মক্কার মুশরিকরা-তো দৌর্দান্ত প্রতাপের সাথে ইসলামের মোকাবিলা করে টিকতে না পেরে তাওহীদের সুমহান আদর্শের সামনে চিরতরে মস্তক অবনত করে দিয়েছে। রোম-পারস্যের ভাগ্যলিপিতো আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন আগেই ফয়সালা করে দিয়েছেন, রাসুল (সাঃ)ও বিজয়ের সুসংবাদ জানিয়েছেন। এখন তো শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। ঠিক তখনি উম্মাহ্র মোকাবেলায় ময়দানে অবতীর্ন হয় নতুন এক তাগুতী শক্তি। আর সেটি হলো খতমে নবুয়তকে অস্বীকারকারী। এরা খোদ মিল্লাতে ইসলামিয়ার মধ্য হতেই সুযোগসন্ধানী কতিপয় ধর্মব্যবসায়ীদের সুসংগঠিত এক জামাত। যা উম্মাহকে জানিয়ে দিল এবার তোমাদের লড়তে হবে ঘরেই ছদ্মবেশী শত্র“দের সাথে।
আসহাবে রাসুল (সাঃ) এই চ্যালেঞ্জকে উপযুক্তভাবেই গ্রহণ করলেন। আল্লাহ পাক সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) কে রহম করুন। তিনি খিলাফাত আ’লা মিনহাজুন নবুয়্যাহর জিম্মাদারী পাওয়ার পরপরই জাজিরাতুল আরবের ফিতনা কবলিত অঞ্চলসমুহে মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করতে সামান্যতম দ্বিধা করলেন না। বরং নজীরবিহীন দৃঢ়তা ও সাহসিকতার নৈপূন্য প্রদর্শন করলেন।
মুরতাদদের প্রথম উত্থান হয় ইয়েমেনে। এটি আসওয়াদ আল আনসীর ঘটনা নামে পরিচিত। আসওয়াদ ৭০০ অশ্বারোহীর এক বাহিনী নিয়ে নাজরান আক্রমন করে সহজেই দখল করে নেয়। মদীনা হতে রাসুল (সাঃ) আসওয়াদের সকল অপকর্মের খবরাখবর সংগ্রহ করে কায়েস বিন যুবায়ের (রাঃ) কে গোপনে তাকে হত্যা করতে পাঠান। আসওয়াদ আনসীর মিথ্যা নবুয়তের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিন মাস এবং সমাপ্তি ঘটে রাসুল (সাঃ) এর ইহলোক ত্যাগের ছয় দিন আগেই।
তখন আসওয়াদ আনসী ছাড়াও আরো তিন ভন্ড নবুয়তের দাবি করে। এর মধ্যে একজন মহিলা। তুলায়হা বিন খুওয়ালিদ, মুসায়লামাতুল কায্যাব বিন হাবীব, সাজাহ বিনতে আল হারিস। সাজাহ বিনতে আল হারিসকে মুসায়লামাতুল কাযযাব বিয়ে করে।
ধর্মত্যাগের ঘটনা এত ব্যাপক রুপ ধারন করে যে মক্কা, মদীনা ও তায়েফের বনু সাকীফ ব্যতিত পুরো জাজিরাতুল আরবের সকল গোত্রই এত শামিল হয়। রাসুল (সাঃ) এর ওফাতের পর মুসলমানদের অবস্থা ছিল “বৃষ্টিভেজা প্রচন্ড শীতের রাতে অসহায় ভেড়ার পালের মত”।
ভন্ড নবী তুলায়হা বিন খুওয়ালিদকে শায়েস্তা করার জন্য পাঠানো হয় আল্লাহর তলোয়ার রনাঙ্গনের সিংহ হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) কে। তাঁর মোবারক কাফেলায় স্বতস্ফুর্তভাবে শরীক হলেন বহু পুন্যাত্মা সাহাবী রাযিআল্লাহু আনহুম। রাসুল (সাঃ) এর অসুস্থতার সময়েই তুলায়হা নবুয়ত দাবি করে। পরবর্তীতে সে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং বিখ্যাত আনসারী উক্কাশা ইবনে মিহসান আসাদী (রাঃ) ও ছাবিত ইবনে আকরাম বালাবী (রাঃ) কে শহীদ করে দেয়। এরপর বুযাখার যুদ্ধে সে আল্লাহর তরবারি খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর হাতে চরমভাবে পরাজিত হয়। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় ‘হক্ব নবুয়তের অনুসারী’দের মোকাবেলায় ‘ভন্ড নবুয়ত’ কত ঠুনকো। এখানেই তার ধর্মদ্রোহীতার পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর তো সে নিজেই আন্তরিকভাবে ইসলাম কবুল করে নেয়। পরবর্তীতে সে কাদিসিয়া ও নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে অসম সাহসিকতা ও যুদ্ধনৈপুন্যের পরিচয় দেয়। নাজাফের ময়দানে পারসিকদের ছত্রীছাওনীতে একাই নৈশ হামলা চালিয়ে কাফেরদের বিখ্যাত এক ফৌজি অফিসারকে হত্যা করতে সমর্থ হয়। যার আসল নাম ইতিহাসের পাতায় না পাওয়া গেলেও তার উপাধিটি ছিল তার সত্যিকারের পরিচয় ‘হাজার সওয়ার’। অর্থাৎ সে একাই এক হাজার ঘোড় সওয়ারের মোকাবেলা করতে পারত। আর বারসিমার ময়দানে পারসিক ফৌজের শক্তিশালী ও দুর্দান্ত মহাবীর সালার জালিয়ুনুসকে মারাত্মক আহত করেছিল। পারস্য বিজয়ের এ মহান জিহাদে শাহাদাত বরন করে সে ইসলাম বিরোধিতার মুল্য প্রদান করে।
কোন একসময় উমর (রাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন “তুমি কি পুন্যবান উক্কাশা বিন মিহসান (রাঃ) কে হত্যা করেছিলে?” সে তখন বলল “জী, আমার মাধ্যমে উক্কাশা ভাগ্যবান হয়েছেন, আর তার মাধ্যমে আমি দুর্ভাগ্যের অধিকারী হয়েছি। এখন আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”
নবুয়তের আরেক দাবিদার ভন্ড মুসায়লামাতুল কায্যাবের মোকাবেলায় পাঠানো হয় ইসলামের নওসেনানী হযরত ইকরামা (রাঃ) বিন আবু জেহেল কে। মুসায়লামা তার ৪০,০০০ যুদ্ধ পাগল সৈন্য নিয়ে আকরাবা সমতল ভুমিতেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। পরবর্তীতে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) ১৩,০০০ সৈন্য নিয়ে মুসায়লামার মোকাবেলায় আসেন।
এই যুদ্ধে তাঁর সাথে শরীক ছিলেন ওহুদে হযরত হামযা (রাঃ) এর হত্যাকারী ওয়াহশী ও হযরত আবু দুজানা (রাঃ)। হযরত ওয়াহশী (রাঃ) বর্শা নিক্ষেপ করেন, এটি মুসায়লামার পেটে বিদ্ধ হয় এবং আবু দুজানা (রাঃ) তৎক্ষনাৎ তরাবারির আঘাতে মাথা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে এক মুরতাদ হযরত আবু দুজানা (রাঃ) কে শহীদ করে দেয়। এই আবু দুজানা (রাঃ) ওহুদে রাসুল (সাঃ) কে শত্র“র তীর হতে রক্ষার জন্য নিজের দেহকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি এদিনে নিজের জীবন দিয়ে খতমে নবুয়তের এ চিরন্তন আকীদাকে হেফাজত করে গেলেন।
ওয়াহশী (রাঃ) তার পরবর্তী জীবনে তার বর্শাটি দেখিয়ে বলতেন “আমি বর্শাটি দিয়ে কাফের থাকা অবস্থায় একজন শ্রেষ্ঠ মানুষকে আর মুমিন হিসেবে একজন নিকৃষ্ট মানুষকে হত্যা করেছি”।
মুসায়লামার মোকাবেলায় ইয়ামামার যুদ্ধ ছিল তৎকালীন সময়ের জন্য ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে নিখুত ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এতে মুসলিম বাহিনীর প্রায় সহস্রাধিক যোদ্ধা শাহাদাত বরন করেন, যার মধ্যে অসংখ্য আনসার ও মুহাজির ছিলেন। আর হাফিজে কুরআন ছিলেন ৩০০ জন। এসব ‘হাফিজুল কুরআন’ সাহাবী জীবনের বিনিময়ে ইসলামের এ মহান আ’কীদাকে নিরাপদ রেখে গেলেন।
এভাবে সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম পুরো আরবের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেন এবং মাত্র এক বছরের মধ্যে সমস্ত ফিতনা ফাসাদ দুর করে ভন্ড নবীদের নবুয়তের স্বাদ মিটিয়ে দিয়ে পুরো জাজিরাতুল আরবকে পুনরায় ইসলামে দাখিল করালেন। ইসলামের এ নয়া দুশমনদের কবল থেকে উম্মাহকে পরিত্রাণ দিয়েই সিদ্দিকে আকবর হযরত আবু বকর (রাঃ) ইসলামের ত্রানকর্তারুপে বরিত হলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) যথার্থই বলেছেন “রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ইন্তিকালের পর আমরা এমন এক অবস্থায় উপণীত হলাম যে, যদি আল্লাহ আমাদেরকে আবু বকরের দ্বারা অনুগ্রহ না করতেন, তবে আমরা ধ্বংস হয়ে যেতাম।”
খিলাফাতে রাশেদার পূণ্যতম যুগে আর মাথাচাড়া দেওয়ার সাহস তাদের হয়নি। উমর ইবনুল আব্দুল আজিজের উমাইয়া আমলে উম্মাহ্র দোর্দন্ড প্রতাপের সামনে দাড়াতে সাহস করেনি এই অপশক্তি। হারুন অর রশিদের আব্বাসী শাসনকালেও পাত্তা পায়নি। উম্মাহ্র দুর্বল বন্ধন উসমানী খিলাফাতের সময়ও এরা সে সুযোগ পায়নি।
সিদ্দিকী ঈমান, খালিদের হুংকার, ইকরামা-ওয়াহশীর ইখলাস তছনছ করে দিয়েছিল তাদের রঙ্গীন স্বপ্ন। প্রথম পদক্ষেপে হেরে গিয়েও দমে যায়নি এই অপশক্তি। যেন গুছিয়ে নিলো নিজেদের, সংশোধন করে নিলো ত্র“টিবিচ্যুতি নতুন চক্রান্ত শুরু করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। এরপর যখনই সুযোগ পেয়েছে মাথাচাড়া দিতে চেষ্টা করেছে শয়তানী শক্তি। যখনই উম্মাহর ঈমান ও আ’মাল দুর্বল হয়েছে পার্থিব লালসায় তখনই পূর্বের চেয়ে দৌর্দান্ত প্রতাপে ছোবল মেরেছে। কিন্তু উম্মাহর দাপটের সামনে টিকতে পারেনি।
যখন উম্মাহ্র ঈমানে ঘুণ ধরেছে, বীরত্বে টানা পড়েছে, ঐক্যে ফাটল ধরেছে, বৃটিশ বেনিয়াদের ষড়যন্ত্রে খিলাফাত হারানোর ব্যথায় ব্যথিত, তখনই মুসলমানদের পুনরায় বিশ্ব দরবারে মাথা উচু করে দাড়ানোর সুযোগ না করার স্থায়ী ও পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করার মানসে দাড় করালো তাদের ‘নুন খাওয়া’ গোলাম-কে ‘গুন গাওয়া’ র জন্য “গোলাম আহমদ” নাম দিয়ে।
ইতিপুর্র্বে কখনই এদের সাথে সরাসরি কোন রাজশক্তি জড়িত ছিল না। কিন্তু এবার একে প্রকাশ্য মদদ দিল সেই রাষ্ট্র যার সীমানায় কখনও সুর্য ডুবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য এই মরণ কামড়টি এসেছে আমাদের মত দুর্বল ঈমানধারী ভারতবর্ষে। সিদ্দিকী ঈমানের মোকাবেলায় আমাদের যেখানে রয়েছে মীর জাফরের মত কওমের গাদ্দার, ওয়াহশীর মোকাবেলায় মুহাম্মদী বেগের মত স্বাধীনতার ঘাতক, ইকরামা-খালিদের পরিবর্তে মীর সাদেকের মত ঈমানবিক্রেতাদের ঐতিহ্য, সেখানে আমরা কিভাবে এই মরণ আঘাত মোকাবিলা করতে সক্ষম হব। আমরা যেন আগেই তাদের স্বাগত জানাতে তৈরী হয়ে আছি।
