প্রাত্যহিকতার পিতা আজ একটা দিবসব্যাপি নিজের ভাবনাগুলোয় নিরন্তর আবেগ আর আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু জন্মদাতাকে মানে আর ভানেই-তো এতোকাল বিচার করে এসেছি-কি সাধ্য আজ তার ভার নেই। পারবোও না কোনদিন। বরংচ ইতিহাসের পিতাদের দিকেই তাকাই, এটা অন্তত স্বস্তিকর।
রবীন্দ্রনাথ তার পিতা সম্পর্কে বলছেন- 'আমার জন্মের অনেক বছর পূর্বে হইতেই আমার পিতা প্রায় দেশ ভ্রমণেই নিযুক্ত ছিলেন। বাল্যকালে তিনি আমার কাছে অপরিচিত ছিলেন বলিলেই হয়। মাঝে মাঝে তিনি কখনো হঠাৎ বাড়ি আসিতেন। .........যাহা হউক, পিতা যখন আসিতেন আমরা কেবল আশপাশ হইতে দূরে তাঁহার চাকরবাকরদের মহলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কৌতূহল মেটাতাম। তাঁহার কাছে পৌঁছানো ঘটিয়া উঠিত না।' সেই পিতাই রবীন্দ্রনাথের বন্ধু হয়ে উঠেছেন- রবীন্দ্রনাথকে বাড়ির বাইরের বিশ্বভূবন দেখাচ্ছেন। ''একবার মাঘোৎসবে সকালে ও বিকালে আমি অনকগুলি গান তৈরি করেছিলাম। তাহার মধ্যে একটা গান- 'নয়নে তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছো নয়নে নয়নে।'
পিতা তখন চুঁচুড়ায় ছিলেন। সেখানে আমার এবং জ্যোতিদাদার ডাক পড়িল। হারমোনিয়ামে জ্যোতিদাদাকে বসাইয়া আমাকে তিনি নূতন গান সবকটি একে একে গাহিতে বলিলেন। কোন কোন গান দুইবারও গাহিতে হইল।
গান গাওয়া যখন শেষ হইলো তখন তিনি বলিলেন' দেশের রাজা যদি ভাষা জানিত ও সাহিত্যের আদর বুঝিত, তবে কবিকে তো তাহারা পুরস্কার দিত। রাজার দিক হইতে যখন তাহার কোন সম্ভাবনা নাই তখন আমাকেই সে-কাজ করিতে হইবে।' এই বলিয়া একখানি পাঁচশো টাকার চেক তিনি আমার হাতে দিলেন।'' ..........
.........তিনি আমার সঙ্গে অনেক কৌতুকের গল্প করিতেন। তাঁহার কাছ হইতে সেকালে বড়োমানুষির অনেক কথা শুনিতাম। ঢাকাই কাপড়ের পাড় তাহাদের গায়ে কর্কশ ঠেকিত দেখিয়া তখনকার দিনে সৌখিন লোকেরা পাড় ছিঁড়িয়া ফেলিয়া কাপড় পড়িত- এইসব গল্প তাঁহার কাছে শুনিয়াছি। গয়লা দুধ জল দিত বলিয়া দুধ পরিদর্শনের জন্য ভৃত্য নিযুক্ত হইল, পুনশ্চ তাহার কার্যপরিদর্শনের জন্য দ্বিতীয় পরিদর্শক নিযুক্ত হইল। এইরূপে পরিদর্শকের সংখ্যা যতই বাড়িয়া চলিল দুধের রঙ ক্রমশ ঘোলা এবং কাকচক্ষুর মতো সবচ্ছনীল হইয়া উঠিতে লাগিল-''
সেলিম আল দীনের বানভাসা আবেগ। মৃত বাবার জন্যে তার আর্তনাদ-'এখন মনে হচ্ছে- বাবার কবরের ওপর কদম গাছটার কথা। বহুদিন আর সেখানে যাওয়া হয় না। বাবার গভীর ঈশ্বর সাধনা আমার ভেতরে লেখার ধৈর্য্য হয়ে ধরা দিয়েছে- এই ভেবে কতইনা স্বস্তি পাই। আমার পিতৃপ্রেম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলো না। তার আগে মনে হতো- তিনি আমার মাসোহারা প্রেরণের একান্ত নির্ভরযোগ্য উৎস বিশেষ। কিন্তু যখন শ্রদ্ধা প্রণতিতে স্মরণ করি তাঁর মধ্যরাত্রিতে জেগে ওঠা তাহাজ্জুদের নামাজের সময়- জিকিরের মৃদু শব্দে বাল্যকালে ঘুম ভাঙার কথা। বড়লেখা অঞ্চলে- উলিপুরে ভাবতাম ঐ রকমই। ঈশ্বর সমর্পিতজন এভাবে একাগ্রচিত্তে জিকির করে।
কিন্তু এখন বুঝি-আমিও পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আমার জনকের শেষ রাত্রির ঐ জাগরণ কোন সৌরলোকের জন্য- কী ভাবে আরাধনার জন্য সময়টুকু বাঁচিয়ে রাখতেন। আর নয়টি পুত্র কন্যার জন্য কী অপরিসীম প্রেম। আম্মাকে অনুযোগের সুরেই একদিন বললেন তাঁর অকালমৃত দুই সন্তানের কথা- শাহীন আর কবিরকে ভুলে গেছ নাকি।'
