বাংলা ভাষায় আমার ভালোবাসা আছে, তবে আশা নাই। মাত্র হাজার বছর আগেই এই বাংলা ছিলো আজের এই বাংলা থেকে হাজারগুন দূরের অপরিচিত সব শব্দ। তাও তা লেখা হতো নাগরি হরফে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর উদ্ধার করা নেপালের তালপাতায় লেখা চর্যাপদতো তাই বলে!
চর্যাপদের সবচেয়ে বেশী পদ লেখা কবি কাহ্নু পা'কে কজন মনে রেখেছে? এখন যদি বলি একটা সময় বাংলা ভাষা ছিলো এমন-
কাআ তরুবর পাঞ্চ বি ডাল/ চঞ্চল চীএ পৈঠা কাল (চর্যাপদের প্রথম পদ), কে বিশ্বাস করবে!
এখন যেমন এই দেশে ৯০% অহংকারী একটা গোষ্ঠি আছে। একটা সময় এমন অহংকারী গোষ্ঠি ছিলো হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ্যরা। তাদের অত্যাচারে নিরীহ বৌদ্ধরা নেপাল, ভূটান, তিব্বতের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলো। এই বৌদ্ধের ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়া বুদ্ধিরই ফল হলো লিখিত এই চর্যাপদ।
ভাষা হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করার কতগুলা আওয়াজ। এই আওয়াজগুলাকে লেখে রাখার জন্যই বর্ণের আবিষ্কার। কোথায় যেন পড়েছিলাম বাংলা বর্ণগুলাও বৃটিশ কোন ইংরেজের তৈরী করে দেওয়া। ডিটেইল কেউ জানলে আমাকে শুধরে দিবেন প্লিজ।
ভাষা বাস্তবতায় খুব ধীরে ধীরে বদলে যায়। ফ্যান, চেয়ার, মোবাইল, কম্পিউটার, পানি, রোযা, খোদা এইসব যে অন্য ভাষা, তা আমাদের মনেই হয় না! তাই ভাষা নিয়ে ব্যাক্তিগতভাবে আমি কখনোই খুব কঠিন অবস্থানে থাকি না। টুকটাক হিন্দি পারলে ভারতীয়দের সাথে হিন্দিতে বলি। চায়নিজ বন্ধুদের সাথে দেখা হলে "নি হাউ মা?" বলি। নিজের ভাষা শুনতে কার না ভালো লাগে? আর নিজের ভাষাই আস্তে আসতে অন্য ভাষায় সমৃদ্ধ হয়। আবার হারিয়ে যায় কিছু শব্দ খুব ধীরে।
একসময় আমাদের বাংলাভাষার আকাশ খোদ রবীন্দ্রনাথও হয়ত হারিয়ে যাবেন, সবচেয়ে বেশী পদ লেখা বৌদ্ধ কবি কাহ্নু পা'র মত। কবিগুরু নিজেই লেখে গেছেন-
আমার কীর্তিরে আমি করি না বিশ্বাস।
জানি, কালসিন্ধু তারে
নিয়ত তরঙ্গঘাতে
দিনে দিনে দিবে লুপ্ত করি।
অবশ্য শেষে বলেছিলেন -
এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি।
এ ভালোবাসাই সত্য, এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।
অতএব ভালোবাসাটাই থাকবে, যার শক্তিতে মৃত্যুকেও অস্বীকার করা যায়। খটমট লেখা আর বড় না করি, এই লেখার পাঠক থাকার কথা না। শেষ করি চর্যাপদের একটা কবিতা দিয়ে। প্রমের রসালো কবিতা। সেই আমলেও ছিলো

উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরনি ণামে সহজ সুন্দারী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী।।
(পদ ২৮, অর্থাৎ – উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো।)