বিছানায় চোরদের ফেলে যাওয়া একটি ম্যাচ পড়ে আছে। কয়েকটি পুরা কাঠি মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। তার মানে চোররা ওই রুমে বসে সিগারেটও খেয়েছিল। গত রাতে আমার কলিগ কাম ভার্সিটির বড় ভাইয়ের বাসায় জানালার গ্রিল কেটে চুরি হয়েছে। সকালে উঠে দেখেন স্টিলের আলমারি খোলা, কাপড়-চোপর এলোমেলো। তাজমহল রোডের সি ব্লকে ওনার বাসায় ওনারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে থাকেন। অল্পের জন্য সাগর-রুনির ঘটনা ঘটে নাই। যে রুমে চুরি হয়েছে ভাগ্যগুণে গতরাতে সে রুমে ঘুমান নি। আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে গেছেন ওনারা। নগদ ৭৪ হাজার টাকা (বিদেশগামী এক বন্ধু রাখতে দিয়েছিল, আগামী সপ্তাহে তার ফ্লাইট), ১টি ডিজিটাল ক্যামেরা, কয়েক ভরি স্বর্ণালংকার চুরি হয়েছে। চোররা হয়ত সাফিসিয়েন্ট টাকা পেয়ে গিয়েছিল বলে অন্য রুমে যায় নি। গেলে কী হত আল্লাহ মালুম। ঢাকায় নিচতলার বাসা মানে প্রতি মুহূর্তে বিপদ। ডেভেলপারদের তৈরি বাসা গুলো উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট। সামনে বিশাল গেইট, সিকিউরিটি, ফ্ল্যাটে টাইলস আর পেছনের জানালায় সিম্পল গ্রিল।
বড় ভাই মোহাম্মদপুর এলাকার বিখ্যাত একটা কলেজে শিক্ষকতা করেন। বাসায় চুরি হয়েছে; আরো কত বড় বিপদই না ঘটতে পারত। এসব ভেবে হাত-পা কাপাঁকাপি অবস্থা তার। মানসিকভাবেও একেবারে কাহিল। তবুও রুটি-রুজির কর্মস্থলে বিষয়টি না জানালেই নয়। প্রচন্ড মুষরে পড়া অবস্থায় কলেজের উপাধ্যক্ষকে ফোন করে বিষয়টি জানান। মাননীয় উপাধ্যক্ষ বলেন- তুমি কলেজে আস। এহেন অবস্থায় ঘরে স্ত্রীকে একা রেখে গেলেন কলেজে। দেখা করলেন। টাকার উৎস না জেনেই তিরস্কার করা শুরু করলেন। বললেন- 'বোকার মত এত টাকা কেউ ঘরে রাখে? ক্লাসে যাও।' যাইহোক, তিন পিড়িয়ড ক্লাস নিয়ে টিফিনের পর বাকি দুটি ক্লাস সহকর্মীদের মাধ্যমে ম্যানেজ করলেন। বাসায় ফিরে আসার মুহূর্তে সম্মানীয় উপাধ্যক্ষ মহোদয় উনাকে অতিরিক্ত একটি ক্লাস হাতে ধরিয়ে দিলেন। ( অতিরিক্ত ক্লাস হল, কোন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে অন্য যে কাউকে যে ক্লাসে পাঠানো হয়।)
মাননীয় মহোদয় সেই সকাল পৌনে ৮টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত পেশাগত কাজে তাকে আটকে রাখলেন। সাথে দিলেন অতিরিক্ত ক্লাসও। নো সমবেদনা, নো সহমর্মিতা। বাসায় সদ্য বিবাহিত স্ত্রী একাকী ওনার অপেক্ষায়।
কলেজ ছুটির পর আমরা কলিগরা ওনার বাসায় যাই। আমাদের দেখে যেন দুজন প্রাণ খোঁজে পান। দেখলাম গতরাতের ঘটনায় ওনাদের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে আছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া নেই। ভাঙ্গা জানালার গ্রিল দেখতে গিয়ে আমরা সবাই সিউরে উঠি। তৎক্ষণাত সাগর-রুনির জানালার গ্রিলের কথা মনে পড়ে। মনে হল আরেকটি সাগর-রুনির ঘটনা থেকে বেঁচে গেছে দেশ। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই। কিছু সান্ত্বনা দিয়ে আমরা চলে আসি।
আসার সময় উনি আমাকে দাঁড় করালেন। এক নাগাড়ে কয়েকটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন আমাকে উদ্দেশ্য করে। বললেন-ছোটভাই, আমরা কী শুধু মাস শেষে কিছু টাকা পাওয়ার জন্যই চাকুরী করি? প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কী আর!! কিছুই পেতে পারি না? এমন একটা দিনে আমাকে না গেলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত?
আমরা চলে যাচ্ছি দেখে ওনার পেছনে দাঁড়ানো স্ত্রীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম গতরাতের ঘটনার রেশ এখনো কাটে নি তার।
আমার কাছে কোন উত্তর ছিল না। চলে আসি। পেছনে একবারও ফিরে তাকাইনি।
ভাইকে বলা হয়নি-যে যায় লংকায় সে হয় রাবণ। কাক কাকের মাংস না খেলেও শিক্ষক খায়।
