ঘটনা ১: তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র আমি, হলে থাকি। পরিচিত এক বড় ভাই চাকরীর খোঁজে ঢাকায় এসে উঠলেন আমার রুমে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশুনা শেষ করেছেন সবে মাত্র। পাশ করার পর কি করবো এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, বুয়েটের সবাই তো পাশ করে বিদেশ চলে যায়, আমারও তাই করা উচিৎ। এই দেশ মেধাবীদের কোন মূল্য দিতে পারেনি, আমাকেও কিছু দিতে পারবে না এই দেশ। খুব খারাপ লেগেছিল শিক্ষিত মানুষের দেশের কাছে প্রত্যাশা দেখে, আজও একই রকম খারাপ লাগে।
ঘটনা ২: তখন দেশে মোটামুটি একটা ভালো চাকরী করি। এরকম ক্ষেত্রে যা হয় - চাকরী প্রার্থীর অত্যাচারে অতিষ্ট, কারও কারও জন্যে কিছুটা করার তাগিদ অনুভব করি অন্তর থেকে, আবার কিছু না করতে পারার কারনে হতাস কখনো কখনো। এরই মধ্যে এক প্রতিবেশি তার হবু জামাই এর জন্য সুপারিস নিয়ে এলেন। বেকার ছেলে তার মেয়ের সাথে প্রেম করছে, তাই ছেলেকে একটা চাকরী না জোগাড় করে দিয়ে মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেন না। এড়িয়ে যেতে গিয়েও পারলাম না। একদিন ছেলেটাকে নিয়ে দেখা করতে এলেন আমার সাথে। ছেলেটার সাথে কথা বলতে গিয়ে মাথায় একেবারে রক্ত উঠে যাবার দশা। সে বাবার টাকায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে তখন আমার প্রতিবেশীর মেয়ের সাথে প্রেম করে বিশাল একটা কাজ করে ফেলেছে, আমার দ্বায়িত্ব হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাকে একটা চাকরী জোগাড় করে দেয়া।
এখন মাঝে মাঝেই ভাবি আমাদের সমাজে চিন্তা ধারার অবক্ষয় কোন পর্যায়ে চলে গেছে! যে বয়সের ছেলেদের সমাজের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে ঋণ শোধ করার কথা, সে সময় তারা ভাবে সমাজ বা রাষ্ট্র তাদেরকে অনেক কিছু দিচ্ছে না কেন? জনগনের ট্যাক্সের টাকায় পড়ে, বেকার হয়ে ঘুরে আর ভাবে তার মতো মেধাবীকে রাষ্ট্র বা সমাজ কিছু দিল না। বিয়ের বয়স হলেই ছেলেদের ধারনা কোন একটা মেয়েকে বিয়ে করে উদ্ধার করে সমাজের প্রতি বিশাল বড় একটা দ্বয়িত্ব পালন করে ফেলেছে, সে এখন পায়ের উপর পা তুলেদিয়ে জীবন যাপন করার অধিকার রাখে, মেয়ের বাবা আর মেয়েটির কাজ হচ্ছে তাকে মাথায় তুলে নাচা।
বলতে পারেন, এ কথা তো সবার জন্য সত্য নয়। হ্যাঁ সবার জন্য সত্য নয়, তবে বেশির ভাগের জন্যই সত্য। এমন কোন বিশ্ববিদ্যালয় নাই যেখানে দুই টাকা বেতন বাড়লে আন্দোলন হয় না, তবে হাজার টাকা মোবাইল বিল প্রায় সবাই দিতে পারে। কোথাকার কোন দেশ ফুটবল বা ক্রিকেটে বিশ্বকাপ খেলবে বলে আমাদের দেশের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে বসে থাকে। ছাত্র রাজনীতির কথা আর কিই বা বলার আছে?
