বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) এম এ তাহেরসহ (বীর উত্তম) অন্যদের গোপন বিচার, সাজা কার্যকর এবং বিচারের জন্য ১৯৭৬ সালের ১৬ নম্বর সামরিক আইন আদেশের মাধ্যমে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠনকে অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।
সোমবার বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মোঃ জাকির হোসেন এ রায়ে সাক্ষর করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে কি আছে এ বিষয়ে দুপুরের পরে প্রেস বিফ্রিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) এম এ তাহেরসহ (বীর উত্তম) অন্যদের গোপন বিচার, সাজা কার্যকর এবং বিচারের জন্য ১৯৭৬ সালের ১৬ নম্বর সামরিক আইন আদেশের মাধ্যমে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠনকে অবৈধ ঘোষণা করে ২০১১ সালের ২২ মে রায় দেন হাইকোর্ট।
ওই রায়ে তাহের হত্যাকাণ্ডে একমাত্র পরিকল্পনাকারী হিসেবে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উল্লেখ করেছেন আদালত। ওই বিচারে দণ্ডিতদের ক্ষতিপূরণ এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা তদন্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে।
১৯৭৬ সালের ১৬ নম্বর সামরিক আইন আদেশ এবং এই আদেশের আওতায় গঠিত ট্রাইব্যুনালে কর্নেল তাহেরসহ অন্যদের গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা পৃথক চারটি রিট আবেদনের রায়ে এসব কথা বলা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান চলে। এরই এক পর্যায়ে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক ট্রাইব্যুনালে গোপন বিচারের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়। এর চার দিন পর ২১ জুলাই ভোররাতে তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
২০১০ সালের ২৩ আগস্ট কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের (বীর বিক্রম) স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ও অপর ভাই ড. আনোয়ার হোসেন ওই বিচার চ্যালেঞ্জ করে প্রথম রিটটি করেন।
রায়ে আদালত বলেন, “এটা ছিলো একটি ঠাণ্ডা মাথায় খুন। নিষ্ঠুর পরিহাস, একটি ভূয়া ট্রাইব্যুনাল গঠন করে প্রতারণামূলকভাবে তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং তা কার্যকর করা হয়। এ খুনের একমাত্র পরিকল্পনাকারী জিয়াউর রহমান। দূর্ভাগ্যক্রমে খুনের অপরাধে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য তিনি এখন আর বেঁচে নেই। তবে তার সহযোগী (গোপন ট্রাইব্যুনালের বিচারক) আবদুল আলী এখনো বেঁচে আছেন।”
তাই তাহেরকে হত্যার অভিযোগে আবদুল আলীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায়ে বলা হয়, “সকলকে এটা মনে রাখতে হবে, ওপরের নির্দেশ বা প্রয়োজনের তাগিদে করা হয়েছে বলে কোনো যুক্তি ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের যুক্তি সাজার মাত্রা কমাতে পারে, কিন্তু তা কখনোই বিচারের হাত থেকে রেহাই দিতে পারে না।”
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালদত বলেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান সরাসরি ভূমিকা রেখেছিলেন বলে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ ও জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু আদালতে বক্তব্য দেন। ওই সময় জিয়া হাজার হাজার সেনা সদস্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন বলেও তারা উল্লেখ করেন। ইতিহাস ও সত্যের খাতিরে সেই সব হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত করতে হবে। এ জন্য সুপ্রিমকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।”
সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, আইনবিদসহ পেশাজীবীদের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন আদালত। আদালত বলেন, “এ কমিটি ওই সময়ে কথিত অভিযুক্ত ও ক্ষতির শিকারদের আর্থিক সহযোগিতা, অবসর ভাতা, চাকরি ফেরৎ (যদি প্রযোজ্য হয়), পদোন্নতিসহ ক্ষতিপূরণের জন্য কি কি করা যেতে পারে, সে বিষয়ে মতামত দেবেন।”
ওই বিচারকে কল্পকাহিনী ভিত্তিক সাজানো নাটক হিসেবে উল্লেখ করে কর্ণেল তাহেরসহ তার সহঅভিযুক্তদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে বলেন আদালত। রায়ে এ বিষয়ে বলা হয়, “দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে নথি-পত্র বা ইতিহাসে তাদের বিষয়ে বলা তথ্য ও অপমানজনক কথা সংশোধন করতে হবে। তাহেরকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখিয়ে শহীদের মর্যদা দিতে হবে। সহঅভিযুক্তদের দেশপ্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। কারণ, প্রকৃত পক্ষে তারা কোনো অপরাধ করেননি। তারা জিয়ার ক্ষোভের শিকার হয়ে কারাবরণ থেকে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করেছেন।”
