আজ বসে বসে বারান্দায় বৃষ্টি দেখছিলাম। সেই ছোটবেলায় বৃষ্টির আর জোছনার প্রেমে পড়েছিলাম। আগে বৃষ্টি হলেই আমি ভিজতাম, ভেজার অজুহাত খুঁজতাম। স্কুল জীবনে বর্যাকাল এলে, এলাকার সবাই একটা দৃশ্য দেখে খুব মজা পেত। আমি বন্ধ ছাতা হাতে ভিজতে ভিজতে স্কুলে যাচ্ছি অথবা স্কুল থেকে বাসায় ফিরছি। মনে আছে, কলেজ লাইফে আমি সবসময় ব্যাগে এক্সট্রা টি-শার্ট নিয়ে যেতাম। বৃষ্টি হলেই ভিজবো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে, পুরো কলেজ লাইফে আমি মাত্র দুইবার এক্সট্রা টি-শার্ট কাজে লাগাতে পেরেছিলাম। বৃষ্টি এমনই অবিশ্বস্ত প্রেমিকা ছিল!
বৃষ্টি দেখতে দেখতে এসব ভাবছিলাম। আজকের বৃষ্টিটা বড্ড অদ্ভুত ছিল। বৃষ্টির ফোটাগুলো তেছড়া ভাবে বারান্দার গ্রিলে পড়ে, ভেঙে শত টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। বৃষ্টির রেণু আমায় ভিজিয়ে দিচ্ছিল। একই সাথে রোদ আর বৃষ্টি। ছোটবেলায় এমন হলে মা ছড়া কাটতেন:
"রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে খেঁক, শিয়ালের বিয়ে হচ্ছে"। পরে শুনেছিলাম এটা নাকি খনার বচন। যদিও খনা'র মতো অতিরিক্ত বাস্তববাদী ভদ্রমহিলার, এমন অর্থহীন কথা বলার কোন যুক্তি দেখি না।
হাতে অনেক কাজ। ডিজাইনের লে-আউট থেকে শুরু করে নিজের লেখার কাজ সবই বাকি। কিন্তু কাজের কাজ বাদে আর সব কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কি-বোর্ডে বসে অর্থহীন কথা টাইপ করতেও ভালো লাগছে।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান—
‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর,
নদেয় এল বান।
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনে পড়ছে, আরো অদ্ভুত দুই অভিজ্ঞতার কথা। স্কুল লাইফ আর কলেজ লাইফের কথা বললাম। এবার ভার্সিটি লাইফের কথা বলি।
ফার্স্ট ইয়ারের ঘটনা। দুপুরের দিকে ক্লাস শেষে বাসায় ফিরবো। ফাল্গুন-এ উঠেছি (কথাপ্রসঙ্গে বলে রাখি, বাসটার আসল নাম কিন্তু "ফাল্গুন আট পরিবহন।" ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ছিল বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ফাল্গুন মাসের আট তারিখ)। আমি বসেছি একদম শেষে, পেছনের গেটের ঠিক আগের সিটটায়। তখন বাসের পেছনের দরজাগুলো খোলা থাকতো। আমি উঠেছি আজিমপুর থেকে। আমার সামনের সিটে বসেছে এক জুটি। নীলক্ষেত থেকে আমার পাশে এসে বসলো এক মেয়ে। কিছুটা শ্যামলা করে, কিন্তু চেহারায় একটা একটা তেজীভাব আছে। আমি স্বভাবসুলভ ভীতি থেকে, দুজনের মাঝে মোটামুটি দুই ফুটের একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে সরে বসলাম।
সাধারণত বাসের প্রতিটি সিটের পাশে একটা করে জানালা থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের পাশের জানালায় একটামাত্র কাঁচ ছিল। এমন জানালা থাকলে, ফিফটি-ফিফটি বেসিসে জানালা খোলা রাখে সবাই। রোদ নেই, কিন্তু ভ্যাপসা গরম। মেয়েটি করলো কি, আমার সাইডে পুরো জানালা ঠেলে দিয়ে, নিজের পাশের জানালা পুরোটা খুলে দিল। তারপর ভাবাবেগহীন ভাবে আবার তাদের রোম্যান্টিক কনভার্সেশনে ফিরে গেলো। আমি পুরো বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলাম। প্রেম করতে অনেক এনার্জি লস হয়, বেচারার একটু বাতাস খাক। আমার "সীটমেট" দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো, কিন্তু কিছু বললো না।
