- স্যার পিছনে তাকায়া দেখি লাশ বইসা আছে। বিশ বাইশ বছরের এক মাইয়া, স্বাস্থ্য ভালো, বিষ খাইয়া মরছিলো।
ভদ্রলোক নির্বিকারভাবে গল্প বলে যাচ্ছেন। আমি মনযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছি। মনেমনে ভাবতেছি, প্রত্যেকটা মানুষই এক একটা অসাধারণ উপন্যাস। শুধু পাশে বসে গল্পগুলা শুনে যদি কেউ লেখেন। আমি কোনদিন স্বপ্নেও ভাবি নাই এত বছর ধরে যে ছেলেটারে চিনি, তার জীবন যে এত অভিজ্ঞতাময়। জীবনে কী সে করে নাই! মাঝে কয়েক বছর এম্বুলেন্স চালাইছে। কথায় কথায় এই গল্পই শুনতেছি।
- বুচ্ছেন স্যার, মরছে বেশীক্ষণ হয় নাই তখনো। শইল লতলতা। আমার চিন্তা হইলো কখন লাশ পৌছাইয়া দিয়া টাকা নিয়া আরেক ট্রিপ ধরমু। দ্রুত গাড়ি চালাইতেছি, সামনে গর্ত দেইখ্যা হঠাৎ বেরেক করলাম। অমনি লাশ উইঠা আইসা বইসা গেলো।
মুখে হাত চেপে কিছুক্ষণ ভদ্রলোক হাসলেন। এমন গা ছমছম করা অবস্থায় হাসি কিভাবে আসে! আমি আগ্রহ নিয়া জিজ্ঞাসা করলাম
- এরপর?
- এরপর আর কী! হাত দিয়া ধাক্কা দিয়া আবার বেডে শোয়ায়ে দিলাম। তো ভয় স্যার পাইছিলাম আরো পরে।
আমি ভাবলাম লাশ হয়ত আবার উঠে বসছিলো। কিন্তু না। বললেন
- শ্রীপুরের পরের রাস্তায় তখন রাত বারোটার পর আর কোন গাড়ীঘোড়া দেখা যাইতো না। রাইত তখন আন্দাজ দুইটা। দেখলাম খালি গায়ে লুঙ্গি পড়া এক লোক আমার গাড়ীর সামে দিয়া রাস্তা ক্রস করলো।
মরা লাশ নিয়া রাত দুইটায় একটা মানুষ জঙ্গলময় রাস্তা দিয়া যাচ্ছে, এইটা ভয়ের না। ভয়ের হইলো একটা লুঙ্গি পড়া লোক! একটু বিরক্ত হয়েই বললাম
- লুঙ্গিপড়া লোক দেখে ভয়ের কী আছে?
- আছে স্যার আছে। ঘন্টাখানেক আরো গাড়ী চালানোর পর দেখলাম সেই লোক আবার আমার সামনে দিয়া রাস্তা পার হইতেছে। আগেরবারের মত এইবারও শেষ মুহূর্তে ঘাড়টা কাঁত করে আমারে একটু দেখলো। চেহারা স্যার আমার স্পষ্ট মনে আছে। হুবহু এক লোক। মুখে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
জিজ্ঞাসা করলাম, লাশের সাথে এত বছর আপনার বসবাস, ভয় পান নাই কোন দিন? ঠোঁট বাঁকায়ে বললো
- মরারে স্যার ভয় পাওয়ারতো কিছু নাই। তয় মজা পাইছিলাম স্যার একটা ঘটনায়।
একটু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন
- যমুনা বিরিজ এর উপরের ঘটনা। ষাইট সত্তুর বছরের এক বুড়ার লাশ নিয়া যাইতেছি। সাথে তার ছেলে, মেয়ে আরেকজন আত্মীয়ও আছে। গাড়ীর বেকডালা স্যার করা হয় নাই ঠিকমত বন্ধ। বিরিজের উপরে উইঠাই গেলো বেকডালা খুইলা। উপরের দিকে উঠতেছি, খাড়া রাস্তা। লাশ টুপ কইরা বেক ডালা দিয়া পইড়া গিয়া খাড়াইয়া রইলো। গাড়ী দ্রুত বেরেক কইরা দেখি গাড়ীর ভিতর কেউ নাই!
আমি ভাবতেছি, গাড়ীর ভিতরের মানুষ এত দ্রুত হাওয়াতো হওয়ার কথা না!
- স্যার লাশ পিছন দিক থেকে পইড়া গিয়া খাড়াইয়া গেছে দেইখা চলতি গাড়ির দজড়া খুইলা তার আত্মীয়স্বজন দিছে দৌড়। অবস্তা বেগতিক দেইখা, আমি নিজে কোলে কইরা লাস আবার উঠাইছি গাড়ীতে।
গল্পের মুল পার্টটা শেষ করে এইবারও মুখটিপে ভদ্রলোক হাসতেছেন। বুঝলাম, গল্পের আরো একটা অংশ বাকী। আমি অপেক্ষা করে আছি শোনার জন্য। বললেন
- লাশ নিয়া যখন গ্রামের বাড়ী গেছি, গিয়া দেখি হাজারে হাজারে মানুষ! এরই মধ্যে এম্বুলেন্সেরই কোন যাত্রী গ্রামে ফোন কইরা বলছে যে লাশ গাড়ী থাইকা নাইমা দৌড় দিছে, ডেরাইভার পরে অনেক কষ্ট কইরা ধইরা গাড়ীতে উঠাইছে। লাশতো গাড়ীতে উঠতেই চায় না!
দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন আসা শুরু করলো হাটা লাশ দেখার জন্য। কেউ কেউ আবার বলে, লাশ নাকি উঠবো না, উঠবো না, বলে বলে ড্রাইভারের সাথে দস্তাদস্তিও করছে! এই কাহিনী বিশাল থেকে বিশালতম'র দিকে রুপ নেওয়া শুরু করলো।
(নাহ ষ্ট্যাটাস বড় হয়ে যাচ্ছে, নিয়মিত পাঠক বলতে যে দুই তিনজন আছেন, তারা প্রায়ই কম্প্লেইন দেন যে লেখা নাকি বড় হচ্ছে। তাই থামলাম। বাকীটা আরেক দিন)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০১৬ রাত ১২:২৪