প্রায় দুই বছর সময় নিয়ে শফিকুল ইসলাম সোহেল নির্মাণ করেছেন তার চলচ্চিত্র ‘তোমার মাঝে আমি’। ঢাকাসহ সারাদেশের ১৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিলো ছবিটি। একঝাঁক নতুন মুখ নিয়ে নির্মিত এই ছবির কাছ থেকে সবাই ভিন্ন কিছু পাবে বলেই প্রত্যাশা করেছিলো। কিন্তু নির্মাণের বেহাল দশায় ছবিটি যতটা না সিনেমা তার চেয়ে বেশি নাটক লেগেছে।
নিরব অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের ছেলে। নারীবিদ্বেষী, কিছুটা গুণ্ডা প্রকৃতির। বাবা মারা গিয়েছে, মা থাকে বিদেশে। এলাকার সবাই নিরবকে ভয় করে। এক নাচের আসরে তমাকে প্রথম দেখে নিরব। এর পর থেকেই তার কল্পনায় সারাদিন তমাকে দেখতে পায়। এদিকে নিরবের চাচা কমিশনার সাদেক বাচ্চুরও নজর পড়েছে তমার উপরে। সাদেক বাচ্চুর লোকের হাত থেকে তমাকে উদ্ধার করে, তাকে নিজের বাসায় এনে ওঠায় নিরব। নিরব অবশ্য বরবারই পরোপকারী। ছোটবেলা থেকেই তার বাসায় আশ্রিত থাকে নয়ন। নয়নের পড়ার খরচও নিরব চালায়। জানা যায়, তমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলো। তমার বাবা স্কুলশিক্ষক। তার বাইপাস সার্জারীর জন্য প্রয়োজন পাঁচ লাখ টাকা। এজন্য বাধ্য হয়ে তমা নর্তকীর পেশা বেছে নিয়েছে। নিরবের চাচাতো বোন মম নিরবকে ভালোবাসে। স্বাভাবিকভাবেই তমাকে বাসায় তুলে আনাটা মম একদমই মেনে নিতে পারে না। কিন্তু নিরব তো কারো কথাই শুনে না, শুধুমাত্র তার চাচী রেহানা জলি ছাড়া। রেহানা জলি তার স্বামীর সব অপকর্মের কথা জেনেও তাকে ক্ষমা করে দেন। ভালো হয়ে যান সাদেক বাচ্চু। বাকিটা সময় জুড়ে তিনি ভালো মানুষ হিসেবেই ছিলেন। এমন সময়ে বিদেশ থেকে ফিরে আসেন নিরবের মা মমতা। বিদেশে তার স্বামী ও সন্তান রয়েছে। মমতার দ্বিতীয় বিয়ের কারণে নিরব নারীবিদ্বেষী হয়ে যায়। মামা সুব্রতর সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করে। মমতা তমার বাবার চিকিৎসার খরচ দিয়ে দেন, তবে সাথে একটা শর্ত জুড়ে দেন। তমাকে নিরবের জীবন থেকে সরে যেতে হবে। শর্ত মোতাবেক তমা নিরবকে কিছু না জানিয়েই চলে আসে। তবে নিরব তমাকে ঠিকই খুঁজে বের করে। শুধু তাই না, তমার চারপাশের সবগুলো বাসা ভাড়া করে ফেলে। ঘোষণা দেয়, তমাকে বিয়ে করে তবেই বাড়ি ফিরবে। অনেক ঘটনার পরে অবশেষে মা রাজি হলেও, বেকে বসে নিরব। কারণ, নিরব পণ করেছে তার মা যা বলবে সে তার উল্টোটাই করবে। এমন সময় কিছু গুণ্ডার আক্রমণে মমতার হাত কেটে যায়। মায়ের শরীর থেকে রক্ত বইতে দেখে পাল্টে যায় নিরব। আবিষ্কার করে মা মমতার জন্য তার মনে অনেক মমতা লুকিয়ে ছিলো। মা-ছেলের মিল হলো, তমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো। বোনাস হিসেবে নয়ন আর মম এর দুই হাত এক করে দিয়ে শেষ হলো তোমার মাঝে আমি।