জ্যাম ঠেলে বাস চলছে ধীর গতিতে। অনন্তকাল পর সিটি কলেজ পেরিয়ে সায়েন্স ল্যাব এসে থামলাম। বলা নেই-কওয়া নেই, হঠাৎ ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি শুরু হলো। সামনের কাপল ভিজতে শুরু করলো। এবার মেয়েটি করলো কি, নিজের দিকে জানলাটা টেনে আমার সাইড পুরাই খুলে দিল। তার এহেন ঔদার্যে খুশীই হলাম, বৃষ্টিতে ভেজার অজুহাত পেয়ে গেলাম যে। মনে মনে গাইতে থাকলাম, "ভেজা কাক হয়ে থাক আমার মন।"
আমার পাশের মেয়েটির গায়ে তেমন একটা বৃষ্টি লাগছিল না। কিন্তু সে আর মেনে নিতে পারলো না। উঠে দাঁড়িয়ে ঐ মেয়েকে দিলো ধমক, "এতক্ষণ নিজে বাতাস নিলি। যেই বৃষ্টি শুরু হলো, ওমনি জানালা বন্ধ! খোল, জানালা খোল।" আর ঘটনার আকস্মিকতায় আমি পুরা হতবাক। আর ঐ মেয়েতো ভয়ে শেষ, ছেলেটা মনে হলো আরো বেশি ভয় পেয়েছে। ফলাফল: সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হলো।
এবার ঘটনা দুই। সেকেন্ড বা থার্ড ইয়ারের কথা। রাত সাড়ে নটা, তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। পরীবাগ দাঁড়িয়ে আছি, যাবো মগবাজার ওয়্যারলেস। দশ-পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়ানো। কোন রিকশা নেই, নেই মানে নেই-ই। যারা ঐ এলাকা দিয়ে যাতায়াত করেন, তারা রিকশাগুলোর হঠাৎ করে ব্ল্যাকহোলে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানেন। হঠাৎ করে এক রিকশার দেখা মিললো। আমার থেকে কিছুটা দূরে আরেক মেয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত আমারই সমবয়সী এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
আমার কিছু বন্ধু আছে, যারা মাসুদ রানার রেটিনা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। একটা মেয়ের দিকে তাকিয়েই তার বিস্তারিত "পরিসংখ্যান" বলতে পারে। আমি এমনতরো গুণ থেকে বঞ্চিত, বয়সটাও আন্দাজ করতে পারিনা। যাকে দেখে ক্লাস এইট বলি, পরে জানা যায় তার বাচ্চা এবার প্লে-গ্রুপে পড়ছে। যাকে দেখে বাজী ধরি, এই মহাশয়া নির্ঘাৎ কোন কলেজের সহকারী অধ্যাপক। আগামীবার প্রোমোশন পেয়ে সহযোগী অধ্যাপকের পদটা দখল করবেন। শুনি, সেই মেয়ে নাকি ঘরের নুন খেয়ে "নুন" স্কুলের ক্লাস নাইনে পড়ছে।
এই মেয়েটি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে এমনটা মনে হওয়ার কারণ, তার হাতে কিছু স্কেল (খাপে পোরা তরবারি আর কি) ছিল। রিকশা এগিয়ে এলো, আমরাও দৌড়ে তার কাছে গেলাম। রিকশা এক, যাত্রী দুই। টানটান উত্তেজনা, সমগ্র স্টেডিয়ামে পিনপতন নীরবতা। আমার রিকশাভাগ্য বরাবরই খারাপ, ঐদিন উল্টোই হলো। মামা এই বৃষ্টির মাঝে সিদ্ধেশ্বরী যাবে না, সে সোজা ওয়্যারলেস হয়ে মধুবাগ যাবে। আমার খুবই খারাপ লাগলো (আমি নিশ্চিত মেয়েটার জায়গায় কোন মধ্যবয়সী পুরুষ থাকলে, আমার মোটেও খারাপ লাগতো না। সে অন্য কথা)। আমি মামাকে বললাম, "থাক এই বৃষ্টির মাঝে আর রিকশা পাবে না। তুমি ওনারে নিয়ে যাও।"
মেয়েটি কিছু না বলে উঠে বসলো, হুড উঠালো। কিন্তু রিকশা দুই প্যাডেল গিয়েই ব্রেক কষলো। মেয়েটি সেখান থেকেই মাথা বের করে জানতে চাইলো : "আপনি কিভাবে যাবেন?"
খুবানি তরুর তলে, দেখিলাম আমি তারে,
সে আমার বৃষ্টিস্নাত প্রিয়া,
...
নয়নে ঝরিল বারি,
সে বারি ভেজালো তার কর,
আনন্দে-ব্যথায়-শোকে ভরি গেল তাপিত অন্তর।
-সৌভাগ্যের বৃষ্টিভেজা দিন
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
Visions of the Past
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৬ রাত ৮:৫৫