আমাদের সমাজ, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কি শিক্ষা দিচ্ছে? অশিক্ষিত একটা ছেলে রিকশা চালিয়ে, কৃষিকাজ করে বা ছোটখাটো দোকান চালিয়ে সমাজের প্রতি, পরিবারের প্রতি যে দ্বায়িত্ব পালন করছে, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে একটা ছেলে তা পারছে না। বরং সে আরও বেশি অযোগ্য হয়ে উঠছে। তার প্রত্যাশা বাড়ছে কিন্তু দ্বায়িত্ব জ্ঞান নয়। এটা অবশ্যই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি। লেখা-পড়া জানা বা ভালো রেজাল্ট করাটাকে সমাজে এতো বড় করে দেখা হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পর বা পাশ করার পর তারা ভাবতে থাকে বিশাল বড় দায়ীত্ব পালন করা হয়ে গেছে। শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এমন কোন ব্যবস্থা নেই যেখানে তাকে তার ঋণের কথাটা স্মরন করে দেয়া হয়।
আমার প্রস্তাব: জনগনের ট্যাক্সের টাকায় যারা পড়ার সুযোগ পাবে, ছাত্র জীবনেই তাদের ঋণশোধ করতে শুরু করতে হবে। যে সব কাছে খুব বেশি দক্ষতা প্রয়োজন হয় না তা দিয়েই শুরু করতে হবে , যেমন শহরে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ বা এই ধরনের কিছু (অন্য কিছুও হতে পারে)। সপ্তাহে ১০-১২ ঘন্টা কাজ করলে পড়াশুনার কোন ক্ষতি হবার কথা নয়, পড়াশুনাকে যতবেশি গুরুত্বপূর্ন মনে করা হয় আসলে তা এতো বেশি গুরুত্বপূর্ন নয় (অশিক্ষিত লোকজনই যখন সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মূদ্রা আয় করে তখন কথাটা আমি বলতেই পারি)। এই কাজগুলো হওয়া উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্তাবধানে এবং কোন প্রকার আলাদা তহবিল অনুদান ছাড়া। সরকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে যে তহবিল দেয় সেখানে শর্ত থাকা দরকার যে এর বিনিময়ে তারা দেশের কিছু কিছু কাজ করে দিবে। আমরা গরীব দেশের মানুষ, এখানে ১৮-২০ বছর বয়সের মানুষকে দ্বায়িত্ব নিতে জানতে হবে।
এই ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে যে ধরনের উপকার আমরা আশা করতে পারি তা হলোঃ
১. তরুন প্রজন্মের সমাজ বা রাষ্ট্রের প্রতি দ্বায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়বে।
২. কোন কাজকে ছোট ভাবার মানসিকতা দূর হবে।
৩. শিক্ষিত মানুষের তত্তাবধানে ছোট-ছোট কাজগুলো আরও দক্ষভাবে করার উপায় বের হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু পুঁথি পাঠ নয় বরং সমাজের প্রয়োজনে যথাযোগ্য দ্বায়িত্ব পালন করতে শিখবে যা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য।
৪. সরকারের খরচ কমবে।
৬. ছাত্র জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক কর্ম অভিজ্ঞতা হবে।
৭. দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ তৈরী হবে।
৮. সর্বপরি কর্ম পরিবেশে উদ্দোগী নেতৃত্ব তৈরী হবে।
হতে পারে আমার এই কথাগুলো আকাশ-কুসুম কল্পনা, বাস্তবে আমরা এটা কখনোই দেখতে পারবো না। তাই আমার এই পোস্ট টা হাস্যকর মনে হবে অনেকেরই কাছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস তারুন্যের মাঝেই আছে নিষ্কলুস দেশপ্রেম আর অমিত শক্তি, শুধু প্রয়োজন কথাটা তাদের স্মরন করিয়ে দেয়া। তাই এ ধরনের একটা উদ্দোগ সফল করা সরকারের কাছে খুব একটা কঠিন হবার কথা নয় বলেই আমার মনে হয়, সত্যিকারের দিন বদল করতে হলে বৈপ্লবিক উদ্দোগের প্রয়োজন আছে।