দু'দিন হলো বাসায় নতুন ভাড়াটে এসেছে । অবশ্য এখন পর্যন্ত কারোর সাথে দেখা হয়নি । এমনকি ঐ বাসা থেকে কোন সারাশব্দও পাওয়া যায় না , যেন কোন মানুষজন নেই ! আমার খুব ইচ্ছে করছে গিয়ে দেখে আসি , কেমন ভাড়াটে এসেছে । কিন্তু মা বলে দিয়েছে যেন না যাই , কারন এমন অনেকেই আছেন যারা অযথা কেউ এলে বিরক্ত হয় । তাছাড়া মাত্র দু'দিন হল এসেছে । ওরা তো এখানেই আছে , পালিয়ে যায়নি । কথাটা ঠিক । আমিও তাই কিছু বলিনি আর ।
বিকেলে ছাদে গেলাম , একটু ঘুরতে । দেখলাম একজন অচেনা ভদ্রমহিলা তার থেকে শুকনো কাপড় নামাচ্ছেন । একটু দূরে আমার বয়সী একটা মেয়ে ছাদের রেলিং এর কাছেই বসার যায়গায় আকাশের দিকে চেয়ে বসে আছে আছে । মুখটা দেখা যাচ্ছে না । কেমন যেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে । বুঝতে পারলাম , এরা আমাদের নতুন ভাড়াটে । আমি এগিয়ে গিয়ে ভদ্রমহিলাকে সালাম দিয়ে বললাম , " ভালো আছেন আন্টি ? "
উনি আমার দিকে তাকালেন । তার চেহারায় এক ধরনের বিষন্নতা । তিনি একটু হাসলেন । " ওয়ালাইকুম সালাম , হ্যা ... ( দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ) ভালো আছি । তুমি ভালো আছো ? "
" জ্বী , আপনারা বোধহয় নতুন এসেছেন । আমরা আপনাদের পাশের ফ্লাটেই থাকি । "
" ও আচ্ছা , আমার বাসায় এসো মা । "
" জ্বী আন্টি , যাবো । ও কি আপনার মেয়ে ? "
" হ্যা , ওর নাম আলো "
" যাক , একজন নতুন বন্ধু পাওয়া গেলো । "
আন্টি কেমন যেন হয়ে গেলেন , হাসি উধাও । একটু চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই বললেন , " আশা করছি ওকে আসলেই বন্ধু হিসেবে নিবে । "
আন্টির কথাটা একটু কেমন যেন লাগলো । ঠিক বুঝতে পারলাম না । তবু বললাম , " অবশ্যই আন্টি "
আন্টির ডাকে মেয়েটি আস্তে আস্তে আমাদের দিকে আসতে থাকলো । মেয়েটির চেহারা খুব মায়াবী , কিন্তু দৃষ্টিটা অন্যরকম !
" আমি সুজাতা , কেমন আছো তুমি ? "
আমার দিকে তাকালই না । সোজা গিয়ে মায়ের হাত ধরলো। মনে করেছিলাম ওর মার সাথে কথা বলছি দেখে হয়তো আমার সাথে ও আমার সাথে কথা বলবে , সহজেই বন্ধুত্ব করবে । কিন্তু... ! খুব খারাপ লাগলো । এমন ভাবে আমাকে এড়িয়ে চললো !!
