শুকনো পাতা গুলো সরিয়ে গাছের নিচের বেঞ্চি টায় বসলাম।পানির বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে কিছুটা জিরিয়ে নিয়ে ট্রাউজার এর পকেট থেকে মোবাইল টা বের করে দেখি ছেলে মেয়ে দের কারো কল এল কিনা...। প্রতি মুহুর্তে অপেক্ষা করি ওদের কল বা এস এম এস এর। যেদিন ওরা কেউ ফোন করে না সেদিন ভেবে নেই হয়ত ওরা অনেক ব্যস্ত...ক্লাশ...পড়া শোনা ...অফিস...ব্যবসা, পার্টি ...বন্ধু বান্ধব ...নিয়ে । ওদের তো সময় নেই এই বুড়ো বাপ এর কাছে থাকার...মাঝে মধ্যে দায়িত্ব বোধ থেকে আমাকে ভালবাসে...সেই ভালবাসা থেকে মাস শেষে আমার কাছে একটা বাদামি রঙের খাম আসে...এর থেকে আর বেশি কিছু তো চাই না...।
পানির বোতলের মুখ টা আটকিয়ে বোতল টা হাতে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম....রমনার সকাল টা দেখতে ভালই লাগে...।দেখতে ভাল লাগে বলে নয়, ডায়বেটিস আর উচ্চ রক্ত চাপের উত্তম চিকিৎসা নাকি হাটাঁ।সেটাই পরীক্ষা করছি। এখানে আমার মত আরও অনেক পরীক্ষক আছেন যারা আমার মত নিরলস প্রচেষ্টা করে যান হেঁটে শরীর টাকে ভাল রাখার...ওই তো আজমল সাহেব আসছেন...
----কি খবর আজমল সাহেব । ভাল আছেন?
----আরে ,সাজিদ ভাই..., আছি...
বলে হ্যান্ড শেক করার জন্য হাত বাড়ালাম...ভদ্র লোক পকেট থেকে আকাশি রঙের রুমাল টা বের করে হাতের তালুর ঘাম মুছে নিলেন...তারপর হাত টা বাড়ালেন।
---আপনার হাতের তালু ঘামাটা এখন্ব সারেনি দেখছি...
---হা ভাই...ওষুধ তো আর কম খেলাম না...সেদিন এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনলাম এর নাকি ভাল হোমিও প্যাথী চিকিৎসা আছে...দেখি আরেকবার চেষ্টা করে...কিছু হয় কিনা।আপনার খবর কি? ছেলে মেয়ে রা ভাল আছে?
----হুম...ভাল থাকার জন্যই তো এতদুরে থাকে ওরা...আছে ভালই...আপনার মেয়ে টা কেমন আছে? শশুর বাড়িতে মানিয়ে নিতে পারছে তো?
----আছে ভাই আপনাদের দোয়ায় ভালই...মেয়ে টা আমার কিছু বলতে চায় না...। এই তো সেদিন বিয়ে হল...এখনি মাঝে মাঝে ফোন করে চুপ করে থাকে...কথা বলে না তেমন এক্টা...জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে...কোন উত্তর দেয় না...মাঝে মধ্যে বাসায় এসে ওর নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে...কি যে করে কিছুই বুঝি না...আজকাল কার ছেলে মেয়ে রা যে আবেগপ্রবণ...ভয় ই লাগে...
----আসলে নতুন বিয়ে হয়েছে তো। নতুন পরিবেশ , নতুন মানুষ...মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে...। আমার বড় মেয়ে টা তো বিয়ের পর পর স্বামীর সাথে ঝগড়া করে বাসায় চলে আসতো...এখন স্বামীর সাথে তো ভালই আছে...অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল...। ওদের ছেলে টার বয়স ৮ বছর...সেই তুলনায় অনেক বড় হয়েছে...ছবি পাঠায়...এখন আমি নাতিটিকে একবার চুমো দিতে পারি নি...কোলে নেওয়ার বয়স তো চলেই গেল...। মেয়ে টাকে তো আজ ৯ বছর ধরে দেখি না...। চিন্তা করবেন না...ঠিক হয়ে যাবে সব।
হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে কখন যে রোদ উঠেছে ,খেয়াল করি নি...আজমল সাহেব কে বিদায় দিয়ে আমি এবার আমার মত হাঁটা শুরু করলাম...পথে শসাআলার কাছ থেকে দুটো শসা কিনে নিয়ে খেতে খেতে " ঠিকানা" এ চলে এলাম...। ভেতরে ঢোকার পথে দেখলাম করিম সাহেব তার ছেলের সাথে কথা বলছেন আর চোখ এর কোণ ভিজে উঠছে...আমি আর দাড়িয়ে থাকলাম না ওখানে...।আমার রুমে ঢুকে গায়ে পানি ঢেলে ঘাম গুলোকে ধুয়ে এলাম...।ডাইনিং এ প্রায় সবার সাথেই দেখা হল...হালকা কুশল বিনিময়...কিন্তু ওর মধ্যেই জানা হয়ে যায় , কে কেমন আছে? বৃদ্ধাশ্রমে কেউ কি ভাল থাকে?
২
ভর দুপুরে আহারের পর ছেলের পাঠানো আইপড এ গান শুনতে ভালই লাগে...ওদের তো আর দেখতে পাই না...ওদের পাঠানো জিনিস গুলো দেখলেই ওদের মুখ টা চোখের সামনে ভেসে ওঠে...ওরা ভাবে ওরা গিফ্ট করেছে...তাই খুশি হয়েছি...কিন্তূ ওরা জানে না যে ওই জিনিস গুলো খুললেই ওদের জীবন্ত মুখ টা দেখতে পাই...
মান্না দে'র গান আমার সবসময় অনেক বেশি সত্যি মনে হয়..."কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...আজ আর নেই......কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেল গুলো সেই...আজ আর নেই......।
বিয়ের আগে যখন আমাদের প্রেম চলে তখন ইলা কে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম..
---.আমি যদি রাত জেগে বন্ধু দের সংগে আড্ডা দেই , তুমি কি মেনে নিতে পারবে?
---হুম পারব। তবে আমাকেও আমার বন্ধু দের সঙ্গে রাত জেগে আড্ড দিতে যদি দাও , তাহলে।
---মানে? দেখো, আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে খুব সজাগ থাকব...তুমি আমাকে ছাড়া কারও দিকে তাকাতে পারবে না...
---তোমার কি মনে হয় আমি কারও দিকে তাকাবো?
---নাহ্,সেটা অবশ্য মনে হয় না...।কিন্তু তুমি তো অনেক সুন্দর...তোমার দিকে কেউ তাকাবে আমি মেনে নিতে পারবো না..তূমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না...। কখনও না...।
সেই ইলা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে...। কিন্তু ওর চলে যাওয়াটাকে আমি মেনে নিয়েছি...
চলবে............।।