আমি বড় স্বার্থপর , মা । কিছু দিন পরে আমি তোমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাব...এখন বসে বসে চিন্তা করছি...আমাকে সকাল বেলায় ঘুম থেকে ডেকে তুলে ওষুধ খাওয়াবে কে, জামা কাপড় মিলিয়ে মিলিয়ে কানের দুল কিনে দেবে কে, বার বার এলোমেলো করা আলমারি বকতে বকতে গুছিয়ে দেবে কে, ঝাল মশলা দিয়ে পদের পদের রান্না করে খাওয়াবে কে? কোন উত্তর পাই না।এসব তুমি কেন করো মা? কি জন্য? কিসের আশায়? চিন্তা করে দেখেছি, তুমি কোন কিছুর আশায় এগুলো করো না...তুমি করো, কারন তুমি আমায় ভালবাসো। কিন্তু আমি তোমার জন্য কি করেছি? হাজার বার প্রশ্ন করলেও শুধু নিশ্বাসের প্রতিধ্বনি শুনি।তোমায় আমি ভালবাসি না মা......।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর " ছুটি" গল্পটিতে বলেছিলেন "১৩ -১৪" বছরের ছেলে দের মত এমন বালাই আর নেই"। উনি ছেলে দের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমি হলাম " মেয়ে " বালাই। তখন তো তোমাকে আমার শত্রু মনে হত...দুচোখে দেখতে পারতাম না তোমায়...একদিন তো তোমার সাথে ঝগড়া করে বাসা থেকেই বের হয়ে গিয়েছিলাম...তখন বুঝিনি , কতবড় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছি...সেইতো সন্ধ্যাতেই খোয়াড়ে ঢুকলাম...কিন্তু তোমার বের হয়ে যাওয়ার পথ করে দিয়েছিলাম। সেদিন তো একটা চড় মারোনি আমার গালে...।তোমার চড় টা মারা উচিত ছিল। তুমি ভুল করেছো , মা।
মা, তোমার মনে আছে, একবার আমি খুব অসুস্থ ছিলাম...ক্লিনিকের নার্সগুলো কিছুতেই তোমার সাথে দেখা করতে দেবে না...যদি আমি বাসায় চলে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করি ? ওরা তোমাকে বলেছিল আমার ঘুমের সময় আসতে। আমি তো তখন ঘুমিয়েই ছিলাম।আমার রক্তে তখন কড়া ঘুমের ইঞ্জেকশন।তবুও তুমি রুমে ঢুকতেই কিভাবে যেন আমার ঘুম টা ভেঙ্গে যায়...চোখের পাতা খুলতেই দেখি তুমি রুমে ঢুকছো চুপি চুপি, যেন তোমার পায়ের শব্দে আমার ঘুম না ভাঙ্গে।আমি চোখ মেলেছি দেখে নার্স আমার সামনে দাড়িয়ে তোমাকে আড়াল করে...আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেলি...ঘুমিয়ে যাই...তোমার চোখ দুটো ফোলাফোলা লাগছিল...তুমি কি কেঁদেছিলে?
ছোটবেলায় তো তোমাকে কখনও মানুষ ভাবিনি...তোমাকে শুধু আমার মা ই ভেবেছি...যদি একটা বার ভাবতাম যে, তুমিও মানুষ...তাহলে তোমার সাথে এতবড় অন্যায় গুলো করতাম না , মা।এখন আমার বয়স ১৮।এখন বুঝি, তুমি কত বড় মানুষ...কত কষ্ট করেছ তুমি আমার জন্য...আমার ভাইটার জন্য...আমার বাবার জন্য...আমাদের সংসারের জন্য। একবার একটা পারিবারিক ঝগড়ায় তুমি কথায় কথায় বলেছিলে...তোমার শাশুড়ি নাকি তোমাকে একদিন বিড়ালে খাওয়া তরকারি খেতে দিয়েছিল। আমি তখন তোমার পেটে ছিলাম...। এটা শোনার পর থেকে তোমার শাশুড়িকে আমি আজ পর্যন্ত তার প্রাপ্য সম্মান টুকু দেই নি। আর কোন দিন দেবোও না...।
একসময় তোমাকে আমি ভালবাসতাম না । যত্ন নিতাম না ।এখন তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি, আজকে তোমার ওই ফুলে ওঠা পায়ে খুব ইচ্ছা করছিল একটু হাত বুলিয়ে দেই। কিন্তু একসময়ের ঘৃ্না করার দৈন্যতা আমাকে লজ্জা দেয়...আমি লজ্জায় তোমার পায়ে হাত দেই না।
আমি তোমার ভেতর থেকে এসেছি...। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো। তাই তুমি আমার সৃষ্টিকর্তা। চলে যাওয়ার আগে আমি আমার সৃষ্টিকর্তার সাথে একটি দিন ঘুমাতে চাই।