ঘটনাটা বরিশালের বাউফল থানার মুলাদি গ্রামের। ঘটনাটা ৪০ বছর আগের। আমার এক নিকট আত্বীয়ের ঘটনা ও
তার কাছ থেকে শোনা। তার ভাষায় বলছি। আমার বয়স তখন ২২ বছর। আমার বাবার খুবই ডায়রিয়া হয়েছিল। গ্রামের এক কবিরাজকে দেখিয়েছি এবং সে বলে যত তারাতারি সম্ভব শহরে নিয়ে ভাল ডাক্তার দেখাতে। কারন তখনকার দিনে গ্রামের দিকে কোন ডাক্তার ছিল না। আর শহর ছিল ২৫কিঃ মিঃ দূরে। ভাল রাস্তা তখন ছিল না। যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল নদীপথ। শহরে যেতে হবে নৌকায় করে। বাবাকে নিয়ে যখন রওয়ানা করি তখন বেলা ১২ বাজে। প্রথমে আঁকাবাঁকা ছোট খাল পেরিয়ে বড় নদী ও তার ঐ পাড়ে শহর। শহর পৌঁছাইতে আরো ঘন্টা আড়াই লেগেছে। বিকাল ৫টার দিকে বাবা মারা যায়। বাবার লাশটা নিয়ে আমি আবার বাড়ির
দিকে রওয়ানা দেই। বড় নদীটা যখন পার করে খালের দিকে নৌকা ঢুকাই তখন দেখতে পাই নৌকা আর চলছে না, কাঁদায় আটকে গিয়েছে। তখন ভাটা চলছে। জোয়ার আসবে রাত ১২টার দিকে। তখন সময়টা আনুমানিক সন্ধ্যা সাডে ৬ টা হবে। শীতের কাল থাকায় ঐ সময়ে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল চারপাশ। আকাশের জোছনার আলো ছিল খুব। জনমানব শূন্য একটি স্থানে এসে নৌকাটা আর চলছে না। খালটার বাম পাশে একটু দূরে একটি পরিত্যক্ত শ্বশান আর ডান পাশে গভীর জঙ্গল। জঙ্গলের বটগাছগুলো দানবের মত দাঁড়িয়ে আছে, বটগাছের ডালে কিছু বাদুর ঝুলে আছে। এতটাই নির্জন জায়গায় যে কোন শব্দ হলেই বুকের ভিতরে কেমন যেন করে ওঠে। ভয়ে
বাবার লাশটা স্পর্শ করে বাবার পাশে বসে থাকি। শুধু অপেহ্মা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। একটা চাদর দিয়ে বাবার লাশটা ঢেকে দিয়েছি। রাত যত বাডতে থাকে ভয় ততটাই তীব্র হতে থাকে। মনে হয় জঙ্গল থেকে কিছু একটা বেড়িয়ে এসে আমাকে ধরবে। হঠাত
নৌকাটা কেমন যেন একটু দুলে উঠলে মনে হল আমার মৃত বাবা নডে উঠছে। বাবার ঠান্ডা শরীর থেকে হাতটা সরিয়ে নেই। দোয়া যতটুকু পাড়ি সবই পড়তে চেষ্টা করছি কিন্তু ভয়ে কিছুই মনে আসছিল না। ইচ্ছা করছিল চিত্কার করে বাচাঁও বাচাঁও বলি। কিন্তু আমি জানি আমার এই চিত্কার কারো কানে পৌছাবেনা। না পারছি এখান থেকে যেতে, না পারছি থাকতে। নিজের মৃত বাবাকেও ভয় করছে।
আনুমানিক রাত ১১টার দিকে একটা ছায়া দেখতে পেলাম বট গাছের অড়াল থেকে বেডিয়ে আমাদের নৌকার কাছে আসলো ও আমাকে জিজ্ঞাসা করলো "তুমি কি ঐদিকে যাবা?" লোকটি একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে আছে ও তার মুখটা চাদরে ডাকা ছিল। লোকটি ইশারায়
যে দিকে দেখালো ঐ দিকেই আমরা যাচ্ছি। লোকটিকে বললাম জোয়ার আসলে যাব। লোকটি নৌকায় উঠলো ও বাবার কাছে বসলো কিন্তু বাবার সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞাসা করলো না। একদৃষ্টিতে বাবার লাশটার দিকে চেয়ে ছিল। লোকটার মুখটা আমি তখনো দেখতে পাই নি। এই গহীন জঙ্গলে এতরাতে তার আগমনের কারনটা পর্যন্ত জানতে ইচ্ছা করছে না বরং তার আগমনে একটু সস্তি পেলাম। রাত ১২টার দিকে জোয়ার আসলে আমি নৌকাটা চালাতে শুরু করি। নৌকা যত সামনের দিকে যাচ্ছে ততই একটা গন্ধ নাকে লাগছে। ধীরে ধীরে গন্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। কিছু কচুরিপনা, কলাগাছ ও মরা একটা গরুর ফুলে থাকা দেহ একসাথে জটলা করে এমনভাবে নৌকার সাথে আটকে আছে যে আমি অনেক চেষ্টা করে ও নৌকাটাকে কিছুতেই সামনের দিকে নিতে পারছিনা। বাধ্য হয়ে আমি নৌকা থেকে পানিতে নেমে নৌকা রশি ধরে টানতে থাকলাম। প্রায় ৫ মিনিট টানার পর আমি নৌকার কাছে আসি। তখন যা দেখলাম বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠলো। দেখি লোকটা বাবার বুকের কাছে বসে বারার বুকের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কলজেটা বের করে নিয়ে এসেছে। তখন আমি কোন উপায় না দেখে বৈঠাটা হাতে নিয়ে লোকটার মাথায় আঘাত করি একাধিক বার। লোকটা আমার দিকে যখন ঘুরে তখন ঠিক গলার মাঝখানে বৈঠাটা ঢুকিয়ে দেই। এতে লোকটা পানিতে পড়ে যায়। আমি পানিতে খুব জোরে জোরে বৈঠা দিয়ে আঘাত করি ও চিত্কার করি সাহস থাকলে সামনে আয়। চাঁদের আলোতে লোকটার রক্তমাখা লোমশ হাতটা দেখেছিলাম। বড়বড় নখ ও
কোঠরে ঢোকানো চোখের নীল আভা মনে পড়লে বুকটা শুকিয়ে যায়। দাঁতগুলো লালত, খুব ছোট ছোট, তীক্ষ্ণ আর ধারালো। আমার চিত্কার শুনে টর্চলাইট নিয়ে কয়েকজন লোক ছুটে আসে তাদের সব কিছু খুলে বলি। সব কিছু শুনে তারা বাবার লাশটা দেখে। তখনও বাবার বুকের ছোপ ছোপ রক্তগুলো শুকায়নি। ঐ রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর রাত। যে রাতের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। ঐটা ছিল একটা পিশাচ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৩