মহা কবি গ্যেটের পিতৃপ্রেম ছিলো অসীম। একবার ছেলেবেলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে তার বন্ধুরা এই বলে তাকে জব্দ করল যে তার পিতা আসলে পিতামহের সন্তান নন, গ্যেটের পিতা হয়তো কোন ধনীর পুত্র। কিন্তু গ্যেটে তখন এক মহামানবিক উত্তর দেন- 'এই যদি সত্য হয় তাতেও ক্ষতির কিছু নেই; জীবন এমন এক মহাদান যে, কার কাছে এই জীবনের জন্য মানুষ ঋণী সে-কথা সে না-ভেবেও পারে, কেননা, অন্তত এটুক সত্য যে ঈশ্বরের কাছ থেকেই তা এসেছে আর তাঁর সামনে সবাই সমান।' গ্যেটের তার জীবনস্মৃতিতে পিতার অনেক অবদানের কথাই স্বীকার করে গেছেন।
বোর্হেসের বাবার ছিলো বিশাল গ্রন্থাগার, তাতে রাজ্যের বই। শেলী-কিটস, সমস্তই ইংরেজী সাহিত্যের বই। বাবা বোর্হেস কে নিজের পাঠাগারে প্রবেশের রাস্তা বাধাহীন করে দিয়েছেন। বোর্হেস সারাদিন ওইসব পড়ছেন-নিজের ভাষা স্প্যানিশে নয়, ইংরেজীতে। তাও তিনি মন্ত্রমুগ্ধ-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ। এক সাক্ষাৎকারে বলছেন-'আমি নিজেকে একজন লেখকের চাইতে একজন পাঠক হিসেবেই ভালো মনে করি। আমি বিভিন্ন ভাষার পাঠক। বিশেষত ইংরেজীতে। কারণ আমার বাবা- টেনিসন, শেলি, কিটস পড়তেন আর তার পাঠাগারে আবাধ যাতায়াতের সুযোগ তিনি আমায় করে দিয়েছেন।'
বোর্হেস নিউইয়র্কে লোরকা-কে দেখে খুব অবাক হয়েছিলেন নাকি। কারণ লোরকা যতদিন সেখানে ছিলেন একদন্ড ইংরেজীও শেখেননি। এ-কি লোরকার পিতৃপ্রেম, স্বভূমির লেখনিতেই-তো তিনি ছিলেন। কৃষক পরিবারের সন্তান, গর্সিয়া তাদের পারিবারিক উপাধি। বাবা ছিলেন খুব সরল আর আন্তরিক। বাড়ির পাশেই কোন এক দুস্থ পরিবারের দেখাশুনা করতেন তিনি। আর জন্ম থেকেই খোঁড়া লোরকাকে আমোদে ফুর্তিতে ভরিয়ে রাখতেন। যে বৃদ্ধাকে সাহায্য করতেন তার বাবা, সেই বৃদ্ধ মারা যাওয়ার পর লোরকা বলছেন- 'আমার গল্প বলা প্রতিবেশী বীর, আকাশ থেকে নেমে আসা দেবদূত, দয়ামায়ার মন ছিল তার, যেন কে সন্ত।' এ নিতান্তই তার বাবাকে কল্পনা। ছেলেবেলার কোন এক বৃদ্ধের চরিত্র খুঁটিয়ে দেখাটা-নিজের পারিপার্শ্বিকতাতেই প্রকাশিত হয়।
মার্কেসের নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্ণেল উপন্যাসের অনবদ্য চরিত্র কর্ণেল। তার বউ কে নিয়েই তার জীবনের শেষ মহূর্তগুলোর কাহিনী। পঁচাত্তর বছর বয়েসি কর্ণেল, যাকে দেখে মনে হয় রাসায়নিক পদার্থে ভিজিয়ে রাখা মৃত শরীর, কেবল চোখ দুটিতে বেঁচে থাকা জ্বলজ্বলে স্বপ্ন ছাড়া। আর আছে মোরগের লড়াই বিজয়ের ইচ্ছা এবং চিঠি। যে চিঠি আসলে তাঁর বেঁচে থাকার উপায়। না হলে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন উদ্দেশ্যই যে থাকে না। মমতায় আর স্নেহে, একাগ্রতায় এই বৃদ্ধ কর্ণেল ওই মোরগের আর না পাওয়া চিঠির পিতা হয়ে ওঠেন।
