আম্মা ছিলো প্রচণ্ড রাগী আর সাংঘাতিক মেজাজী - সাক্ষাৎ জল্লাদ । মাঝে মাঝে মনে হতো আমরা মনে হয় আম্মার সৎ ছেলেমেয়ে । সবকিছু তার কথামতো হওয়া চায়, কোনও কিছুতেই একটুও ছাড় দিতোনা । প্রচন্ত ডিসিপ্লিন্ড লাইফ ছিলো আমাদের । মাঝে মধ্যে আমরা খুব অবাক হতাম -একটা মানুষ কিভাবে ঘড়ি না দেখেই ঠিক টাইমটা বলে দিতে পারে - এই হচ্ছে আমার আম্মা ।
আর আব্বা ছিলও ঠিক তার উল্টো । অমায়িক ব্যবহার, সহজ সরল আর প্রচণ্ড আত্মভোলা একজন নিখাদ ভদ্রলোক যাকে বলে । মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করতো । কোনোদিন দেখতোনা দোকানী ব্যাগের মধ্যে কি দিলো । যে কারনে আব্বা - বাজার থেকে আসার পর ব্যাগ থেকে প্রায়ই পচা মাছ, পচা সব্জি, হাড়ভর্তি মাংস বের হতো - ফলস্বরূপ আম্মার একক কনসার্ট শুরু, তৎক্ষণাৎ আব্বা খবরের কাগজ নিয়ে বারান্দায় - এবং যথারীতি আমরা দুইবোন আব্বার দুইপাশে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আব্বাকে সান্ত্বনা দিতাম ।
আম্মার অনেকগুলো নেশার মধ্যে একটা নেশা ছিলো - আচার বানানো । আম, জলপাই, তেঁতুল, চালতা, শুকনা কুল বরই , রসুন, করমচা, লেবু - আরও অনেক রকমের আচার - আমি এতো নামও জানিনা । আর একটা আইটেম দিয়েই আম্মা কয়েক পদের আচার বানাতো । যেমন শুধু আম দিয়েই আমরা ৭/৮ রকমের আচার খেয়েছি । এবং এই আচার বানানোর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই আম্মা নিজে একা করতো । কাটাকুটি, রোদে দেয়া, বারান্দায় বা ছাদে দেয়া - আবার ছাদ থেকে তুলে আনা - সব নিজ হাতে করতো । আমাদের দু'বোনকে আচারের বৈয়ামের ধারে কাছে ঘেঁসতে দেয়াতো দুরের কথা - তাকালেই পারলে চোখ তুলে নিতো এমন অবস্থা ছিলো । তবে আমরা খেতে চাইলে - আম্মা নিজ হাতে বৈয়াম খুলে আমাদের দিতো ।
একদিন দুপুরে আম্মা তার রুমে ঘুমাচ্ছে । আমরা দুইবোন আর আব্বা লিভিংরুমে টিভি দেখছি । হঠাৎ আমি বললাম - "খুব আচার খেতে ইচ্ছা করছে"। আপা বললো - " কিন্তু আম্মা তো ঘুমাচ্ছে । না ওঠা পর্যন্ত খাওয়া যাবেনা "। আব্বা আমাদের দুইবোনের চেহারা দেখে কি মনে করে
বললো - "তোরা যে আচারটা খেতে চাস - বৈয়াম নিয়ে আয় " । আপা হায় হায় করে উঠে বললো - " আম্মা কিন্তু মেরে ফেলবে " । আব্বা বলল -" আমি ম্যানেজ করবো - তোরা নিয়ে আয় "। আপা ভয়ে সোফা থেকে এক চুলও নড়লোনা । আমি সাহস করে কাশ্মীরি আচারের বৈয়াম , চামচ পিরিচ আনলাম । আব্বা অল্প একটু খেলো - আর আমরা দুই বোন মনের সাধ মিটায়ে খেলাম । খাওয়া শেষে পিরিচ চামচ ধুয়ে সব জায়গা মতো রেখে দিলাম - যাতে আচার খাওয়ার কোনও প্রমান না থাকে ।
কিছুক্ষণ পর আম্মা ঘুম থেকে উঠে আমাদের লিভিংরুমের দিকে হেঁটে আসলো । আমরা দুই বোন আম্মার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে একটা হাসি দিলাম । আব্বাও কেমন বিগলিত হয়ে আম্মার দিকে তাকালো । আম্মা হঠাৎ বিড়ালের মতো নাক দিয়ে কি যেন শুঁকে - আমার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে বলল "তুই আচার খেয়েছিস ?" ( আম্মার ধারনা তার বড়মেয়ের কোনোদিন সাহস হবেনা আচারের বৈয়ামে হাত দেয়া । করলে এটা আমাকে দিয়েই সম্ভব ) আব্বা বললো - "আরে না না আমার আচার খেতে ইচ্ছা করছিলো - তাই আমি নিজেই এনে খেয়েছি "। আম্মা এবার অগ্নিমূর্তি ধারণ করে আব্বার দিকে তাকিয়ে বললো - "তুমি কি বলতে
চাচ্ছো - ওরা দুইজন খায়নি ? আব্বা বলল - " না না - আমি ওদেরকে নিজ হাতে দিয়েছি " । আমরা দুইবোন তখন দোয়া পড়া শুরু করে দিয়েছি । আমাদের দিকে তাকিয়ে আম্মার হঠাৎ কি মনে হলো - কিছু না বলে সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো । ঘটনা তেমন সুবিধার মনে হলনা - বজ্রপাত হওয়ার কথা - কিন্তু হচ্ছে না কেন ?
পুরো বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিভাবে যে কাটলো - শুধু আমরাই জানি । রাতে খাওয়ার টেবিলে - আম্মাকে চুপ থাকতে দেখে আব্বা বললো " আচ্ছা তুমি কিভাবে বুঝলা যে - আমরা আচার খেয়েছি"। আম্মা খুব ঠাণ্ডা ভাবে বললো " তোমার মেয়েদের জিজ্ঞেস করো - শোনো - ওরা জানে কিনা ।" আপা সাথে সাথে মিউ মিউ করে বললো - " আম্মু আমি সত্যিই জানিনা " । আব্বা আম্মা দুজনেই আমার দিকে তাকালো । আমি ভয়ে ভয়ে বলল্লাম " আম্মা ছোটবেলায় বলতো - আম্মার নাকি ৪টা চোখ । ২টা আম্মার সাথে থাকে আর ২টা আমাদের পেছনে পেছনে ঘুরে । কিন্তু ২টা নাকের কথাতো কোনোদিন বলেনি " ।
(আমার এই দুঃসাহস আর বদ স্বভাবের জন্যই আম্মা আচার খাওয়ার অপরাধে প্রথমেই আমাকে টার্গেট করেছিলো )
পরে জেনেছিলাম - লিভিংরুমে ঢুকেই আম্মা কাশ্মীরি আচারের সুঘ্রানটা পেয়েছিলো ।
[ গত একটা সপ্তাহ জ্বরে কাহিল হয়ে পড়ে আছি । কিছুই খেতে পারছিনা । আম্মার কথা মনে পড়ছে - কতদিন দেখিনা । আম্মা থাকলে আচার এনে বলতো - "একটু আচার খা - দেখবি খাওয়ার রুচী আসবে "]