ইতিহাস বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ, ভবন আর চত্তর (ইটালিয়ান ভাষায় পিয়েৎসা) ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রোমে (ইটালিয়ান ভাষায় রোমা) অলিগলিতে। কালের সাক্ষি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এতো বেশি পুরাকীর্তি সম্ভবতঃ আর কোন শহরে নেই।
পুরাকীর্তির কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় দু'হাজার বছরের পুরাতন রোমের কলোসিয়াম। গ্লাডিয়েটর দের যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে এখনো প্রায় অটুট স্ট্রাকচার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই আ্যাম্ফিথিয়েটার। ৫০ হাজার দর্শক ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন কলোসিয়ামে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ আর দশ লক্ষাধিক প্রানী জীবন দিয়েছে। অমানবিক সে ইতিহাস আজ লীন, হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন এই কলোসিয়ামকে রোমানদের ঐতিহাসিক কীর্তি হিসাবেই দেখতে আসে।
বাইরে থেকে কলোসিয়ামঃ
কলোসিয়ামের ভিতরের দিকঃ
কলোসিয়ামের উপর থেকে রোমান ফোরামঃ
পরিকল্পনা করে দেখতে যান বা নাই যান আপনার চোখে পরবেই রাজা ভিট্টরিও ইমানুয়েল ২ এর স্মৃতিসৌধ। পিয়েৎসা ভেনিসিয়ায় অবস্থিত এই বিশাল আকৃতির সৌধটি রোমান আর্কেটেকচারের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে স্মরন করিয়ে দেয়। এই পিয়েৎসাটি মুসোলিনীর জনসভার জন্যও বিখ্যাত। মুসোলিনীর ভাষনের পর আবেগ আক্রন্ত জনতা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর করে রাখতো এই পিয়েৎসা।
ভিট্টোরিও ইমানুয়েল ২ এর স্মৃতিসৌধঃ
পর্যটকদের ভীরে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া দায় যে জায়গাটিতে তা হলো ট্রেভি ফাউন্টেন। প্রচলিত কথা হচ্ছে এই ঝরনায় একটি পয়সা ফেললে দ্বিতীয়বার রোমে বেড়াতে আসার স্বপ্ন পুরন হয়। ২য় এবং ৩য় পয়সা যথাক্রমে প্রেম আর বিয়ের জন্য। প্রায় চারশ বছরের পুরানো এই ফাউন্টেনে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার ইউরো জমা হয়।
ট্রেভি ফাউন্টেনঃ
আর একটি বিখ্যাত চত্তর হচ্ছে পিয়েৎসা নভোনা। খোলামেলা এই পিয়েৎসাটিতে আছে তিনটি ঝরনা। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে এই পিয়েৎসাটি নির্মিত হয়েছিল মূলতঃ ক্রীড়া প্রতিযোগীতার জন্য। এখন পর্যটকদের কলরবে মুখর থাকে সবসময়। ক্রিটমাসের সময় এখানে চলে মাস ব্যপি মেলা।
পিয়েৎসা নভোনাঃ
উঁচু টিলার উপর চার্চ আর মাঝখানে ঝরনা নিয়ে পিয়েৎসা ইসপানা। আসে পাসে আছে অভিজাত বিপনী বিতান। সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠলে চার্চের সামনে দেখতে পাবেন স্কেচ শীল্পিদের। ১০ থেকে ৩০ ইউরোর বিনিময়ে তারা মূহুর্তেই এঁকে দিবেন আপানর স্কেচ।
পিয়েৎসা ইসপানাঃ
খ্রীষ্টপূর্ব ১০ সালে মিশর থেকে নিয়ে আসা রামিসিস ২ এর ওবেলিস্ক আর সাথে চার্চ নিয়ে বিশাল বড় পিয়েৎসা ডেল পোপোলো। একসময় এখানে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হতো। অবশ্য ১৮২৬ সালের পর এখানে কোন মৃত্যু দন্ড কার্যকর করা হয়নি।
পিয়েৎসা ডেল পোপোলোঃ