তোমার মাঝে আমি পরিচালনা করেছেন শফিকুল ইসলাম সোহেল। কাহিনী আর চিত্রনাট্যও তারই করা। প্রযোজনা করেছেন মোঃ শাহ আলম আর পরিবেশনার দায়িত্বে ছিলো মেসার্স সারং চলচ্চিত্র। পুরো ছবি জুড়েই চিত্রনাট্যের দুর্বলতা আর পরিচালকের অদক্ষতা পীড়া দিয়েছে। মনে হয়েছে, শফিকুল ইসলাম সাহেব কোনো শর্ট ফিল্ম তো দূরে থাক আগে কখনো কোনো নাটকও নির্মাণ করেননি। সরাসরি সিনেমাতে ঝাঁপ দিয়েছেন। পুরো ছবিতেই নাটক নাটক ভাবটা প্রকট ছিলো। গল্পটা কখনোই পূর্ণাঙ্গ শক্তি অর্জন করতে পারেনি। ছবিটিতে সবল কিছু ঋণাত্বক চরিত্র দিয়ে গল্পটাকে আরও জমাট করে যেত। দেশীয় ছবিগুলো এককভাবে কোনো নির্দিষ্ট ধারায় সীমাবদ্ধ থাকে না। কমেডি, রোম্যান্স, অ্যাকশন, সোশাল ড্রামা, মিউজিক্যাল সব মিলে-মিশে অদ্ভুত এক জগাখিচুড়ি হয়ে যায় । তবে এক্ষেত্রে তোমার মাঝে আমি তার জনরা (Genre) এর সাথে প্রতারণা করেননি। রোম্যান্টিক ছবি আগাগোড়া রোম্যান্টিকই ছিলো। চিত্রনাট্যর ভুল ধরতে শুরু করলে দিশা হারিয়ে ফেলতে হয়। সিনেমায় বলা হয়েছে নিরব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার ছেলে। সে হিসেবে নিরবের বয়স দাঁড়ায় কমপক্ষে ৪২। কিন্তু নিরবের মেক-আপ দেখে তাকে কোনভাবেই ৩০ বছরের বেশি মনে হয়নি। তাছাড়া, এটা বেশ অসম প্রেম হয়ে যায়। কারণ তমার বয়স দেখানো হয়েছে ২০। যদি ধরে নেই, ছবির সময়কাল ২০০২ তাহলেও সমস্যা মিটে না। কারণ চরিত্রগুলোর পোশাক, গাড়ি, ব্যবহৃত প্রযুক্তি সবই সাম্প্রতিক কালের। তবে একটা ব্যাপার ভালো লাগলো। এতোটা অগোছালো একটা ছবিতে কন্টিনিউয়িটি এরর প্রায় নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশে তো অ্যাক্টর মার্কিং এর প্রচলন নেই, যার কুফল ভোগ করতে হয়েছে চিত্রগ্রাহক খোরশেদ আলম চৌধুরীকে। তিনি কিছুতেই চরিত্রগুলোর সাথে তাল মেলাতে পারছিলেন না। একটা উদাহরণ দেই। নিরবের মাথা ফেটে যাওয়ার পর মমর সাথে তার ঝগড়ার দৃশ্যটায় এমন বিপত্তি দেখা গেলো। মম রাগ করে হেঁটে বের হয়ে গেলেন। ক্যামেরা প্যান করেও তাকে ধরতে পারলো না। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য মম ফ্রেমের বাইরে চলে গেলেন। তারপর আরো প্যান করে তাকে ফ্রেমের মাঝে এনে দৃশ্যটা শেষ করে হলো। এছাড়া বেশ কিছু দৃশ্যে চরিত্রগুলোর মাথা কেটে যাচ্ছিলো। এটা অবশ্য অ্যাসপেক্ট রেশিও পরিবর্তনের জন্যও হতে পারে। তোমার মাঝে আমি নাটক লাগার একটা বড় কারণ হলো ক্যামেরার ব্যবহার। সিনেমা যেহেতু বড় পর্দায় দেখানো হয়, মিড ক্লোজ শটগুলোও বড্ড “গায়ে পড়া” লাগে।