মুসায়লামাতুল কায্যাবের যে সফল উত্তরাধিকারী এই উম্মাহকে চালেঞ্জ জানিয়ে তাদের কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌছে গিয়েছে সে হল ভারতের কাদিয়ান অঞ্চলের গুরুদাসপুরের গুরুদাস মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী। তার মেহনত এতদুর সফল হয়েছে যে তাদের মোকাবিলায় কোন বাহিনী প্রেরণ বা অভিযান পরিচালনা করার কথা উম্মতে মুসলিমা তো ভুলেই গেছে। বরং বলার সাহসটুকুও নেই। এখন শুধু একটি ফতোয়া দিয়েই ক্ষ্যান্ত হতে চাচ্ছে যে ওরা অমুসলিম, ওদের সাথে বিয়ে-শাদী, সামাজিক আচার-আচরন অমুসলিমদের মত করতে হবে, ওদের উপাসনালয়গুলোকে মসজিদ বলে অভিহিত করা যাবে না।
ভারত-পাকিস্থানে না হয় মুফতী মুহাম্মদ শফী, আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী, আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী, মিষ্টার মওদুদী, ড. স্যার মুহাম্মদ ইকবালের মত রাসুল সৈনিকদের দেখা মিলে। কিন্তু কই আমাদের দেশে তো কোন একজন ‘আরমান’কে আর ঝলসে উঠতে দেখি না। বিচারপতি কে, এম, সোবহান, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, শাহরিয়ার কবীর, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিষ্টার রোকনুদ্দিন, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, ড. ইউনুস, মতিউর রহমানদের মত কাদিয়ানীসমর্থকরাই তো কেবল নজরে পড়ে। কাদিয়ানী সালানা অনুষ্ঠানের মধ্যমনিদেরই কেবল দৃষ্টিগোচর হয়। এদেশের একজন সাবেক প্রধান মন্ত্রীর মুখের ভাষাই যখন এরকম “ কে মুসলমান কে অমুসলমান তা নির্নয় করবে আল্লাহ”। যেদেশের জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে ছাপা হয় “কাদিয়ানীরা অমুসলিম, এ দাবী অন্যায়”। সেদেশে আমরা কিভাবে দাবী করতে পারি আমরা কাদিয়ানীদের সমর্থন করি না?
তাহলে কি আমরা মুহাম্মদে আরাবীর পরিবর্তে গুরুদাসপুরের গুরুদাসকেই নবী বলে মেনে নিয়েছি? আমাদের প্রথাসবর্স্ব ‘খতমে নবুয়ত আন্দোলন’ দিয়ে কি রাসুলের উম্মত দাবি করতে পারবো? তাঁর শাফায়াত পাওয়ার যোগ্য হতে পারবো? খোবায়েব-খাব্বাবের মোকাবেলায় রবিউল আওয়ালের রাসুলপ্রেম, ‘কয়েক মর্তবা দুরুদ’, মিলাদ দিয়েই কি তাঁর উম্মত দাবি করা যাবে?
আমরা আমাদের ঈমানের ব্যাপারে যতই আপোষ করি না কেন, আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন তাঁর প্রেরিত রাসুল ও ভন্ড নবুয়তের দাবীদারের মধ্যে সুষ্পষ্ট পার্থক্য নিরুপনের জন্য তাদের অন্তিম সময়কেই বেছে নিয়েছেন। একজনকে পরম ইজ্জতের সাথে মওত নসীব করেছেন। অপরজনকে টয়লেটে পায়খানা ও বমির মধ্যে হাবুডুবুরত অবস্থায় চরম জিল্লতির মৃত্যু দান করেছেন।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ সকাল ৯:২৮