বিবর্তনবাদীরা-সহ মোটামুটি সকলেই চার্লস ডারউইনের মতবাদকে “The theory of evolution” তথা “বিবর্তনবাদ তত্ত্ব” বলে অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, ডারউইনের প্রস্তাবিত এই তত্ত্ব কিন্তু পদার্থবিদ্যার কোনো তত্ত্বের মতো নয়। অর্থাৎ পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব যেমন গাণিতিক মডেলের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, বিবর্তনবাদ তত্ত্ব মোটেও সেরকম কিছু নয়। ফলে “বিবর্তনবাদ তত্ত্ব” নামকরণ অনেকের কাছেই বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। বিবর্তনবাদ তত্ত্ব আর বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব যে এক নয় সেটা বুঝানোর জন্য একটি উদাহরণ দেয়া যাক:
১৯০৫ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে আইনস্টাইন প্রস্তাব করেন যে, ভর ও শক্তি পরস্পরের সমানুপাতিক। আইনস্টাইন তাঁর এই প্রস্তাবকে শুধুমাত্র কথা বা লিখার মাধ্যমেই ব্যক্ত করেননি, সেই সাথে গাণিতিক সূত্রও দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর সেই বিখ্যাত সূত্রটি হচ্ছে, E = mc^2. এখন কেউ যদি আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত তত্ত্বের সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন সেক্ষেত্রে এই গাণিতিক সূত্র দিয়ে পুনঃপুনঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে প্রমাণ দেখানো সম্ভব। এক্ষেত্রে বিশ্বাস বা কল্পনার কোনো স্থান নেই। পরীক্ষামূলক উপাত্তই কথা বলবে।
এ-রকম আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তবে ঠিক কী বুঝাতে চাওয়া হচ্ছে তা যে কেউ বুঝতে পারবেন বলেই বিশ্বাস। অন্যদিকে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যেমন গাণিতিক সূত্র-ভিত্তিক কোন তত্ত্ব নয় তেমনি আবার সে-রকম কোন মডেল বা সূত্র দাঁড় করানোও অসম্ভব। অথচ বিজ্ঞানের নামে আমজনতাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বা নিউটনের গতিসূত্র বা বিজ্ঞানের অন্য যে কোন তত্ত্বই হোক না কেনো – এগুলোর সাথে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের কোন তুলনাই হয় না। কারণগুলো নিম্নরূপ:
- বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো গণিত, পদার্থবিদ্যার সূত্র, ও পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষা লব্ধ ফলাফলের উপর নির্ভরশীল। কেউ বিশ্বাস না করলে তাকে যে কোনো সময় গণিত-পদার্থবিদ্যার সূত্র দিয়ে বা এমনকি ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও প্রমাণ দেখানো সম্ভব। যে সকল ক্ষেত্রে গাণিতিক মডেল নেই কিংবা দাঁড় করানো সম্ভব নয় সে সকল ক্ষেত্রেও অসংখ্যবার পর্যবেক্ষণ করে যৌক্তিক একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। যেমন কেউ পৃথিবীর আকার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে তাকে বিভিন্ন যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিশ্বাস করানো সম্ভব যে পৃথিবীর আকার সত্যি সত্যি গোলকের মতো, ডিস্কের মতো সমতল নয়। এমনকি তাকে মহাশূন্যে নিয়ে যেয়ে স্বচক্ষে দেখানোও এখন অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। অনুরূপভাবে, কেউ যদি গাছ থেকে ভূমিতে অ্যাপেল পড়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তাহলেও তাকে অ্যাপেল গাছ তলায় বসিয়ে রেখে মিলিয়ন মিলিয়ন বার একই পরীক্ষা চালিয়ে স্বচক্ষে দেখানো সম্ভব।
- বিজ্ঞানের তত্ত্বের ক্ষেত্রে যেমন প্রতারণা বা কল্পনার কোনো কাজ-কারবার নেই তেমনি আবার কেউ তার প্রয়োজনও মনে করেন না। কোথাও কোনো ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়লে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই সেই ভুল সংশোধন করে নিতে প্রস্তুত। অতএব, এই সকল ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের উপর আস্থা রাখা যেতে পারে। অন্যদিকে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যেহেতু পরীক্ষা-নিরীক্ষা-নির্ভর কোনো তত্ত্ব নয় সেহেতু এক্ষেত্রে পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই। বিবর্তনবাদ তত্ত্বে কেউ অবিশ্বাস বা সংশয় প্রকাশ করলে তাকে পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। যেমন আজ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে কোনো একটি প্রাণী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রাণী বিবর্তিত হয়ে থাকলেও সেটিকে পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ দেখানো অসম্ভব। কারণ এটি একটি অতীত ঘটনা এবং সেটি একবারই ঘটেছে। অনুরূপভাবে, চতুষ্পদী কোনো জন্তু থেকে ধীরে ধীরে তিমির বিবর্তন হয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে সেটিকে বারংবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রমাণ দেখানো সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব নয় যীশুর ক্রুসিফিকসন ও রেজারেকশনের ঘটনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখানো। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে যীশুর ক্রুসিফিকসন ও রেজারেকশনের ক্ষেত্রে অন্তত চাক্ষুস স্বাক্ষী আছে বলে দাবি করা হলেও চতুষ্পদী কোনো প্রাণী থেকে যে ধীরে ধীরে তিমি বিবর্তিত হয়েছে তার পক্ষে যেমন কোনো চাক্ষুস স্বাক্ষী নেই তেমনি আবার এটি একটি অবিশ্বাস্য বা দৈব ঘটনার মতো শুনায়। অতএব, চতুষ্পদী কোনো প্রাণী থেকে ধীরে ধীরে তিমির বিবর্তন একটি অন্ধ বিশ্বাস। এ বিষয়ে রিচার্ড ডকিন্সের ভিডিওটা দেখা যেতে পারে। সেখানে শিশু বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য সুন্দর করে কিছু ড্রয়িং দেখানো হয়েছে। বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য অবশ্য ঠিক আছে। কিন্তু এগুলোকেই যখন বাচ্চাদের বাপ-চাচা-দাদু’র বয়সী লোকজন বিজ্ঞানের নামে পৃথিবীর ঘূর্ণনের মতো প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে বিশ্বাস করে তখন সত্যিই হাসি পায়! রিচার্ড ডকিন্সও হয়ত প্রাপ্তবয়স্কদের ছেলেমীপনা দেখে সরাসরি কিছু না বললেও মনে মনে হাসেন!
- আধুনিক বিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুযায়ী বিবর্তনবাদ তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। যেমন কেউ যদি লক্ষ লক্ষ বছর আগের কোন এক জীবাশ্ম থেকে নিজের মতো ড্রয়িং করে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির মধ্যকার ‘মিসিং লিঙ্ক’ বলে দাবি করেন সেক্ষেত্রে তার এই দাবিকে কিন্তু খণ্ডন করা অসম্ভব। অন্যদিকে আবার যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার এই দাবিকে কোনো রকম প্রমাণও বলা যাবে না। কারণ যাকে মানুষ ও শিম্পাঞ্জির মধ্যকার ‘মিসিং লিঙ্ক’ বলে দাবি করা হচ্ছে সেটি স্বতন্ত্র একটি প্রজাতির জীবাশ্মও হতে পারে। অতএব, দেখা যাচ্ছে যে লক্ষ লক্ষ বছর আগের জীবাশ্ম বা জীবাশ্মের অংশবিশেষ দিয়ে বিবর্তনবাদ তত্ত্বকে কোনো ভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে স্রেফ বিশ্বাস ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
- বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্বের সাথে কখনো কোনো আইডিওলজি বা দর্শন জড়িত ছিল না বা থাকে না। বিজ্ঞানীরা কখনো ক্যাম্পেন করে তাদের তত্ত্ব-নির্ভরশীল কোনো দর্শন প্রচার করেননি। অন্যদিকে বিবর্তনবাদ তত্ত্বের সাথে ওত-প্রোত ভাবেই একটি বস্তুবাদী দর্শন জড়িয়ে আছে। যদিও সমালোচনা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিবর্তনবাদীরা কিছুটা পিছুটান দেয়া শুরু করেছেন তথাপি সেই বস্তুবাদী দর্শনই কিন্তু মূল। তারা চাইলেই তাদের বস্তুবাদী দর্শনকে বাদ দিয়ে স্রেফ জৈব বিবর্তনের উপর গুরুত্ব দিতে পারবেন না। ঘুরে-ফিরে তাদের দর্শন চলে আসবেই – প্রতিনিয়ত আসছে। বিবর্তনবাদী মানেই যে নাস্তিক বা বস্তুবাদী বা ধর্মে অবিশ্বাসী – সেটা তো সবাই দেখছে, যদিও এই অভিযোগ ওঠার পর দু-এক জন ভণ্ড বিবর্তনবাদীর আগমণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যারা নাকি একই সাথে ধর্ম ও বিবর্তনবাদ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। বিজ্ঞানের অন্য কোনো তত্ত্বের ক্ষেত্রে এ-রকম কিছু কখনো ঘটেনি।
