর্তী সময়ে ‘বাংলা একাডেমী’ পত্রিকায় ‘সাহিত্য, সংখ্যাতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্ব’ বিষয়ে বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখলেও পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধের অনুবাদ বা ওই বিষয়ে বাংলায় কিছু লেখেননি। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ভাষাতাত্ত্বিক 'Some Supra-Segmental Phonological Features of Bengali' (১৯৮৪) ইংরেজিতে।
সাংগঠনিক ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে কথ্য বাংলার ধ্বনি ও রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়াস রয়েছে আমার ‘ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৭০) গ্রন্থে। আমার ভাষাতত্ত্ব শিক্ষা লিওনার্ড ব্লুমফিল্ডের ছাত্র চালর্স এফ. হকেটের কাছে। সুতরাং আমার ভাষাতাত্ত্বিক ধারণা বর্ণনামূলক পদ্ধতির সাংগঠনিক বিশ্লেষণ রীতি দ্বারাই গঠিত। আর সে কারণে আমি ‘ভাষাতত্ত্ব’ গ্রন্থে সাংগঠনিক রীতিতে একটি ভাষার ধ্বনি ও রূপ সংগঠন বিশ্লেষণের পদ্ধতি এবং তার প্রয়োগে বাংলা ধ্বনি ও রূপ সংগঠন বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছি। তবে আমার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ থিসিস 'ইবহমধষর এত্ধঢ়যবসরবং' (১৯৬০) এবং মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত মনোগ্রাফ 'Introduction to Eastern Bengali Dialect' (১৯৬৩) বাংলায় অনূদিত বা প্রকাশিত হয়নি। প্রসঙ্গক্রমে স্বীকার্য যে, আমি কথ্য বাংলার ধ্বনিসংগঠন বিশ্লেষণে চার্লস ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরীকে এবং রূপ সংগঠন বিশ্লেষণে চার্লস ফার্গুসনকে অনুসরণ করছি। ধ্বনিমূল, সহধ্বনিমূল, রূপমূল, সহরূপমূল ধারণা প্রয়োগ করে চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাংগঠনিক ভাষাতত্ত্বের যে বিকাশ হয়, বাংলা ভাষায় বাংলা ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় আমি তা সংযোজন করার প্রয়াস পেয়েছি। আমার গ্রন্থে কালানুক্রমিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব সম্পর্কে যে অধ্যায় রয়েছে সেখানে আমি 'খধহমঁধমব্থ গ্রন্থে ব্লুমফিল্ডের আলোচনার অনুসরণ করেছি।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব-চর্চা রূপান্তরমূলক যুগে প্রবেশ করে সত্তর দশকে যখন আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে ভাষাতত্ত্বে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ‘বাংলাভাষা তত্ত্ব’ (১৯৭৫) নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থে তিনি ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সাধারণ পাঠককে পরিচিত করানোর প্রয়াস পান। আলোচ্য গ্রন্থে তিনি ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনায় সাংগঠনিক পদ্ধতি এবং শব্দতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে প্রধানত চমস্কি প্রবর্তিত পদ্ধতির প্রয়োগ করেন। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় চমস্কির পদ্ধতি তিনিই প্রথম প্রয়োগ করার দাবিদার। ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি কেনেথ এল পাইক এবং চার্লস হকেট আর শব্দতত্ত্ব বিষয়ে চমস্কির পদ্ধতি মূলত অনুসরণ করলেও হ্যারিস এবং বোলিনজার আদর্শের সহায়তাও গ্রহণ করেন। বাক্যতত্ত্ব আলোচনায় এ গ্রন্থে ফ্রিজের কথা স্মরণ রেখে চমস্কি পদ্ধতি গৃহীত হয়। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং ‘বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম’ সম্পর্কে গবেষণা করেন যা ্তুRelativization in Bengali (১৯৮৬)’ নামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত।
