somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষ মানুষের জন্য

২৮ শে মে, ২০০৮ রাত ১১:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি প্রাইমারীর গন্ডি পেরুনো কিশোর তাঁর অসুস্থ মাকে টেনে তুলে বসাতে চাইছে, কিন্তু পারছেনা। মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতে হবে, খাওয়াতে হবে ঔষধ। সাহায্যের জন্য আশে-পাশে কেউ নেই, অপারগ হয়ে মায়ের চুলধরে টেনে বসায় কিশোরটি। মাকে খাইয়ে তাকে আবার যেতে হবে ৫মাইল দুরের হাইস্কুলে। হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে বেশি দিন হয়নি। নতুন ক্লাস, নতুন বইয়ের জন্য মনটা আকু-পাকু করে। কিন্তু তার এখন নতুন বইয়ের বিলাসিতা করার সময় নয়। তাই গ্রামের অগ্রজ’দের থেকে চেয়ে নেয় পুরোনো বই। সংসারে এখন মাকে দেখার মতো কেউ নেই, বাবা মারা গেছেন তার বয়স যখন দুই। সে তার বাবার দ্বিতীয় ঘরের কনিষ্ঠ সন্তান। দুভাই-দুবোনের পরিবারে সে সবার ছো্ট। ভাই বিয়ে করে সংসারী, চাকরির কারনে প্রবাসী। দু’বোন শ্বশুর বাড়ী। তাই মাকে দেখার মতো কেউ তার পাশে নেই। ঘরে অর্থ কড়িও তেমন নেই। বড়ঘরের ছোট ছেলে, তা কিছু জায়গা-জমি আছে, আর আছে ভিটে-বাড়ীর আশে পাশে ফলমূলসহ নানান ধরনের গাছগাছালী। অবশ্য বাড়ীর পাশে দু’টি পুকুরেও আছে অংশীদারী। তাই জীবনধারণের জন্য অনটন না থাকলেও প্রাচুর্যও নেই। একদিন তাঁর মা’ও তাকে রেখে পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। কিশোরটি অসহায় হয়ে পড়ে, তবে স্বপ্নদেখে বড় হওয়ার। অনেক বড়। তাই লেখাপড়াকে করে নেয় জীবন-সংগ্রামের হাতিয়ার।

ধীরে ধীরে একদিন কিশোরটি তারুন্যে পা দেয়, অর্জন করে বি.এস.সি ডিগ্রী । পাশের গ্রামের একটি নতুন হাইস্কুলে খুলেছে, সবাই তাকে ধরে সেখানে পড়াতে। ধীরে ধীরে সে বনে যায় বি.এস.সি মাস্টার। নিজের জায়গা জমিতে ফসল করে আর পড়ায় পাশের গ্রামের স্কুলে। গ্রামের স্কুল তাই ধরা-বাধা কোন বেতন নেই। গ্রামের মানুষ অধিকাংশই কৃষক, নুন-আনতে পান্তা ফুরায় যাদের তারা আবার স্কুলের বেতন দিবে কি করে!! তবে নবান্নে যে যার সাধ্য মতো ফসল দিয়ে স্কুলের দেনা শোধ করে। এভাবেই নিস্তরঙ্গ কেটে যাচ্ছিলো তরুনটির জীবন।

ধীরে ধীরে তরুনটি সংসারী হয়; গ্রামের মুরুব্বীরা খুঁজে পেতে বি.এস.সি মাস্টারের জন্য ফুঁটফুঁটে একটি বউ নিয়ে আসে। এস.এস.সি পড়ুয়া কিশোরী’র ছোয়ায় মাস্টারের জীবন বর্ণিল হয়ে ওঠে। মাস্টারের ঘরে এসে কিশোরীটি এস.এস. সি পাশ করে লেখা পড়ায় ইস্তফা ঘোষণা করে। কিন্তু এই বর্ণ গন্ধ বেশি দিন স্থায়ী হয়না; নতুন বউয়ের আদর-আবদার দুরে থাক, তাঁর ভরণ-পোষনের চিন্তায় সে অস্থির হয়ে ওঠে। সময় বয়ে যায়, সংসার বড় হতে থাকে। প্রথমে দুইপা থেকে চার পা, ধীরে ধীরে তা পরিনত হয় ছয় পা’য়ে। তাদের সংসারে আলো করে আসে একটি শিশু। শিশুর দুধ যোগাড় করতে করতেই মাস্টার হিম-সিম খায়। তাই আয় রোজগার বাড়ানোর জন্য পাশের শহরের একটি ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানীতে কেমিস্ট হিসেবে বাড়তি কাজ নিয়ে নেয়। যেহেতু শহরের দুরত্ব বেশি নয়, তাই বাড়ী থেকেই যাতায়াত করে সে।