ওরা নিচে চলে গেলো । আমি ছাদে একা । মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো । কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইলে কেউ বুঝি এমন করে ! আমি দেখতে এতই খারাপ !? মন খারাপ করে সারা বিকেল ছাদে বসে কাটিয়ে দিলাম । শেষ বিকেলে সূর্যটা আমাকে টাটা দিয়ে চলে গেলে আমিও নিচে নেমে এলাম । বাসায় এসে দেখি পাশের বাসার ঐ আন্টি মাকে আল্লাহ হাফেয বলে বের হয়ে যাচ্ছেন । আমায় দেখে একটু হেসে উনি উনার বাসায় চলে গেলেন ।
" একটু আগে যে এসেছিলেন , উনি আমাদের পাশের বাসায় থাকেন । খুবই ভদ্র মহিলা । কিন্তু ... "
" উনার মেয়েটা খুবই অভদ্র , তাই না ?? আমি জানি । ছাদে দেখা হয়েছিলো । বাব্বাহ ! কি ভাব মেয়েটার ! আমার দিকে ফিরে চাইলো না !! " খুব রাগ নিয়ে মাকে কথা গুলো বললাম । কিন্তু মার আমাকে উল্টো ধমক দিয়ে বললেন," চুপ কর । কি সব যা তা বলছিস । কি জানিস তুই ঐ মেয়ের সম্পর্কে ?? " আমি মা'র ধমকে অবাক ! চুপ করে গেলাম ।
রাতে খাবার সময় হয়েছে । খেতে বসে মাকে জিজ্ঞেস করলাম , " মা আমি সরি । মেয়েটা কেন এমন বলবে ? "
মা যা বললেন তা শুনে আর কান্না থামাতে পারিনি । " মেয়েটার নাম আলো । ছোট বেলায় একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে ওর বাবা মারা যায় । একই গাড়িতে ও ছিলো । মাথায় খুব আঘাত পায় । দৃষ্টি শক্তি চলে যায় । এখন ওরা ওদের মামার সাথে একই বাসায় থাকে । মেয়েটার সাথে ওর মামাতো ভাই বোন কেউ মিশে না । সবাই ওকে অপয়া বলে ডাকে । মেয়েটা প্রায়ই অসুস্থ থাকে। ডাক্তাররা তেমন কিছুই বলতে পারে না । সারাদিন একটা রুমেই থাকতে হয় ওকে । মামার ফ্যামিলির কেউ ওকে সহ্য করতে পারে না । " মায়ের সাথে কথা হয় যখন , তখন আন্টি বলেছিলেন এসব। মা আমাকে বললেন, " মেয়েটা অনেকক্ষণ ছিলো বাসায় । একা একা বসেছিলো তোর রুমে । আমি বলেছি যখনই পারে আমাদের বাসায় যেন চলে আসে । তোর সাথে কথা বলবে , গান শুনাবে । কিন্তু কি আশ্চর্য আমার কথা শুনে মেয়েটার চোখে পানি চলে আসে । ওর মা ওকে বাসায় দিয়ে আবার যখন আসে তখন বলে এতদিন একা একা ছিলো , কাউকে বন্ধু হিসেবে পাবে ও ভাবেনি ! তাই হয়তো এমন করলো । তুই কিন্তু ওকে একদম কষ্ট দিবিনা । "
" ওমা ! তুইও দেখি আলোর মত কান্না করছিস ! কি আশ্চর্য , কান্নার কি হলো ? " মা আমার চোখে পানি দেখে ফেলেছে । তারাতারি চোখের পানি মুছে খাওয়া শেষ করে নিলাম ।
ঘুম আসছে না । বারান্দায় গিয়ে বসলাম । ঠান্ডা বাতাস , আর চাদের আলোকে সঙ্গী করে চুপচাপ বসে আছি । ভাবছি আমি নিজেকে অনেক দুঃখী ভাবি । আমি কই দুঃখী !!? এ তো দেখি আমার চেয়ে বেশি !
লাইট বন্ধ করে অন্ধকার রুমে একা বসে আছি । ভাবছি , আলো কিভাবে আধারকে সঙ্গী করে এতদিন আছে । নিকষ কালো আধারে এতটা অসহ্য লাগছে কেনো আমার !! এতোদিন তো এমন লাগেনি !! আলো কিভাবে বছরের পর বছর এই আধার সহ্য করছে ? ভাবতেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো ! খুব কান্না পাচ্ছে ।
জানালা খুলে শুয়ে পড়লাম । এমন সময় একটা সুর কানে এলো । এতো মায়াবী সুরে কে গাইছে !
" চোখের আলোয় দেখেছিলাম , চোখের বাহিরে ,
অন্তরে আজ দেখবো যখন আলোক নাহিরে ... "
বুঝতে বাকি রইলো না এটা আলোর গলা । এতো মায়াবী কন্ঠ আল্লাহ তাকে দিয়েছে চোখের আলো নিভিয়ে ! কি অপূর্ব ! ও বোধহয় অন্তর দিয়েই এখন সব কিছু দেখে ।
হঠাৎ গান থেমে গেলো । রাতের নিস্তবদ্ধতা খুব কানে বাজতে লাগলো ! চোখের কোনে পানি নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম ।
২৫/০৭/২০১৪