somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নেকাব্বরের দিনরাত্রি

০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৫:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৯৭৯ সালে “তার আগে চাই সমাজতন্ত্র” বইয়ে লিখেছিলেন প্রান্তিক শ্রেণীর এক মানুষের জীবন-কাব্য। শ্লেষাত্মক স্বরে তিনি সেই কবিতার নাম দিয়েছিলেন “নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ”। মৃত্যুর পরে সেই নেকাব্বর আবার জীবন ফিরে পেয়েছে সেলুলয়েডে নবীন পরিচালক মাসুদ পথিকের ছোঁয়া পেয়ে। পরিচালক র-রিয়ালিজম নামে নতুন এক ধারার সূচনাও করতে চেয়েছেন।
নেকাব্বর গ্রামের এক সাধারণ বর্গাচাষী। তালুকদার সাহেবের জমিতে ফসল ফলিয়ে তিন ভাগের এক ভাগ অংশ সে পায়। তিন কূলে তার কেউ নেই। চারপাশের সবার প্রতি সমানভাবে তীব্র ভালবাসা লালন করে চলে সে। তা সে গরীব বৃদ্ধা হোক অথবা বিষধর সাপ। আর ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে ফাতেমার সাথে। প্রতি রাতে সবার আড়ালে চলে তাদের অভিসার। কিন্তু সব হিসাব পাল্টে যায়, যখন নেকাব্বর তালুকদার সাহেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কৃষকদের অধিকার আদায়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় সে। ফলে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। নেকাব্বর ঢাকায় পালিয়ে আসে। আশ্রয় নেয় ঢাকার বিউটি বোর্ডিঙে। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নেকাব্বর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ফাতেমার কাছে ফিরে যায় না। কারণ যুদ্ধে নেকাব্বর তার এক পা হারায়। এভাবেই কেটে যায় ৪২টি বছর। তারপর একদিন যখন নেকাব্বর বুঝতে পারে তার জীবন শেষের পথে, সে ফিরে যায় গ্রামে। শেষ দেখা দেখতে যায় তার গ্রামকে, ফাতেমাকে।
কবিতার নেকাব্বরের মত চলচ্চিত্রের নেকাব্বরও কৃষিজীবী। তার ভালবাসার মানুষটির নামও ফাতেমা। মোটা দাগে মিল বলতে এটুকুই। কবিতার নেকাব্বর আর পর্দার নেকাব্বরের জীবন দর্শন ভিন্ন। গল্পের প্রয়োজনে ব্যাপ্তিটাও ভিন্ন। ছবির নেকাব্বর বিপ্লবী, যোদ্ধা, প্রেমিক, কবি। সে ভালোবাসে মানুষকে। তার সাথী হল বিড়াল, গরু, সাপ, ব্যাংসহ সকল প্রকার জীব। পুরো পৃথিবীকে নেকাব্বর দেখে এক প্যান্থেয়িস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। যে কিনা মাকে খুঁজে পায় লেবু পাতার ঘ্রাণে অথবা ঈশ্বরকে তার সৃষ্টির মাঝে। নেকব্বরের সৌষ্ঠব-বাবরি চুল সর্বোপরি তার অ্যাপিয়ারেন্স আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিল্পী এস.এম. সুলতানের প্রথম রোপণের কথা।

