জল চিক্ চিক্ জল চিক্ চিক্ নদী বয়, ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল। কল কল কল কল, নদী বয়। তীরে কূলে ঝপ ঝপ শব্দ নদীর পানি ছিটায়। বাতাস আসে বাতাস, উদাম উদিলা বাতাস, সর সর বয়ে যায়, হু হু, একটানা, বিরামহীন। সরে সরে যায় জল, ঢেউ ভাঙ্গে আর ঢেউ গড়ে, ঢেউয়ে ভর করে নদী আগায়, দিগন্তে। সেই নদীতে একটা লাশ ভাসে, ফোলা ফোলা, খুবলে খাওয়া, রক্তবাহিতা লাশ। তার যোনি পথের রক্ত ধারার লালটুকু দীর্ঘ এক রেখা তৈরি করে। ক্ষীণ, আঁকাবাঁকা, কিন্তু রঙিন। তার নিথর হাত শরীর কোমরে জড়িয়ে থাকা ওড়না ঢেউয়ে দোলে, মৃতের হাত হয়ে ওঠে, কূল ছুঁতে চায়, কূল । পাজামা নাই, উদিলা উরু, তাতে রক্ত ছাপ, সলোয়ার লেপ্টে আছে, স্পন্দনহীন স্তনে। এই লাশ দিনাজপুর থেকে আসে অথবা পাহাড়ের ঝর্ণা হতে, এই লাশ আসলে নদী হয়েই আসে। অথবা এই নদী লাশ হতে থাকে, অথবা এই নদীর নাম ইয়াসমীন কিংবা কল্পনা।
শরীরে ওড়না পেঁচিয়ে ন্যাংটা নারী লাশটি তার ভেসে চলার তৃতীয় দিনে অথবা দিন তারিখের কোন নির্দিষ্টতা তার থাকে না বলে কেউ বলতে পারে না কতো দিনে এই লাশ যমুনাশ্বরীতে এসে পড়ে। এই মানবির নাম পরিচয় এখন খালি লাশ, মৃত নারীর শরীর-ধর্ষিতার দেহ-জলে ভাসা। তার ধর্ষণের চিহ্ন হয়ে যোনি পথের রক্ত এখনও নদীর জলকে রক্তাক্ত করছে। নীল শাদা কাদাগোলা সবুজ কালো পানি চিরে ঠিক একটা লাল রক্তের রেখা এই লাশের ধর্ষণের চিহ্নকে বয়ে চলেছে, জনপ্রান্তরে। তাছাড়া তার নগ্ন উরুতে ক্ষতের চিহ্ন, মুখে দাঁতনখরের হিংস্রতা এবং শেষমেষ তার প্রাণহীন দেহ ধর্ষিতা নামেই তাকে নদী পাড়ের মানুষের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে নামেই সে ভাসতে থাকে। হঠাৎ কেউ ওই বেহুলা যায়রে বইলা ভোরঘষা মুখে হাঁক দিয়ে উঠলেও সূর্য রোদের স্পষ্টতা তাকে বুঝিয়ে দেয় সে আসলে ধর্ষিতা। দেহতরি হয়ে ভেসে চলে, খড়কুটো অথবা প্রশ্ন হয়ে। উত্তরহীন প্রশ্নের শূণ্যতা ভরায় সবুজ ধোয়া বাতাস, ঢেউ জাগে জলে, ভেসে যায় লাশ। ইয়াসমিন অথবা কল্পনা কিংবা ধর্ষিতা।
ছ্যা ছ্যা ছ্যা, নষ্টা মাইয়ার লাশ, আর স্নান করা যাবিনাগো, এ যে পাপ।
শর্মিলা তার স্তনের বৃন্তে পুরুষালি দাঁতের দাগকে ভেজা আঁচলে আড়াল করে নদীবাহিত নারী লাশটি দেখে এই ক্ষেদোক্তি করে। তাতে নদী কিংবা লাশের কিছু যায় আসে না, তারা ভেসেই যায়। আর ভেসে যায় যোনি পথের রক্ত। কিন্তু কোথায় এসে যেন নদীর পানি কালো আর গা গোলানো, লাশেরও গা গোলায় বুঝি। এইযে রঙের পানিটা, ডাইংয়ের পানিটা নদীর মইধ্যে যেইভাবে ছাড়তাছে -এভাবে মাছ সব মইরা যাইতাছে; আগে বড় বড় বোয়াল মাছ, আইড় মাছ, মিরকা মাছ, রুইত মাছ, বাউস মাছ, চেউয়া মাছ, চাপিলা মাছ, বাইল্যা মাছ, বাইম মাছ অইত, অহন যে কেন আয়না- এই রঙের পানির কারণে। পুরুষালি কারখানার বিষজলের ধারা শিশ্ন হয়ে প্রবিষ্ট হয় নদীতে, পুরুষালি লালা আর বীর্যে