এরই মাঝে সংগ্রাম করে বি.এস.সি মাস্টার বি.এড পাশ করে, নামের পাশে যুক্ত হয় বি.এস.সি;বি.এড। বউ ঘোষণা করে আবার নতুন সদস্যের আগমণী বার্তা। মাস্টারের মনটা আনন্দিত হলেও ভবিষ্যৎ চিন্তায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়। নতুন সন্তান নতুন সম্ভাবনা, কিন্তু তাদের তো শুধু অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করলে হবেনা, মানুষের মতো মানুষ করতে হবে; শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হবে। মাস্টার মাথায় নতুন চিন্তা ভর করে। তাকে দুবাই যেতে হবে। যে করেই হোক যেতেই হবে। না হলে তো সন্তানদের মানুষ করতে পারবেনা সে।

বড়ভাইয়ের সহায়তায় একদিন গ্রামের ভোলা-ভালা ভালো মানুষ টাইপের বি.এস.সি মাস্টার পাড়ি জমায় পেট্রো-ডলারের দেশ কুয়েতে। গিয়ে পড়ে বৈরি পরিবেশে। নতুন দেশ, নতুন ভাষা; কে দেবে তাকে চাকুরি? দেশী ভাইদের সহায়তায় কয়েক মাস পর ছোট খাট একটা কাজ পায় মাস্টার। এরই মাঝে ধীরে ধীরে আরবী ভাষাটা দখলে চলে আসে মাস্টারের। পেয়ে যায় একটা বড় চাকুরি, সে দেশের পাওয়ার স্টেশনের একটা সরকারী চাকুরি। দেশি টাকায় মাসিক বেতন ষাট হাজার টাকা। মাস্টার স্বপ্ন দেখে রঙ্গিন ভবিষ্যতের। চাকুরিটায় একটু ধাতস্থ হয়েই বউ আর ছেলেদের নিজের কাছে নিয়ে আসতে হবে।

আগামীকাল নতুন চাকুরিটায় জয়েন করবে মাস্টার তাই মনটা ফুরফুরে। আগের চাকুরিটা ছেড়ে দিয়ে এসেছে গত সপ্তাহে। নতুন কাপড়-চোপড় বানিয়ে নিয়েছে। তাই নেড়ে-চেড়ে মনে মনে মহড়া দিচ্ছিলো নতুন জায়গায় সে কিভাবে সবার সাথে মানিয়ে নেবে। হঠাৎ করে পুরাতন কর্মস্থল থেকে ডাক পাঠায় বস, একটা জরুরী কাজে এক্ষুনি তাকে দেখা করতে বলেছেন বস।

এদিকে দেশে মাস্টারের বউ এর মন ভাল নেই। ছোট ছোট দুটি ছেলে’কে নিয়ে তাঁর বড় চিন্তা। মাস্টারের গেলো প্রায় ছয় মাস হয়ে যাচ্ছে এখনো কোনো টাকা পাঠানোর নামগন্ধ নেই। তবে গতকালই একটা চিঠি পেয়েছে; মাস্টার লিখেছে তাদের কষ্টের দিন ফুরিয়ে আসছে। এরই মাঝে মাস্টারের বউ একটি টেলিগ্রাম পায়, মাস্টার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে।

আসলে তখন মাস্টার হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। সেদিন পুরাতন কর্মস্থলে যাওয়ার পর মাস্টারের একটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়; অয়েল ট্যাংকার বিস্ফোরিত হয়ে তাঁর গায়ে আগুন লেগে যায়। সে তখন সাত তলা বিল্ডিং এ কাজ করছিল; তা নিজের কাজ নয়। অন্য একজন লোক না আসায় মালিক তাকে খবর দিয়ে নিয়ে এসেছিলো, বদলি কাজ করে দেওয়ার জন্য। হয়তো কিছু অর্থও মিলতো এই থেকে। যেহেতু সে কিছুদিন আগেও এইখানে কাজ করে গিয়েছে তাই আর না করতে পারেনি।