আফ্রিকান সাহিত্যিক সেমবেন ওসমানের গল্প উপজাতির ক্ষতচিহ্ন। মানুষ যখন পণ্য ছিলো, এক পিপে মদের বিনিময়ে কেনা যেত একটা তাগড়া শরীর। সেই সময়ে এই গল্পের আমু এক মহান পিতা হয়ে ওঠেন যিনি নিজের কন্যাকে বাঁচাতে সাদা চামড়ার লোকেদের কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে ছিলেন। কিন্তু আর কতো-পা ফুলে যে গোদ হয়ে গেছে, শেষে টিকতে না পেরে নিজের কন্যার গায়ে অসংখ্য ক্ষত সৃষ্টি করেন-যা দেখে ব্যবসায়িরা তাকে ফেলে চলে যায়। বেঁচে যায় মেয়েটি। তারপর থেকেই ক্ষতচিহ্ন তৈরি করা সেই জাতির ঐতিহ্য হয়ে পড়ে। একজন পিতা তবে কতো প্রচন্ড হতে পারেন।
ওরহাম পামুক তুরস্কের নোবেল বিজয়ী লেখক। নোবেল বক্তৃতার পুরোটাই তিনি দিয়েছেন তারা বাবাকে নিয়ে। সেখানে পামুকের বাবা সংস্কৃতি আর মানবিকতার আহ্বান হয়ে উপস্থাপিত হন। 'লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর কখনোই আমি ভুলিনি যে, এ ব্যাপারে বাবার কিছু প্রাপ্য রয়েছে। আমার বাবা ছিলেন এমন এক বাবা যিনি তুরস্কের কামাল পাশা বা মহান ধর্মীয় নেতাদের সম্পর্কে যতোটা বলেছেন তার চাইতে বহুগুণ আবেগ নিয়ে বলেছেন বিশ্ব সাহিত্যের অন্যান্য মহারথিদের কথা।'
পাবলো নেরুদা'র বাবার সাথে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। ফ্রয়েডের মতো। কিন্তু তাও নেরুদা তার বাবার হাত ধরেই পৃথিবীর যাপিত জীবনের আস্বাদ পান - 'আমার বাবা হোসে ডেল্ কারমেন্ আমার ঠাকুরদার জমি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন ভাগ্যান্বেষণে, তারপর ডকের চাকরি ইত্যাদি করতে করতে শেষে টেমুকো শহরে এসে রেলের কাজ নেন। পাথরবাহী ট্রেনে বাবার হাত ধরেই আমার প্রথম শ্রমিক দেখা।' এবং বাবাই প্রথম সমুদ্রস্নানের আনন্দ দিয়েছিলেন নেরুদা-কে। অনুস্মৃতিতে তার উচ্ছ্ল বর্ণনাও আছে।
ফরাসি দার্শনিক আলব্যের ক্যামু তার পিতাকে দেখেন নি কখনোই। ক্যামুকে গর্ভের অন্ধকারে রেখে প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই মারা যান তিনি। মায়ের সংগ্রহে থাকা যে বোমার টুকরাটি বাবাকে আঘাত করেছিলো, তাই বাবার ছবির পাশে দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছেন ক্যামু। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত ক্যামুর ভেতরটায় একটা হাহাকার ছিল। রুদ্ধবাক থেকেই সেই অভাব তিনি পাশ কাটিয়েছেন। তার অসমাপ্ত রচনা 'প্রথম পুরুষ' সেই না দেখা বাবাকে নিয়েই লিখা।
হোমারের ওডিসি-তেও পাই এক পিতাকে। টেলিমেকাস এর পিতা ওডিসাস। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত পুত্রের ক্রুদ্ধ ক্রন্দন-ছড়িয়ে পড়ে সমুদ্রের বাতাসে। পিতা আছেন রামায়নে-ও। রামের পিতা দশরথ, ধর্ম আর পিতৃস্নেহের দ্বন্দ তার মৃত্যুকে সুখকর করতে পারেনি। মধুসুদনও শেষ পর্যন্ত পিতার ভূমিতেই ফিরে আসেন। মেঘনাধবধে এসে আবার পিতা হয়ে উঠছেন রাক্ষস রাজ রাবণ ।
আমাদের ইতিহাসের একজন পিতা, মোজাম্মেল হক। রাষ্ট্রের চতুর হাসি যাকে বঞ্চিত করেছিলো কর্মজীবন থেকে, তবুও তিনি সমাজের হয়েই থেকেছেন। মুক্তির আকাংক্ষা থেকে নিজেদের দিনপঞ্জিকে আলাদা করতে পারেন নি। একা একাই নিজের সুঁই সুতোয় ইতিহাসের নকশি বুনে যান।
আর একজন আছেন, তমিজের বাপ। জাতির শেকড়বাকড় ইতিহাসে যার বাস। দুই পায়ের আঙ্গুলে দাঁড়িয়ে যে ছুঁতে চায় স্বপ্নকে-আকাশকে-পুরাণকে। ঘুম ঘুম চোখে, বুকের হাড়জীর্ণ পাজরে, কতো স্বপ্ন- কতো বেদনা লুকিয়ে রাখে সেই বাপ। লুকিয়ে রাখে এক জাতির খোয়াবনামা।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০০৯ বিকাল ৪:৫৭