ক্লেদাক্ত নদীর জল। অত জোরের বাতাসও বুঝি একটু দ্রুত পার করে দিতে পারে না ইয়াসমিন কিংবা কল্পনাকে। তাদের শরীরেওতো ওই শিশ্নের অমানবিক প্রবেশ ঘটেছে। মাংস এই মাংস তার শরীরে এমন বিভীষিকা হয়ে বেড়ে উঠছিলো তা সে বুঝতে পারেনি। এখন নীলশাদার খোলা আকাশের জলে সেই মাংস পঁচে- চিল আসে, শকুন আসে, গজার আসে- খুবলে খায় নারী মাংস, ধর্ষিতার জীবনমরন মাংসসম । হা, এই নারী যদি কেবল হাড্ডি চামড়ায় জন্ম নিত।
নুরুলামিনের মাছ ধরবার নৌকার বৈঠা সবুরের হাতে। দূর থেকে ভেসে আসা লাশটা দেখবার সাগ্রহে সে লাশের নিকটবর্তী হয়। বিকট এক গন্ধে নাকমুখ ভারি হয়ে ওঠে। হেই হেই কি করস কি করস বৈঠা লাগাইস না, অপয়া লাশ, নষ্টা নষ্টা, তুই আমার নৌকা দূরে সরা দূরে সরা, নাউযুবিল্লাহ, এসব দেখাও যে পাপ। তবুও নির্বিকার থাকে ভাসমান কল্পনা। অনুভূতি শূণ্য তার শরীর, ফোলা ফোলা, দিনান্তে ক্ষয়ে যায়। খসে খসে পড়ে গায়ের মাংস, গন্ধ ছড়ায়, পাপ হয়েই বয়ে চলে সে, তারে স্পর্শে অক্যলাণ ঘটে। প্রথম যেদিন সুবল তার খ্যাও জালে নদীর তল থাইকা এই লাশ টাইন্যা তুলে, সেদিন সে আকাশে নরক দেখে, ভার ভার জাল টানতে টানতে সে কখনো ভাবে নাই একটা লাশ উইঠা আসবে, ভয় পাইছিলো সে ভীষণ ভয়, তখনো তাকায়া ছিলো মায়াডা, রক্ত লাগা চোখে। এরপর সে জাল সুদ্ধা লাশ ফালায়া দৌড় দেয়। তারপর থেকে ইয়াসমিন অথবা কল্পনা অথবা একটা ধর্ষীতার লাশ কূল খুঁজে ফেরে।
নয়া বউয়ের রাঙা শাড়ি
হেইয়া হো হেইয়া হো
ছাইড়া আইছে বাপের বাড়ি
হেইয়া হো হেইয়া হো
লালসবুজের বজরা তীরে ভেড়ে। জয়তুন নামে বজরা থেকে। তার শাড়ি গয়নার শরীরে আঁচলে ঢাকা ভিরু মুখ। পালকিতে ওঠার আগের মূহূর্তে সে নদী দেখে-ফেলে আসা আকাশভূমির আঁচটুকু চোখে মেখে নিতে চায়। কিন্তু দেখে লাশ। চমকে ওঠে, কাকে দেখে সে, জলে ভাসা লালটুকু যে তার শাড়ির রঙ হয়ে আছে। বিয়ের যাত্রীরা দূর দূর করে ওঠে। কি আকাল আইলো এক নদীতে সবই ভাসে, বউ-লাশ সব। এগিয়ে চলে পালকি। ভেসে চলে লাশ, কালো হতে থাকে। শাদা হাড় বেরিয়ে আছে কোথাও কোথাও। জয়তুনের মনে মনে আবারো হয়তো জেগে ওঠে মৃত নারীর শরীর। গোঙায়, সন্তর্পনে।
খবর রটে যায়। একটা অজানা লাশ, কারা জানি তারে পুটকাইছে, হেই লাশ গ্রামগ্রামান্তর ভাইসা বেড়ায়। আটকাইতে হব এই লাশ, পাপ ছড়াইতাছে, অমঙ্গল ঘোর এক অমঙ্গল আসবে নিচ্চয়। নদীর কূলে কূলে ভিড় করে কেউ কেউ, কাইল দুপুরে খানসামায় একজন এই লাশ দেইখা গলায় ফাঁস দিছে। জাহেদার নাকি খোঁজ নাই। সে লাশ দেখমু বইলা বাইর হইছিলো, আর ফেরে নাই। আর পানিতে কেমুন জানি একটা বাস আহে, ঘোরলাগা বাস। এই লাশ নিয়া গল্পেরও শেষ নাই। রুপালি ঝিলিকের চিতল নাকি ঘের দিছে লাশের চাইর পাশে। অহন আর চিল শকুন কি বোয়াল আইসা খামচাইতে পারে না। রাইত হইলে হাজারে হাজার জোনাক নাকি আলো জ্বালায়। কেউ কেউ দেখে এই দৃশ্য, বেশিরভাগই শুনে। ভয়ে দেখতে যায় না। অথবা দেখেতে পাওয়ার আগেই লাশ ভাইসা জায়গা, অন্য কোথাও অন্য কোন গ্রামে। কেউ কেউ রাতের লাশ দেখে, আহো আহো দুধবিবি ভাইসা জায়, দেহো দেহো। কিন্তু পরদিনের সূর্যালোক ভুল ভাঙ্গিয়ে দেয়। সবাই বুঝতে পারে এ-তো ধর্ষিতার লাশ। হা রাম হা রাম। ধ্বংস আসবেগো ধ্বংস-ঘাটিয়াল দেবতার কোপ লাগিবে নিচ্চিত।