আদালত বলেন, “ওই বিচার সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যে থেকে প্রতীয়মাণ হয়, জিয়ার স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার পথে তারা সহযোগিতা না করে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখতেই তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিলো।”
“অন্তত ৭৫ পরবর্তী সময়ে জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছিলেন উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, “জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানে শিশু পার্ক স্থাপন, বঙ্গবন্ধুর খুনি ও স্বাধীনতাবিরোধীদের পূনর্বাসনসহ বিভিন্ন কাজ করেছিলেন জিয়া। ওই সব অপরাধীদের শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি কাজ করেন। তিনি সংবিধানে সা¤প্রদায়িকতা ঢুকিয়েছেন। দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ খুলে দিয়েছেন।”
সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর রায়ে সামরিক সরকারের কিছু কিছু কাজকে মার্জনা করা হলেও ওই গোপন বিচারের অপরাধ মার্জনা করার কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে আদালত বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জনকল্যাণে নেওয়া সামরিক সরকারের কিছু কাজকে মার্জনা করা হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো কাজকে কখনোই মার্জনা করা যায় না। ফলে জিয়ার ওই কাজকে মার্জনা করার কোনো সুযোগ নেই।”
কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার অভিযোগে ওই রায়ে জিয়াউর রহমানকে স্বৈরশাসক স্ট্যালিন ও ফ্রাংকোর সঙ্গে তুলনা করা হয়।
লিফসুজকে ভাড়া করা সাংবাদিক উল্লেখ করে বিএনপি নেতাদের আনা অভিযোগের বিষয়ে রায়ে বলা হয়, “তিনি ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ন্যায়বিচার দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। নিজের বিবেকের তাড়নায় এবং সুপ্রিম কোর্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন। কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ডের মামলা বিচারাধীন থাকাকালীন সময়ে বিএনপি নেতাদের দেওয়া বক্তব্য বিচার প্রভাবিত করার শামিল। এটা চরমভাবে আদালতের অবমাননা করা।”
সার্বিক বিবেচনায় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা না হলেও ভবিষ্যতে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়ার বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলেন আদালত।
রিটের পক্ষে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ড. শাহদীন মালিক প্রমূখ, রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান এবং অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ড. কামাল হোসেন, ড. এম জহির, ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, অ্যাডভোকেট এ এফ এম মেজবাউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট আকতার ইমাম, অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না, অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী ও অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু শুনানি পরিচালনা করেন।
২০১০ সালের ২৩ আগস্ট কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের (বীর বিক্রম) স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ও অপর ভাই ড. আনোয়ার হোসেন গোপন বিচার চ্যালেঞ্জ করে প্রথম রিটটি করেন। ‘এই আইন এবং আইনের অধীনে গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল ও প্রথম মামলার রায়কে কেন বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না’ তার কারণ জানতে চেয়ে ওই দিন রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
পরে ২০১১ সালের ২৪ জানুয়ারি কর্নেল তাহেরের সঙ্গে দণ্ডিত জাসদ সভাপতি বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা রবিউল আলম আরো একটি রিট করেন। এছাড়া একই বছরের ৩১ জানুয়ারি ওই গোপন আদালতে দণ্ডিত মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন, কর্পোরাল শামসুল হক ও আবদুল হাই মজুমদার বাদী হয়ে একটি এবং এরপর দিন আবদুল মজিদ বাদী হয়ে আরও একটি রিট হাই কোর্টে দাখিল করেন।
চারটি রিটের শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২২ মে এক সঙ্গে এ রায় দেওয়া হয়।
কর্নেল তাহের হত্যা: রিটের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !
"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমিত্ব বিসর্জন
আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।
"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?
স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন