অবশেষে অনেক দ্বিধা, সন্দেহ এবং আগ্রহ নিয়ে ডায়েরিটা পড়েই ফেললাম। প্রত্যেকটা পাতায় কোটেশনের মত করে মা লিখেছে। বিদেশে আসার পর কখনও বাসার কথা , মায়ের কথা, বাবার কথা, ভাই এর কথা মনে করে কাঁদিনি। কিন্তু ডায়েরির প্রথম একটি লাইন পড়ার পরে পুরো ডায়েরিটা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে পড়ে শেষ করেছি। মনে হল, লিখে ফেলি ডায়েরিটা।
তোমার জন্য আমার সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ভালবাসা।
যখন তোমার মন খারাপ থাকবে তখন এই ডায়েরিটা পড়বে, তবেই তুমি আমাকে পাবে।
তোমার আম্মু।
যখন আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করবে, এই ডায়েরিটা মনোযোগ সহকারে পড়বে। আমার গায়ের গন্ধ, আমার বকা, আমার আদর, সবকিছু থাকবে তোমার দু হাতের মাঝখানে ।
এই ডায়েরি যখন তুমি পড়বে তখন তুমি আমার কাছ থেকে অনেক দূরে থাকবে। জানি তোমার খুব কষ্ট হবে, আমারও...। কিন্তু সময় যেখানে এনে দাড় করিয়েছে আমাকে , তোমাকে, সবাইকে, এর চেয়ে ভাল সিদ্ধান্ত আর কিছু ছিল না। যদি থাকত, তবে তোমাকে বুকের মাঝে আগলে রাখতাম, কনো দিন ও হাত ছাড়া করতাম না।
খুব কষ্ট হয় যখন ভাবি তুমি ঘরে নেই। শুন্য লাগে সবকিছু। হাহাকার করে মন। পুড়ে যায় মনের সব কেন্দ্র বিন্দু। তারপরেও সেই পোড়া মনের মাঝখানে শুধু তুমি সৃষ্টি। চোখ বন্ধ করে যখন ভাবি, আমি তোমার মুখের কাছে তাওমার নরম গালে চুমু খাই, তোমার গালে আমি আমার বুকের দুধের গন্ধ পাই।তখনি প্রান টা হু হু করে কেঁদে ওঠে। মনেহয় , তোমার গাল থেকে মুখ না সরাই, ওখানেই যদি সারা জীবন রাখতে পারতাম আমার মুখ খানা, আর সরাতে হত না কোনদিন...
কষ্ট ছাড়া কোন মানুষ নেই। তবুও চলার পথে নিজেকে প্রচন্ড ভাবে শক্ত রাখবে সততার সাথে। যতক্ষন পারবে নিজের বিবেক কে অন্যের কাছে বিলিয়ে দিবে না। আমার অনেক আশা, অনেক আস্থা। অনেক বিশ্বাস তোমার চোখে । তুমিই আমার নীরব বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবি সবাই কে ছাপিয়ে নির্ভরতার আসনে বসাবে তোমাকে।
পড়া লেখা ছাড়া কোনভাবেই জীবনে বড় হওয়া সম্ভব নয়। অনেকে অনেক ভাবে বড় হয় , কিন্তু সেটা ক্ষনস্থায়ী। তুমি লেখা পড়া করে অনেক বড় হবে। মানুষের সেবা করে তাদের শান্তির নিঃশাস তোমার উপর বর্ষিত হবে। তুমি আমার পেটে ছিলে পুরো নয় মাস । অক্টোবরের ২৮ তারিখে দুপুর ১২ টায় সময় যখন তুমি হলে তার আগ পর্যন্ত শুধু মনের ভেতর স্বপ্ন বুনেছি, যে আসবে, সে ডাক্তার হবে। যেদিন তুমি আসলে, সেদিন ডাক্তাররা আমার মাথায় হাত রেখেছিল, দিয়েছিল আমার প্রসব বেদনায় সান্ত্বনা। তাদের মাঝেও আমি তোমাকে খুঁজেছি। তাদের মত তুমিও একদিন কোন অসুস্থ , অসহায় মানুষের মাথায় হাত রাখবে।নিয়ে নিবে অই মুহুর্তের তার সমস্ত ভালবাসা। মানুষ তখন এতটাই অসহায় থাকে , তখন চিকিৎসক কে মনে হয় নারী ছেড়া ধন। ঠিক ঠিক ভাবে লেখাপড়া শেষ করবে, যত কষ্টই হক না কেন।তোমাকে অনেক বড় ডাক্তার হতেই হবে।যাতে সবাই তোমাকে চেনে ... এটাই সেই সৃষ্টি।
পুরো আত্মবিশ্বাস আর ভালবাসা নিয়ে পথ চল...চিরদিনের মত সচ্ছল একটা পথে। আর সময়ের মুল্য ফেরত দেওয়ার মত কেউ এখনও সৃষ্টি হয় নাই। নিজের সময় নষ্ট করবে না। মানুষের সেবা করার মত মহৎ কাজ কয়জন ই বা করতে পারে ?