চুড়ি লাগব নি চুড়ি,
লাগব নি কাঁচের কাপ-পিরিছ, প্লেট-বাটি,
খেলা দেখাইগো খেলা, সাপের খেলা,
রস টানি, বাত টানি, কোমড় টানি, মাঝা টানি,
চোখের পোকা, দাঁতের পোকা ফালাই, শিঙ্গা লাগাই
ডাকতে ডাকতে বাইদ্যার দল হেঁটে যায়। তাদের কোমরের বাঁকে নদীতে বাঁক জাগে, নদী তাদের হেলানো কোমরের ছন্দের দূরবর্তী হয়। তাদেরই একজন শ্যামলা, লাশটি দেখতে পায়। দাঁড়িয়ে পড়ে। হেই টেপি দ্যাক দ্যাক এট্টা লাশ ভাইসা যায় রে। বাকিরাও দাঁড়ায়। চ, লাশটারে কব্বর দিয়া যাই। সবাই তাতে সম্মত হয়। হয়তো কোন সাপে কাটা লাশ, ভাবে তারা। কিন্তু লাশের-তো ধরবার জায়গা নাই। পানি পঁচা লাশের সে কি গন্ধ। কোমর পানিতে নামে কয়েকজন, একটা লাঠি দিয়ে লাশ টেনে আনে। খড় লতাপাতা হাতে পেঁচিয়ে লাশটা ধরে না, পানিতে ভাসিয়ে টেনে আনে। এর মধ্যেই কয়েকজন নদীর কালচে পলিমাটিতে যতদূর পারে গর্ত করে নেয়। কাজের ফাঁকে লাশটি দেখে, বোঝা যায় না মুখাবয়ব, চোখের কোটর ফাঁকা, বুক পেট ফুলে ফেঁপে সমান। উরু, পাছায় খোবলানো মাংস, হাড় বেরিয়ে আছে, মৃতের হাসি যেনবা।
এই লাশের নাম পরিচয় তাদের জানা নাই। কাজ করতে করতেই কথা বলে আশা-মানুষ হইয়ে মানুষেরা ঘিন্না নাইকা-মহাপাপ। আমি যামু, আমারে দেইখা কেউ ঘিন্না করে করুক, আমি তারে ঘিন্না করলাম না। লাশ হইছে তায় কি, মানুষতো আছিলো। তারা বুঝতে পারে না, এই লাশ ধর্ষিত কি না। অথবা তাদের মনেই আসে না বিষয়টা। লাশ কবর দিয়ে তারা উঠে আসে। নদীতে তখন শেষ সূর্যের আলো অথবা যোনি পথের রক্ত লাল আভা। রজস্রাবের রঙ লাগে দিন শেষের আকাশে। পুরুষালি কালো চিমনির ধোঁয়া ক্রমশ বিস্তৃত হয়। রাত আসে রাত, ঘনকৃষ্ণ রাত। কালো জলে এখন আর লাশ ভাসে না। মাটির নরোম শয্যায় তার অন্তর্ধান ঘটেছে। কালো নদী নিরন্তর কাঁদে, সেই কান্না হয়তো মাছের গায়ে জমা হয়, লোট লোট। পাড়ের মানুষেদের এখন সুখঘুম রাত। তবুও আরেকটা লাশ আসতে থাকে, ছিন্নভিন্ন যোনি নিয়ে, রক্তাক্ত। কারণ সভ্যতার নদী এবং তার পাড়ে পাড়ে ধর্ষণ কখনো বন্ধ থাকে না। বৃষ্টি আসে-নদী হাসে, মেঘ আসে-ছায়া ভাসে। আর ভাসে লাশ, কল্পনা অথবা ইয়াসমিন অথবা ধর্ষিতার লাশ। আরো কোন পলি মাটির সন্ধানে।
*দুধবিবি-দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের মাদারপিরের পালার একটি চরিত্র। মাদার পিরের বউ।
*ঘাটিয়াল দেবতা-দিনাজপুর অঞ্চলের লোককাহীনির দেবতা। পানির নিয়ন্ত্রক। কালী পুজার পাশাপাশি এরও পুজা দেয়া হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০০৯ রাত ২:০৬