উপরোল্লেখিত পয়েন্টগুলো থেকে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, বিবর্তনবাদ তত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রতারণা ও কল্পনার যথেষ্ট সুযোগ রয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তার স্বপক্ষে অনেক প্রমাণও আছে। অতএব, খুব সঙ্গত কারণেই বিবর্তনবাদ তত্ত্বকে বিবর্তনবাদীদের হাতে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দেয়া যায় না। বিবর্তনবাদীরা এ পর্যন্ত যা করেছেন তা আসলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ঠিক বিপরীত। তারা প্রথমেই ধরে নিয়েছেন যে, অতি ক্ষুদ্র একটি অণুজীব থেকে "এলোমেলো পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন" এর মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে সকল প্রকার প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে। তারপর তারা সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন। যুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় এটিকে বৃত্তাকার যুক্তি বলে। তারা তাদের অবস্থান থেকে সহজে পিছুটান দিতেও নারাজ, যেহেতু তাদের বিশ্বাসের সাথে নাস্তিক্যবাদী দর্শন জড়িত আছে।
যাহোক, বিবর্তনবাদীদের দাবি অনুযায়ী অতি ক্ষুদ্র একটি অণুজীব থেকে "এলোমেলো পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন" এর মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে মিলিয়ন মিলিয়ন ধরণের মাছ, পশু-পাখি, সরীসৃপ, কীট-পতঙ্গ, উদ্ভিদ, ও মানুষ-সহ সকল প্রকার প্রজাতি বিবর্তিত হয়েছে। এবার মাথার মধ্যে পূর্ব-প্রচারিত কোনো ময়লা-আবর্জনা থেকে থাকলে সেগুলোকে পরিষ্কার করে তাদের এই দাবি নিয়ে নিজেকে নিদেনপক্ষে তিন ধাপে প্রশ্ন করুন:
ধাপ-১: বিবর্তনবাদীদের এই দাবি নিদেনপক্ষে যৌক্তিক কি-না? একটি অণুজীব থেকে সে-রকম কিছু বাস্তবে আদৌ সম্ভব কি-না? নিরপেক্ষ মনে নিজেকে বারংবার প্রশ্ন করতে থাকুন। দেখবেন যে প্রতিবারই না-সূচক জবাব চলে আসবে। স্রেফ কল্পকাহিনীর মতই মনে হবে।
ধাপ-২: সবকিছুই যদি "এলোমেলো পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন" এর ফলাফল হয় তাহলে তো চোখের সামনেই অসংখ্য প্রমাণ থাকার কথা। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে এত কিছু ঘটে থাকলে আজ ঘটবে না কেন? মোটের উপর সবকিছুই যেখানে এলোমেলো ও উদ্দেশ্যহীন! চোখের সামনে এক প্রাণী থেকে নতুন কোনো প্রাণী বিবর্তিত হচ্ছে কি-না? নিরপেক্ষ মনে আবারো নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকুন। আশেপাশে ভাল করে তাকিয়ে দেখুন। দু-চার হাজার বছরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন। দেখবেন যে বারংবার না-সূচক উত্তর চলে আসবে।
ধাপ-৩: বিবর্তনবাদীরা কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে সবকিছুই মিলিয়ন মিলিয়ন বছর আগে ঘটেছে? তারা এমন কী জানেন যেটা আপনি জানেন না! তারা কি দেবতা নাকি জ্যোতিষী! তাদের দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ আছে কি-না? থেকে থাকলে সেগুলো আসলে কী? সেই তথাকথিত প্রমাণ থেকে কোনো রকম যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব কি-না?
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ধাপ-১ ও ধাপ-২ অনুযায়ী নিজের জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতা, বাস্তবতা, ইতিহাস, সাধারণ বোধ, ও পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করলে বিবর্তনবাদীদের দাবিকে অবাস্তব বা অসম্ভব বা কল্পকাহিনীর মতই মনে হয়। বাকি থাকে ধাপ-৩!