তুমি তো কত সহজ সরল... অথচ তোমাকে সবাই ব্যবহার করেছে। কিছু কি পেয়েছ বা শিখেছ তাদের কাছ থেকে? আমি অনুভব করেছি তুমি সবাইকে বুঝতে পারো। ভালভাবে অন্যকে বোঝ...কিন্তু সহজে বিশ্বাস করবে না।সহজেই বিশ্বাস করার গুন টা ধ্বংস করে ফেলো মন থেকে।
তোমার বয়স যখন ১১ মাস তখন তুমি হাঁটতে শিখেছ। এমনকি দৌড়াতে এবং স্পষ্ট ভাবে কথাও বলতে পারতে।শিশির কথা বলা শিখেছে অনেক দেরীতে। ও শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে সব কিছু দেখত, সময় মত খাবার পেলে কাঁদতও না। আর তুমি অল্পতেই প্রচন্ড কান্না কাটি করতে । আব্বু অফিসে গেলে সাথে যাওয়ার জন্য অনেক্ষন ধরে কাঁদতে। আমি যদি কোন কারনে কষ্ট পেতাম...কাঁদতাম তখন সেই ১১ মাসের ছোট্ট তুমি এসে তোমার ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে আমার গাল ধরে বলতে, " তুমি কাদঁতেছ কেন? আব্বুকি তোমাকে বকা দিসে?" আরও কত কি...।তুমি তখনি বুঝতে যে , মানুষ কষ্ট পেলে কাঁদে।
পড়া শুনো কর। নিজেকে মুল্য দাও। তখন ঘরের মানুস মুল্য না দিলেও তোমার বন্ধুরা, তোমার সহকর্মীরা তোমার মুল্য দেবে।। কখন একা হবে না। আগে নিজেকে শ্রেষ্ঠতম করে তৈরী কর।তারপরে অন্যসব কাজে গুরুত্ব দাও। তুমি যখন যেই সমস্যায় পরবে,আর কাউকে বলতে না পারলেও আমাকে বলবে। মায়ের থেকে বড় বন্ধু আর কোথাও পাবে না। জীবন গোছাতে অনেক সময় লাগে।। কিন্তু এলোমেলো করতে ১ সেকেন্ড ও লাগে না। তুমি মানুষ চিনতে পারো না। সবাই কে মানুষ হিসেবে ভালবাস...কিন্তু কাউকে সহজে বিশ্বাস কর না। কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না।
আমি তোমাদের থেকে অনেক কম বুঝি। তোমরা কম্পিউটার যুগের মানুষ। ঠিক মত বুঝে পথ চলবে।।
তোমার জীবন অনেক সুন্দর হবে।তোমার মন অনেক বড়।কোনদিন কাউকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করোনি তুমি। সবাই কে উদার ভাবে ভালবাসার একটা ক্ষমতা তোমার আছে। তুমি শুধু ধৈর্য্য ধরে একটু কষ্ট করো। দেখবে সামনে তোমার অনেক সুন্দর একটা ভবিষ্যত।
আমি জানি যখনি তোমার মন খারাপ হবে তুমি এই ডায়েরিটা বার বার পড়বে...।