ছবির খুব উল্লেখযোগ্য দিক হল এর চিত্রগ্রহণ আর গান। লরেন্স রোজারিও ও বায়েজিদ কামাল দুজন চিত্রগ্রাহকই দারুণ কাজ দেখিয়েছেন। আবহমান গ্রাম-বাংলার দৃশ্যগুলো যেমন ল্যান্ডস্কেপিক, তেমনি সেগুলোর কম্পোজিশনেও যত্নের চিহ্ন পাওয়া যায়। ছবিতে গ্রামের বহু চিরন্তন উপকরণ খুঁজে পাওয়া গেলো। যা আজ শহুরে জীবনের কোলাহলে হারিয়ে গিয়েছে। পরিচালকের মনে হয় ক্রেন শট আর টপ শট খুব পছন্দ। ছবিজুড়ে ক্রেনের মাত্রাধিক ব্যবহার সে কথারই প্রমাণ দিল।
নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ ছবির সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেছেন ডঃ সাইম রানা। গানের কথা লিখেছেন নির্মলেন্দু গুণ, কবি অসীম সাহা আর পরিচালক নিজেই। সুর দিয়েছেন প্রিন্স মাহমুদ, অসীম সাহা, বেলাল খান, মাহমুদ সেলিম। ছবির গানগুলো অসম্ভব শ্রুতিমধুর। ইষ্টিশন, নিশিপক্ষী, কৃষ্ণদর্শনসহ প্রতিটা গানই সুন্দর।
অভিনয়ের কথা বলতে গেলে শিমলা, বাদল শহীদ আর মামুনুর রশীদ বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। মুন্সী আর নির্মলেন্দু গুণের অভিনয়ও প্রশংসার দাবীদার। যুবক নেকাব্বরের ভূমিকায় জুয়েল জহুর, শাহেদ, প্রবীর মিত্র, রেহানা জলি সবার কাজ গড়পড়তা ছিল। পরিচালক নিজে কবি বলেই হয়তো ডজনখানেকের বেশি কবিকেও অভিনয় করতে দেখা গেল।
ছবির দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই ঘণ্টা। এটা বেশ বড় একটা মাইনাস পয়েন্ট। কারণ ছবির গল্পের রসদ খুব বেশি না। তাই ছবির অনেকাংশজুড়ে নেকাব্বরের দিন-রাতের কার্যকলাপ দেখি, যা কিনা বেশ বিরক্তির জন্ম দেয়। এক সময় মনে হতে থাকে গল্প যেন বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেমন, ফাতেমার সঙ্গে নেকাব্বরের অভিসারের একটি দৃশ্যই যথেষ্ট ছিল। এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। ছবির শেষ অংশের দৃশ্যগুলি অনর্থক দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। পরিচালক মাসুদ পথিক ধৈর্যের পরীক্ষাই নিয়েছেন বলা চলে। কৃষ্ণদর্শন বাদে অন্য গানগুলোর কোরিওগ্রাফি সাধারণ লেগেছে। এমন চমৎকার গ্রামীণ পরিবেশকে গানে আরও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যেত। নেকাব্বর বাদে আর কোন চরিত্রেরই যথেষ্ট ডেভেলপমেন্ট ঘটেনি। শিমলার চরিত্রটি যেন গৎবাঁধা কিছু কাজে আটকে ছিল। মামুনুর রশীদের চরিত্রটির যথেষ্ট শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় হতে গিয়েও যেন হারিয়ে গেল। তার চরিত্রের কোন সন্তোষজনক সমাপ্তি দেখা যায় না। ছোট চরিত্রগুলোতে যারা ছিলেন, তাদের সংলাপ বলার মাঝে এক ধরণের তাড়া ছিল। যেটা ছবির ন্যাচারালিস্টিক টোনকে ব্যহত করেছে। তালুকদারের লাঠিয়াল বাহিনী নেকাব্বরকে আক্রমণ করবে, একথা জেনেও নেকাব্বরের সঙ্গে শিমলার ভাবান্তরবিহীন বাক্যালাপ বড্ড চোখে লেগেছে।
নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ সব মিলিয়ে গ্রাম-বাংলার রূপের ছবি। রক্ত, প্রেম, প্রকৃতি, ঘাম আর কামের ছবি। সব শেষে আগ্রহী পাঠকদের জন্য নির্মলেন্দু গুণের মূল কবিতাটি তুলে দেয়া হল:
নেকাব্বর জানে তাঁর সম্পত্তির হিসাব চাইতে আসবে না
কেউ কোনোদিন।
এই জন্মে শুধু একবার চেয়েছিল একজন, ‘কী কইরা
পালবা আমারে,
তোমার কী আছে কিছু তেনা?’
সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে ফাতেমাকে জড়িয়ে দু’হাতে বুকে পিষে
বলেছিল নেকাব্বর;
‘আছে, আছে, লোহার চাককার মতো দুটা হাত, গতরে আত্তীর বল – আর কীডা চাস্ মাগী।’
‘তুমি বুঝি খাবা কলাগাছ?’

আজ এই গোধুলিবেলায় প্রচন্ড ক্ষুধার জ্বালা চোখে নিয়ে
নেকাব্বর সহসা তাকালো ফিরে সেই কলাবাগানের গাঢ় অন্ধকারে।
তিরিশ বছর পরে আজ বুঝি সত্য হলো ফাতেমার মিষ্টি উপহাস।
পাকস্থলি জ্বলে ওঠে ক্ষুধার আগুনে, মনে হয় গিলে খায়
সাজানো কদলীবন,’
যদি ফের ফিরে পায় এতটুকু শক্তি দুটি হাতে, যদি পায়
দাঁড়াবার মতো এতটুকু শক্তি দুটি পায়ে।
কিন্তু সে কি ফিরে পাবে ফের?
ফাতেমার মতো ফাঁকি দিয়া সময় গিয়েছে ঢের চলে।
কারা যেন ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেছে সব শক্তি তার।
বিনিময়ে দিয়ে দেছে ব্যাধি, জরা, দুর্বলতা, বক্ষে ক্ষয়কাশ-
অনাদরে, অনাহারে কবরে ডুবেছে সূর্য, ফাতেমার তিরিশ বছর।
এখন কোথায় যাবে নেকাব্বর?
হয়তো গিলেছে নদী তার শেষ ভিটেখানি, কবর ফাতেমা-
কিন্তু তার শ্রম. তার দেহবল, তার অকৃত্রিম নিষ্ঠা কারা নিলো?
আজ এই গোধুলিবেলায় এই যে আমার পৃথিবীকে মনে হলো পাপ,
মনে হলো হাবিয়া দোজখ – কেউ কি নেবে না তার এতটুকু দায়?
মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চায় না সুদুরে চলে যেতে, নেকাব্বর ভাবে,
অজানা অচেনা স্বর্গে বুঝি মেটে বাস্তবের তৃষ্ণা কোনোদিন?
তবু যারা চায়, তারা কেন চায়? তারা কেন চায়? কেন চায়?

নেকাব্বর শুয়ে আছে জীবনের শেষ ইস্টিশনে। তার পচা বাসী শব
ঘিরে আছে সাংবাদিক দল। কেউ বলে অনাহারে, কেউ বলে অপুষ্টিতে,
কেউ বলে বার্ধক্যজনিত ব্যাধি, – নেকাব্বর কিছুই বলে না।

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×