নিরবের অভিনয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে তাকে খুব সাবলীল মনে হয়েছে। নিজেকে আর কিছুটা ঝালাই করলেই, তাকে পুরোদস্তুর অভিনেতা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে। তমা মির্জার সময়টা ভালো যাচ্ছে না। আগের ছবিগুলোতেও তার পারফর্ম্যান্স খুব একটা সুবিধার ছিলো না। এই ছবিতেও অভিনয়ে তো বটেই নাচের দৃশ্যেও জড়তা কাজ করছিলো (একটা বিষয় অবশ্য স্মরণে রাখা দরকার। এটা তার ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের ছবি)। শুধু একটা কথাই বলবো, হাঁটতে হবে অনেকটা পথ। সুব্রত, রেহানা জলি আর মমতা গড়পড়তা অভিনয় করেছেন। ছবিতে বেশ কয়েকটা নতুন মুখ ছিলো। নবাগতদের মাঝে সিমন্তি রহমান বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছেন। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাদেক বাচ্চুর অভিনয় দুর্দান্ত ছিলো।
সিনেমায় গান ছিলো ছয়টি। ছবির চারটি গান লিখেছেন শাহাবুদ্দিন মজুমদার, ‘শিশির’ গানটি লিখেছেন অন্তরা এবং আর শীর্ষ সঙ্গীতের গীতিকার পরিচালক নিজেই। সুর করেছেন খায়েম আহমেদ। বেশ মেলোডিয়াস সব গান। জেমস সুমনের গাওয়া দুটো গানই সবাই খুব পছন্দ করেছে। বিশেষ করে ‘পারলে বন্ধু ঠেকাও এবার আমারে’ গানটির সময়ে হলের সবার উচ্ছ্বাস ছিলো দেখার মতো। আইটেম সং ‘ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মন’ আইটেম গানের বিচারে কিছুটা ঠাণ্ডাই ছিলো। আর গানটার সুরে ভারতীয় ছবি ওমকারা’র আইটেম সং ‘বিড়ি’ এর সামান্য প্রভাব ছিলো। গানটির চিত্রায়ন খুবই অগোছালো ছিলো। ভেবেছিলাম পরিচালক বুঝি ইচ্ছে করেই এমনটা করেছেন। কারণ এই উপমহাদেশের আইটেম সংগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে খুবই ব্যয়বহুল পরিবেশে তারা জাতীয় পর্যায়ের নৃত্যশিল্পীদের মতো পারফর্ম করছেন। কিন্তু বাস্তবে তো এমনটা হয়না। এই ছবির পরিচালক হয়তো সে বৃত্ত থেকে বের হতে চেয়েছেন, বাস্তবের ছোঁয়া রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু পরের গানগুলো দেখে সে ভুল ভেঙে গেলো। ‘শিশির’ বাদে অন্য গানগুলোর চিত্রায়নে অপেশদারীত্বের ছাপ ছিলো সর্বত্র।
আবহসঙ্গীতের দায়িত্বে ছিলেন আশিকুজ্জামান তপু। সবগুলো রোম্যান্টিক দৃশ্যগুলোতে এক টাইটেল গানের ইন্সট্রুমেন্টাল দিয়েই কাজ সেরেছেন তিনি। ইমোশনাল আর সাসপেন্স দৃশ্যের সময় ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর গুলিয়ে যাচ্ছিলো। মুনির হোসেনের সম্পাদনা খুবই বিরক্তির জন্ম দিয়েছে। এক দৃশ্য শেষে হওয়ার আগেই আরেক দৃশ্যে ইচ্ছে মত চলে যাচ্ছিলেন। তারপর আবার কোনো কারণ ছাড়াই সেকেন্ড দশেকের জন্য আবার আগের দৃশ্যে ফিরে আসছিলেন।
সব মিলিয়ে ‘তোমার মাঝে আমি’ চলমান হতাশার খাতায় আরো একটি নাম যোগ করলো। সিনেমা নাম দিয়ে নাটক দেখানোর যে রীতি সাম্প্রতিককালে শুরু হয়েছে, এই সিনেমা সেই দলেরই দুর্বল এক সদস্য। দর্শকরা কিন্তু কখনোই এমন ছবি গ্রহণ করে না। পরিচালকদের বুঝতে হবে, দর্শকরা সিনেমার মাঝে মেলোড্রামা থাকলে মেনে নেয়, ড্রামাটিক চেঞ্জ আশা করে, কিন্তু নাটক থেকে দূরে থাকতে চায়। তারা সিনেমার মাঝে নাটকীয়তা দেখতে চায়, নাটক না।