পৃথিবীতে কত নামেই না সশস্ত্র সংগাম চলছে। স্বাধীনতা,স্বৈরাচার থেকে মুক্তি,ক্ষমতা দখলের লড়াই, দেশকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে আসলে যুদ্ধই চলছে। ঘটছে অর্থ ও নৈতিক মূল্যবোধেরও অবনতি। আর অর্থ ও সরাসরি অংশগ্রহনকারীদের প্রাননাশ তো বলাই বাহুল্য। সাথে সবচেয়ে বেশী যাদের ক্ষতি ও প্রান যাচ্ছে, তারা হলো সাধারন জনসাধারন তথা নারী ও শিশু।
আমার আজকের লেখাটা এমনই এক অসহায় শিশুর বিষয় নিয়ে যা সেদিন পত্রিকা পড়তে যেয়ে পড়তে পড়তে মনকে যুদ্ধের বিভিষীকাময় অন্ধকার দিকটা তুলে ধরেছে। মনটা ছুয়ে গেছিল বলে ভেবে রেখেছিলাম ঘটনাটা আরো অনেককে জানাবো। আর কিছু না হোক যুদ্ধ যে কি বিষফল প্রসব করে তা অন্ততঃ যেন আমরা অনুধাবন করতে পারি।
বরাবরই অরাজকতায় ভরা এই দেশটিতে খুব সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গার কথা শোনা গেছে। শত অরাজকতার মাঝেও সব ধর্মের লোকরাই একসাথে বসবাস করতো। এটা চরমে পৌছুলো যখন উত্তরের মুসলিম বিদ্রোহীরা প্রেসিডেন্টকে তাড়িয়ে রাজধানী দখল করে ক্ষমতায় বসলো। তারপর শুরু করলো খৃষ্টান সম্প্রদায়ের উপর হামলা-লুট আর হত্যা। শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর যুদ্ধ। একসময় এই বিদ্রোহীগ্রুপ যা সেলেকা নামে অভিহিত বিতারিত হলো রাজধানী থেকে তখন থেকেই শুরু প্রতিশোধের পালা।
ঘটনাটা মধ্য আফ্রিকান রিপাবলিকের কারনট নামক স্থান থেকে APর এক সাংবাদিকের লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। সাংবাদিকটি একটি আশ্রয়কেন্দ্রের ভিতর বসে সাক্ষাৎকার,প্র্যক্ষদর্শীদের সাথে আলাপ করে টুকরো টুকরো ঘটনাকে একসুত্রে তুলে ধরেছে।( আমি সেটাই এখানে মেলে দিলাম)। সন্ধ্যের পর গ্রামের বাহিরে গুলির আওয়াজ হতেই গ্রামবাসীরা তাদের খাবার-নিদ্রা ফেলে পলায়ন করলো পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে। এমনকি হতভাগীনী ১০ বছর বয়সি হাম্মামাতু হারুনার মাও কোলের সাথে ছোট দুটি ভাইবোন নিয়ে পালিয়ে গেল হারুনাকে ফেলে। মা ফেলে গেল বোঝার ভয়ে আর শিশুমেয়েটা ইচ্ছে থাকা সত্বেও নিজের অথর্বতার জন্য। কারন মেয়েটি ছিল পোলিও রোগী। হাটতে পারতো না। চলতে হতো হামাগুড়ি দিয়ে। সুতারাং সে শুধু অপেক্ষা করতে লাগলো রাষ্ট্রের এই খৃষ্টান-মুসলিম ক্ষমতা দখলের নৃশংস বলী হবার।
হঠাৎ করেই তাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে এলো তার দুই বছরের বড় ভাইটি,সুলায়মানে। কষ্ট হলেও পঙ্গু বোনটাকে পিঠে করে কোনভাবে ভাইটি জঙ্গলের গভীরে পৌছে গেল। এরই মাঝে খৃষ্টান যোদ্ধারা গ্রামে পৌছে প্রতিটি ঘরে খুজে খুজে হত্যাকান্ড চালাতে শুরু করে দিয়েছে। বন্দী করার কোন ব্যাপার নেই। একমাত্র ফয়সালা গুলি বা ম্যাচেটে কুপিয়ে খুন। গত কয়েক বৎসরে মধ্য আফ্রিকার ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত ৪৬ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটাতে খৃষ্টান-মুসলিম সংঘর্ষে উভয় পক্ষে কয়েক হাজার লোকের প্রানহানী ঘটেছে।
ইউনিসেফের এক হিসাবে শুধুমাত্র ৫লক্ষ শিশু গৃহহারা হয়ছে। যার মাঝে অনেকেই আছে গহীন জঙ্গলে লুকিয়ে। কয়েক হাজার হাজার হরিয়েছে তাদের পিতা-মাতা,ভাই-বোন। কেউ কেউ পরিবারের সবাইকে।। ঠিক এটাই ঘটলো হারুনা এবং তার ভাইএর বেলায়। গ্রামের দখল বিরোধীদের হাতে চলে যাওয়ায় ঘরে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে সামনে লাল মাটির পথ আর গাছের ছায়ায় বসে যা পাওয়া তাই খাওয়ার মধ্যেই তাদের দিন কাটতে লাগলো।হারুনাদের গ্রামটি ছিল ২৫০০ অধিবাসী অধ্যুষিত। এমনই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে বর্ষাকালে সেখানে যতেও খুব কষ্ট হতো। অধিবাসীরা বেশীর ভাগই মাইনার হিসাবে কাজ করতো। আজ মাত্র তিনটি ঘরের অধিবাসীরা আছে,তাও খৃষ্টান বলে।