রোমান ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ডোম নিয়ে যে ভবনটি তা হলো প্যান্থিয়ন। খ্রীষ্টপূর্ব ৮০ সালে যখন ভবনটি তৈরী করা হয়েছিল তখনকার উদ্দেশ্য জানা যায় না। ৭ম শতকের দিকে এটি চার্চ হিসাবে ব্যবহৃত হতো। রেনেসাঁর সময় থেকে এটি বিখ্যাত মানুষের কবর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্যান্থিয়নঃ
এবার আসা যাক রোমের মধ্যে স্বার্বভৌম দেশ ভ্যাটিকানের দিকে। ১১০ একর এলাকায় ৯০০ মানুষের বসবাসের এই দেশটির প্রধান হচ্ছেন পোপ। বিশাল আকৃতির সেন্ট পিটারস স্কয়ার, সেন্ট পিটার'স ব্যাসিলিকা (চার্চ) আর ভ্যাটিকান মিউজিয়াম নিয়েই এখানকার সব কিছু। ধর্ম প্রান খ্রীষ্টান সহ হাজার হাজার পর্যটক প্রতিদিন ভীর করে ভ্যাটিকানে। বিশাল আকৃতির এ চার্চের ভিতরটা দৃষ্টি নন্দন কারুকাজে ভরা। তাছাড়া এই চার্চেই আছে প্রথম থেকে শুরু করে সকল পোপের কবর।
রোমের পথে ঘাটে সবচেয়ে বেশি যে মানুষদের চোখে পরবে আপনার তারা হচ্ছে পর্যটক। এর পরই চোখে পরবে বাংলাদেশীদের। লক্ষাধিক বাংলাদেশীর বাস এই ইটালীতে। তার পরও যদি কোন রোমানকে বাংলাদেশের কথা বলেন, তবে দেখবেন তারা এই দেশটাকে চেনেই না অথবা না চিনার ভান করে। চেক ইনের সময়, হোটেলের রিসিপশনিষ্ট তো আমাকে বলেই বসলো, কম্পিউটার ডাটাবেজ এ তো এমন কোন দেশের নাম দেখছিনা।
নিজেদের জাতীয়তা নিয়ে রোমানদের অহঙ্কার বোধ সর্বজন বিদিত। ইতিহাসের দিকে তাকালে বলা যায়, নিজেদের ইতিহাস বা ঐতিহ্য নিয়ে ওরা গর্ব করতেই পারে। তবে ওদের এই অহঙ্কার শুধু ইতিহাস কেন্দ্রিক এবং তা ওরা জানেও ভালো করেই। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাথে, এমনকি উত্তর ইটালীর শহরগুলোর সাথে নিজেদের অর্থনীতির তুলনা করে কিছুটা হীনমন্যতায় যে ওরা ভোগে তা বেশ স্পষ্ট। বর্তমানকে নিয়ে রোমানদের সম্ভবতঃ গর্ব করার তেমন কিছু নেই, এটা তারাও জানে।
রোমের যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিক হলেও, উন্নত শহরগুলোর সাথে এর তুলনা চলে না। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে কোথাও যেতে অনেক সময় লাগে। আবার নিজে ড্রাইভ করলে পার্কিং এর জায়গা পাওয়া কঠিন। পর্যটকদের জন্য অবশ্য ভালো সার্ভিস বাস আছে। তাছাড়া শহরে মধ্যে হেঁটে হেঁটেই বেশির ভাগ যায়গা দেখা যায়।
নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে বলতে হয় ইউরোপের অত্যন্ত বাজে শহরের একটি রোম। পূর্ব ইউরোপ, আফ্রিকা বা এশিয়ান অভিবাসি দের এলাকাতে তো বটেই, এমনকি এখানকার সবচেয়ে বড় রেল ষ্টেশান টারমিনিতেই পকেট মারের উৎপাত অনেক বেশি। ছিনতাই ও হয় শহরের বাইরের দিকে। মেশিনে টিকেট কাটতে গেলে তাই দেখবেন সতর্কবানী - পকেট সাবধান।
আপনাদের কমেন্ট দেখার পর মনে পড়লো একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমার এই লিখা রোম এবং রোমানদের নিয়ে। রোমের বর্তমান অবস্থা কিন্তু ইটালীকে রিপ্রেজেন্ট করে না। মিলান অনেক আধুনিক শহর। উত্তর ইটালী অর্থনৈতিক দিক দিয়েও অনেক সমৃদ্ধ। ইটালীর অন্যান্য অংশ নিয়ে আরও পোষ্ট দেবার ইচ্ছা আছে।
মন ভালো করা কিছু ছবি - ক্যামেরার চোখে কায়রো: Click This Link
ছবিতে প্যারিস: Click This Link
মজার ছবি - জিব্রাল্টার এয়ার পোর্ট(???): Click This Link