এছাড়াও আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৮৫) নামে একটি বৃহদাকার গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এ গ্রন্থের বিভিন্ন অধ্যায়ে ভাষাতত্ত্বে বিভিন্ন শাখা ও পদ্ধতি, ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, ভাষার শ্রেণীবিন্যাস, উপভাষাতত্ত্ব লিখনরীতি, ভাষাতত্ত্ব-চর্চার ইতিহাস, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব এবং বাগার্থতত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে। বাক্যতত্ত্ব অধ্যায়ে তার আলোচ্য বিষয়, প্রথাগত ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্ব, সাংগঠনিক বা গঠনমূলক ব্যাকরণ বাক্যতত্ত্ব এবং রূপান্তরমূলক ব্যাকরণে বাক্যতত্ত্ব। এ গ্রন্থে বাংলা বাক্যতত্ত্ব ও রূপান্তরমূলক সূত্র প্রয়োগ সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, চলতি বাংলার বাক্যতত্ত্ব বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে চমস্কি প্রবর্তিত রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের সূত্র সম্পূর্ণ প্রয়োগযোগ্য নয়। চমস্কি কারক সম্পর্কে কোনো সূত্রের উল্লেখ করেননি। পরবর্তীকালে ফিলমোর (১৯৬০) সে সব ভাষায় বাক্যতত্ত্ব বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কারকের গুরুত্ব বিদ্যমান, কারক বিষয়ক নতুন সূত্রের ব্যবহার করে বাক্যতত্ত্ব বিশ্লেষণের নতুন সূত্র সংযোজন করেন। বাংলা বাক্যতত্ত্বে ব্যাকরণগত উপাদানের জটিলতার জন্যে রূপান্তরমূলক ব্যাকরণের কয়েকটি সূত্রের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের এডিনবরার গবেষণা কমিটির বাংলা রূপান্তর ‘বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম : গঠন ও প্রকৃতি’ (১৯৮৫) গ্রন্থে বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম, সর্বনামীয় বাক্যাংশ এবং সম্বন্ধবাচকতা গঠনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। বিষয়বস্তু অনুসারে গ্রন্থটি দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত, প্রথম পর্যায়ে বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনামীয় বাক্যাংশ গঠনের বিভিন্ন দিক এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে কয়েকটি রূপান্তরমূলক সূত্রের সাহায্যে বিভিন্ন ভাষাতাত্ত্বিক গঠনের মধ্যে সম্বন্ধবাচক সর্বনাম যেভাবে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব, সে সম্পর্কে তত্ত্বগত দিকনির্দেশ। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের আলোচ্য বিষয়, বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম, এই শ্রেণীর সর্বনাম দ্বারা গঠিত বাক্যাংশ, সম্বন্ধবাচক সর্বনাম ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বা আপেক্ষিক সর্বনাম জটিল বাক্যে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে যেভাবে সর্বনামীয়করণ প্রক্রিয়া সাধিত হয়, তার বর্ণনা এবং রূপান্তরমূলক সূত্রের প্রয়োগে বাংলায় সর্বনামীয়করণের বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণ। বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম বা সর্বনামীয় বাক্যাংশের ওপর তেমন বিস্তৃত আলোচনা ও তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা না থাকায়, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদকে বিভিন্ন শ্রেণীর সর্বনামীয় বাক্যাংশ ও সূত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা উদ্ভাবন করতে হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ঝঃধহফধত্ফ বা শিষ্ট চলতি বাংলা ভাষার সঙ্গে নোয়াখালী উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক ও বাক্য গঠনগত পার্থক্য নিরূপণে সাংগঠনিক পদ্ধতি অনুসরণ করলেও বাক্যতত্ত্বে চমস্কি পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভব কিনা তা পরীক্ষা করেন এবং বাংলা ভাষার বাক্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ওই পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন। তাঁর এ গ্রন্থটির নাম A Study of Standard Bengali and the Noakhali Dialect (১৯৮৫). বাংলাদেশে চমস্কি প্রবর্তিত ‘রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল’ ভাষাতত্ত্বের সবচেয়ে উত্সাহী প্রবক্তা ও অন্যতম পথিকৃত্ হুমায়ুন আজাদ, তিনিও ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিদেশে হুমায়ুন আজাদের গবেষণা বিষয় ছিল ্তুPronominalistation in Bengali’ (1983) ইংরেজি ভাষাতেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ ফিলমোর’র Case Grammer এবং চমস্কির Aspect-এর পরবর্তী মডেলের মিশ্র ভিত্তিতে গঠিত একটি কাঠামোতে বাংলা সর্বনাম প্রধান বাক্য গঠনের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন।
হুমায়ুন আজাদ অবশ্য তার বিদেশে গবেষণার ফল দেশে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি বাংলা ভাষায় ‘বাক্যতত্ত্ব’ (১৯৮৫) নামে একখানি বড় গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। গ্রন্থটিতে তিনি বাক্য, প্রথাগত বাক্যতত্ত্ব, সাংগঠনিক বাক্যতত্ত্ব সম্পর্কে প্রথম তিনটি পরিচ্ছেদে বিশদ আলোচনার পর রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা এবং সেই তত্ত্ব বাংলা বিশেষ্য পদ এবং বাংলা সর্বনামীয়করণের ওপর প্রয়োগ করেছেন। পাঠকদের সুবিধার জন্য পরিশিষ্টে তিনি প্রথাগত ব্যাকরণ এবং সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে দু’টি পরিচ্ছেদে আলোচনা রেখেছেন। গ্রন্থটি শেষ হয়েছে প্রথাগত, সাংগঠনিক ও রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের তুলনার মধ্য দিয়ে। ‘বাক্যতত্ত্ব’ গ্রন্থে হুমায়ুন আজাদ মূলত বাংলা বিশেষ্যপদ এবং সর্বনাম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, বাংলা ক্রিয়াপদ সম্পর্কে নয়।
হুমায়ুন আজাদ ‘প্রথাগত’, ‘সাংগঠনিক’ ও ‘রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ’-এর তুলনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন। সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান জন্মেছে প্রথাগত ব্যাকরণে প্রতিক্রিয়ায় এবং রূপান্তর ব্যাকরণ উদ্ভূত হয়েছে প্রথাগত ব্যাকরণে প্রেরণায় ও সাংগঠনিক প্রণালীর প্রতিক্রিয়ায়। সাংগঠনিকরা প্রথাগত ব্যাকরণকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছিলেন : তাঁদের দৃষ্টিতে প্রথাগত ব্যাকরণ বিশৃঙ্খলা ও অবৈজ্ঞানিক। রূপান্তরমূলক ভাষা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রথাগত ব্যাকরণের চেয়েও দুর্বল সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞান, কেননা তা ভাষার সৃষ্টিশীলতায় বিশ্বাস না করে ভাষার খণ্ডাংশের বহিরঙ্গের বর্ণনাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। রূপান্তরবাদীরা সাংগঠনিক প্রণালী পরিত্যাগ করেছেন : তাঁদের বোধে সাংগঠনিক ব্যাকরণ ছদ্ম বৈজ্ঞানিক তা বিজ্ঞানের বহিরঙ্গের অনুকরণ করেছে মাত্র। রূপান্তর ব্যাকরণ পুনরায় যোগসূত্র রচনা করেছে প্রথাগত ব্যাকরণের সঙ্গে। [কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান (১৯৮৮)] বাংলাদেশে আরও যাঁরা ভাষাতত্ত্ব-চর্চায় রত তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কাজী দীন মুহম্মদ, মনিরুজ্জামান, মনসুর মুসা, রাজীব হুমায়ুন, দানীউল হক, আজিজুল হক প্রমুখ। কাজী দীন মুহম্মদ লন্ডনের SOAS-এ ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন এবং বাংলা ব্যাকরণের ক্রিয়াবাচক পদের সংগঠনে ধ্বনিতাত্ত্বিক সূত্রসমূহ পরীক্ষা করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভটি ইংরেজি ভাষায় রচিত এবং Zv ‘The Verbal Structure in Colloquial Bengali’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ক্রিয়াপদ ও তার ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ক এই গবেষণাটি বাংলা ভাষায় এখনও রূপান্তরিত বা প্রকাশিত হয়নি। তবে ‘বাংলা ক্রিয়াপদ’ (বাএপ ১৪.