গায়ে যখন আগুন লাগে তখন মাস্টারের গায়ে একটি ট্রেটন কাপড়ের তৈরি সার্ট গায়ে ছিলো, তাই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এবং তা তাকে গুরুতর আহত করে। দীর্ঘ ছয়দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে মাস্টার কিছু স্বপ্ন আর কিছু স্মৃতি পেছনে রেখে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেই। ছয় বছর আর তিন বছরের দু’টি অবুঝ ছেলেকে নিয়ে মাস্টারের বউ চোখে অন্ধকার দেখে। দিনটা ছিলো বৃহস্পতিবার; ৬ মার্চ, ১৯৮০ সাল।


মানুষ মানুষের জন্য

উপরের কাহিনীটি কোনো কল্প কাহিনী নয়। উপরে বর্ণিত মাস্টারের আমি ছোট ছেলে। নিজে একান্ত কথাগুলো এইভাবে লেখার কোনো পরিকল্পনা ছিলনা আমার। আজ অফিস থেকে ফিরে প্রথম আলোর ৮ম পাতায় চোখ আটকে যায় একটি মানবিক আবেদনে । আর তখনই মাথায় আসে ব্লগে আবেদনটি গেলে হয়তবা প্রবাসী ভাইরা জানতে পারবেন। হয়তবা করতে পারবেন নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যও। যার জন্য আমার এই লেখার অবতারনা। ভূমিকাটা একটু বড় হয়ে যাওয়ায় সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। হওতবা নিজের বাবা মাস্টার ছিলেন বলেই এই পক্ষপাতিত্ব, হয়তবা আঞ্চলিকতাও একটি কারণ হতে পারে! তবে সবার উপরে এটাই সত্য মানুষ মানুষের জন্য। ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল যে অতলান্ত সাগরের উৎস তা আমরা সবাই জানি, তাইতো মানুষ গড়ার কারিগরকে বেচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে আমার এই আবেদন।
২৩৫ বার পঠিত
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

১. ২৯ শে মে, ২০০৮ রাত ১২:১১

অরূপ রতন বলেছেন: বিশাল বড় পোষ্ট।

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রক্তাক্ত বিজয় দিবসের অভিনন্দন ও বেদনাবিধুর শুভেচ্ছা॥

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২০


১৯৭১-এর ১৬ ই ডিসেম্বর বাঙালীর ইতিহাসে একটি চির অম্লান বিজয়ের দিন।

এই দিনের অনুভুতি আমার মাঝে একটি মিশ্র অনুভুতির সৃষ্টি করে। একদিকে লক্ষ প্রান হারিয়ে ফেলার তিব্র যন্ত্রনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয় তুমি কার ??? X#(

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:২৬



বন্ধু রাষ্ট্রের চা কারিগর লোরেন্দ্র মুদি ফেসবুকে পোস্ট করেছে ১৯৭১ এ ভারতের বিজয় নিয়ে। সেখানে না আছে বাংলাদেশের নাম না আছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কোনো উল্লেখিত শব্দ। ইতিমধ্যেই অনেকেই পোস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত কি বাংলাদেশকে কখনো আক্রমন করবে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৩০



ভারত বাংলাদেশকে কখনো আক্রম করবে না। নো নেভার।
বাংলাদেশও কখনো ভারতকে আক্রমণ করবে না। কেউ কি নিজের ঘরে আক্রমণ করবে? ভার‍ত বাংলাদেশ আলাদা কিছু নয়। সবচেয়ে বড় কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিতাড়িত শয়তান, জ্বীন, সালাদীন, এসব নিয়েই আপনার জীবন?

লিখেছেন জেনারেশন৭১, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪২




আপনার মাথায় বিতাড়িত শয়তানের কলকারখানা থাকার কারণে কি আপনি ঠিক মতো পড়ালেখা করতে পারেননি স্কুল ও কলেজে? ইহার প্রভাবে কি আপনি মেডিক্যালে বা ইন্জিনিয়ারিং'এ চান্স না'পেয়ে অবশেষে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙালী/বাংলাদেশী !!!

লিখেছেন বিষাদ সময়, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২

আজ পত্রিকার একটি খবর শেয়ার করতে ইচ্ছে হলো। প্রথমে নিচে খবরের লিঙ্কটি দিলাম-
প্রথম আলোর খবর-

খবরের বিষয় -আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি পোষ্টে লিখেছেন--

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×