জীবনটা এমনিতেও হারুনার প্রতি সদয় ছিল না। ৭বছর বয়সে পিতৃহারা এই মেয়েটি আক্রান্ত হয় পোলিও রোগে। যা তার পাকে আক্রমন করে। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাওয়া পায়ের সব শক্তি হারিয়ে যায়।। কিন্তু এতকিছুর পরও পরিবারের খাবার যোগানে সে তার মাকে সাহায্য করেছে ছোট ছোট প্লাস্টিক ব্যাগে লবন এবং ওকরা বিক্রয় করে। স্বাভাবিক ভাবেই স্কুলের চৌহদ্দিতে যাবার ভাগ্য হারুনার হয় নি।।
২বছরের বড় ভাইটি অর্থাৎ পরিবারের বড় সন্তানটি কাধে তুলে নেয় পিতার ভার। সংসারে অর্থ যোগানোর পাশাপাশি কিনে আনতো বোনের জন্য বিভিন্ন সময় সখের জিনিসও। গ্রামে আক্রমনের দিনটিতেও সুলায়মানে তার অচল বোনটাকে ছেড়ে যেতে পারে নি। তাকে কাধে নিয়ে জঙ্গলের গভীর থেকে গভীরে যেতে থাকে, মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে। একটাই লক্ষ্য পরবর্তি গ্রাম।একসময় তাও দুরঅস্ত হয়ে উঠলো। পরিস্কার ভাবে ফুটে উঠলো এভাবে কোনদিনও তারা নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবে না। একসময় বোনটিকে মাটিতে নামিয়ে সুলায়মানে বললো যে সে সাহায্যের জন্য যাচ্ছে। যদি না ফিরে আসে তাহলে হারুনা যেন কারো নজরে আসার জন্য চিৎকার করতে থাকে। পরিস্থিতি বুঝে হারুনাও বলে সে তার জন্য ঘাসের মাঝে লুকিয়ে অপেক্ষা করবে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যে হয়ে এলো। সাথে নিয়ে এলো ক্ষুধাও। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তার। শুধু নীরবে কষ্টকে মেনে নেওয়া ছাড়া। রাত গভীর থেকে গভরতর হতে লাগলো। একদিকে শত্রুর ভয়,অন্যদিকে বন্যপশুর। সাথেই ক্ষুধার আক্রমন। এসব থেকে রক্ষা পেতে মেয়েটি উচ্চস্বরে ভাই-বোন আর মার সাথে কথা বলতে লাগলো। যেন তারা পাশেই বসে আছে।শেষপর্যন্ত সে আমি পরিত্যাক্ত বলে হতাশায় কেদে ঊঠলো। রাতের বৃষ্টি তবু তাকে একটু প্রশান্তি দিল। একে একে দুটো দিন পার হয়ে তৃতীয়দিনে সে কিছু মানুষের সাড়া পেল। যারা তাকে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখলো। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতায় দিল কোন সাড়া অথবা সাহায্য। এবার হারুনা জীবনের আশা ছেড়ে মৃত্যুর প্রতিক্ষায় রইলো। কিন্তু সেটাও আসে না। ১০ম দিনে একজন লোককে রাইফেল কাধে,হাতে ম্যাচেট দেখে হারুনা বুঝলো তার মৃত্যুর সময় চলে এসেছে। চোখ বন্ধ করে সে গুলি বা ম্যাচেটের আঘাতের আশা করতে লাগলো প্রতিনিয়ত। দেরী দেখে চোখ মেলে দেখলো লোকটি তাকে জরীপ করছে জীবিত না মৃত বলে। চাইতে দেখে জানতে চাইলো তুমি এখানে কি করছো? হারুনা তাকে ধীরে ধীরে সব খুলে বললো। সব শুনে লোকটি তাকে তুলে নিয়ে নিজ স্ত্রীর হাতে তুলে দিল। মহিলাটি তাকে গোসল করিয়ে ময়লা কাপড় ধুয়ে খাবার দিয়ে সুস্থ করে তোলার পর লোকটি তাকে এক শহরের শেষ মুসলিম পরিবারের হাতে তুলে দিল। হারুনা তার নাম এবং তাকে দেখেও নি আর কোনদিন।
হারুনাকে পরবর্তিতে একটি চার্চের আশ্রয়কেন্দ্রে দেওয়া হয় সেখান থেকে পরে স্থানান্তর করা হয় ১৩০ কিঃমিঃ দুরের আরেকটি চার্চে। যেখানে সে প্রায় আরো ৮০০ মুসলিম গৃহহীন,অনাথ শিশুদের সাথে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর পরিচালনায় একটি আশ্রয়কেন্দ্রে।। এতকিছুর পর মেয়েটি বেচে গেলেও যে ঝড় বা ক্ষতি তার জীবনে ঘটে গেছে তা কি কোন শক্তি তাকে ফেরত দিতে পারবে?? এই প্রশ্নই রইলো আমার সভ্য আর অত্যাধুনিক পৃথিবীর কাছে??
বিঃদ্রঃ পৃথিবীর যুদ্ধ-বিগ্রহ দেশগুলির দিকে একটু চেয়ে দেখুন। সেই আফগানিস্তান থেকে যতদুর পর্যন্ত আপনার দৃষ্টি যায়। মূল ভুক্তভোগী কিন্তু নারী-শিশুরাই।। পুরুষরা তাদের সামর্থের কারনের ক্ষয়ক্ষতির ভুক্তভোগী কম হয়।।