৩ কা-পৌ), ‘বাংলা ক্রিয়া : ব্যাকরণ সংক্রান্ত শ্রেণীবিভাগ’ (সা প ৯.১ বর্ষা ১৩৭২) এবং ‘বাংলা ক্রিয়াপদের রূপ’ (সা প ১৯৬৫), এই তিনটি প্রবন্ধ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মহিশুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর গবেষণা করেন। তাঁর বিষয় ছিল ‘Controlled Historical Reconstruction based on five Bengali Dialects.’ তিনি পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি প্রধান উপভাষার উপাদানের ভিত্তিতে পশ্চিম বাংলার ভাষার প্রত্নরূপ পুনর্গঠন এবং ভূ-চিত্র অঙ্কন করেন। তাঁর গবেষণা কমিটির বাংলা রূপান্তর এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে বাংলায় ‘ভাষাতত্ত্ব অনুশীলন’ নামক তাঁর একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। এই সঙ্কলনে ‘বাংলাদেশে ভাষা ও উপভাষাতত্ত্বের অনুশীলন’, ‘সংস্কৃত ও রুশ ভাষা : তুলনা’ কুমিল্লা উপভাষায় ব্যক্তি সর্বনামরূপের ধ্বনিগঠন ও রূপমূল-সমস্যার বিকল্পতত্ত্ব’ প্রভৃতি ভাষাতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধাবলী রয়েছে। মনিরুজ্জামান ভারতের উদয়নারায়ণ সিংহের সঙ্গে যৌথভাবে মাঠ পর্যায়ে একটি গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেন, বিষয়টি ছিল—Using Diglossic Style in Bengali in verying social contexts : A case study of Bangladesh Bengalees. এ গবেষণাকর্মটি ইংরেজি ভাষায় ÔDiglossia in Bangladesh and language Planning’ (1983) নামক গ্রন্থে প্রকাশিত। তবে এটি বাংলা ভাষায় এখনও রূপান্তরিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনসুর মুসার ভাষাতত্ত্ব-চর্চা সাধারণভাবে সমাজভাষাতত্ত্ব এবং বিশেষভাবে ভাষা পরিকল্পনা বিষয়ে কেন্দ্রীয়ভূত। তিনি ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে সিংহলের ভাষাপরিকল্পনা নিয়ে এবং হাওয়াই ইস্টওয়েস্ট সেন্টারে সমাজভাষাতত্ত্ব তথা ভাষাপরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন। সিংহলের ভাষা পরিকল্পনা বিষয়ক তাঁর অভিসন্দর্ভটি অদ্যাবধি বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি। তবে সমাজভাষাতত্ত্ব তথা ভাষা পরিকল্পনা বিষয়ে গবেষণা করেন। তবে সমাজভাষাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর দুটি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে, যার প্রথমটি ‘ভাষা পরিকল্পনা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ (১৯৮৪) এবং দ্বিতীয়টি ‘বাঙলা পরিভাষা : ইতিহাস ও সমস্যা’ (১৯৮৫)। ভাষা পরিকল্পনা বিষয়ক গ্রন্থটিতে মনসুর মুসার যেসব প্রবন্ধ রয়েছে তার মধ্যে ভাষা পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক হলো : ‘বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি’, ‘তুর্কী ভাষা আন্দোলন’, ‘ঔপনিবেশিক ভাষানীতি প্রসঙ্গে’, ‘ভাষা পরিকল্পনা’, ‘বাংলা ভাষা ও প্রশাসনিক নির্দেশ’, বাংলা প্রচলন সংক্রান্ত বিবেচনা’। মনসুর মুসার দ্বিতীয় গ্রন্থটি বাংলা পরিভাষার ইতিহাস ও সমস্যা বিষয়ক। এ গ্রন্থে তিনি পরিভাষার সমস্যা এবং বাংলা ভাষায় পরিভাষা প্রণেতাদের মোটামুটি পরিচয় দিয়েছেন; তবে তা সংক্ষিপ্তভাবে : বাংলা ভাষায় পরিভাষা প্রণয়নে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পথিকৃত্ ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’, এ প্রচেষ্টা বাংলা পরিভাষা প্রণয়নে কতটা অগ্রসর হতে পেরেছিল গ্রন্থে তার পরিচয় থাকলে গ্রন্থের নামের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হতো।
রাজীব হুমায়ুন ভাষাতত্ত্বে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন ডেকান কলেজ, পুনেতে। সেখানে তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘Descriptive Analysis of Sandipi in its Socio-Cultural Context.Õ এই গবেষণাকর্মটির একটি বাংলা সংস্করণ ‘সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাজীব হুমায়ুন শিষ্ট কথ্য বাংলার সঙ্গে সন্দ্বীপের উপভাষার তুলনা এবং সন্দ্বীপী উপভাষার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নির্দেশ করার প্রয়াস পান। তাঁর এই কাজটিকে বিশুদ্ধ সমাজ-ভাষাতাত্ত্বিক বলা না গেলেও তিনি যে উপভাষা বর্ণনায় সামাজিক প্রেক্ষাপটকে ভিত্তি করেছেন তা স্বীকার্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দানীউল হক হনলুলু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন এবং ভাষাতত্ত্বের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর কিছু বাংলা প্রবন্ধ এবং ‘ভাষার কথা : ভাষাবিজ্ঞান’ (১৯৯০) নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আজিজুল হক বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন এবং দেশে ফিরে ‘ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্ত’ (১৯৯০) নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে, ভাষা, ভাষাতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্বের কালান্তর,
ভাষাতত্ত্বের নতুন দিগন্ত, সীমিত সূত্র ব্যাকরণ, বাক্যাংশ সংগঠন ব্যাকরণ, রূপান্তরিক ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্বের সাম্প্রতিক প্রগতি এবং প্রকৃতি, ধ্বনিতত্ত্ব, শব্দার্থতত্ত্ব, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব এবং অসামাজিক ভাষাতত্ত্ব। ১৯৬৫ থেকে ১৯৮৫ এই বিশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে বাংলা ভাষায় যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর রচয়িতারা সবাই বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বশাস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তাঁরা সবাই দেশে ফিরে তাঁদের ভাষাতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ফল বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এর ফলে যে বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব-চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু এ গবেষকদের ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্লেষণ পদ্ধতি বিদেশি, যদিও স্বদেশে তাঁরা মূলত বাংলা ভাষাতেই ভাষাতত্ত্ব-চর্চা করছেন তবুও একথা বলা যাবে না যে, দেশের জীবিত ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে কেউ ভাষাতত্ত্বের তাত্ত্বিক বা পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক অবদান রাখতে পেরেছেন। কালানুক্রমিক-তুলনামূলক, সমাজ-ভাষাতত্ত্ব যে কোনো পদ্ধতিতেই হোক না কেন, তাঁরা এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার বৈশিষ্ট্য থেকে উদ্ভূত কোনো গবেষণা পদ্ধতির উদ্ভব ঘটাতে পারেননি, এমনকি তাঁরা কেউ আধুনিক পদ্ধতিতে বাংলা ভাষার একটি ব্যাকরণও রচনা করেননি। তাঁদের কৃতিত্ব ভাষাতত্ত্বের প্রায় প্রতিটি শাখায় বাংলা ভাষায় গবেষণাকর্ম পরিচালনা। কিন্তু এখন বোধহয় সময় হয়েছে বাংলা ভাষা বিশ্লেষণের জন্য বাংলা ভাষার ধারণা থেকে উদ্ভূত নিজস্ব পদ্ধতির উদ্ভাবনা এবং তার মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ। বিশেষত বাংলা ভাষায় খাঁটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা, যা ছাত্র-ছাত্রীদের কাজে লাগতে পারে বা বয়স্কদের কীভাবে অতি অল্প সময়ে বাংলা ভাষা পড়তে ও লিখতে শেখানো যায়, সে পদ্ধতি উদ্ভাবন করা। তাহলে বাংলাদেশে ভাষাতত্ত্ব-চর্চায় সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা আসবে, অন্যথায় তা উন্নত দেশগুলোর ভাষাতত্ত্ব-চর্চার অনুকরণসর্বস্ব টীকাভাষ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
(মু হা ম্ম দ ম ন জু র হো সে ন খা ন)