|জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৩ খ্রীঃ) বিশ্ব বিখ্যাত রসায়ন বিজ্ঞানী , বর্তমান রসায়ন বিজ্ঞানের জন্মদাতা ; নাইট্রিক ও সালফিউরিক এসিডের সর্ব প্রথম আবিষ্কারক , অংকশাস্ত্রবিদ ও বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ ।]
জাবির ইবনে হাইয়ান এর পূর্ণ নাম হল আবু আব্দুল্লাহ জাবির ইবনে হাইয়ান । তিনি আবু মুসা জাবির ইবনে হাইয়ান নামেও পরিচিত । কেউ কেউ তাঁকে 'আল হারারানী' এবং 'আবু সুফী' নামেও অভিহিত করেন । ইউরোপীয় পন্ডিতগন তাঁর নাম বিকৃত করে জিবার (Geber) লিপিবদ্ধ করেন । তিনি কবে জন্মগ্রহন করেন তা সঠিকভাবে নির্ণ্য করা যায় না । যতদূর জানা যায় , তিনি ৭২২ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে জন্মগ্রহন করেন । তাঁর পিতার নাম হাইয়ান । আরবের দক্ষিণ অংশে জাবিরের পূর্ব পুরুষগন বাস করতেন । তাঁরা ছিলেন আজাদ বংশীয় । স্থানীয় রাজনীতিতে আজাদ বংশীয়রা বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন । পরবর্তীতে জাবিরের পিতা হাইয়ান পূর্ব বাসস্থান ত্যাগ করে কুফায় গিয়ে বসবাস শুরু করেন । তিনি ছিলেন চিকিৎসক ও ঔষধ বিক্রেতা । জানা যায় , উমাইয়া বংশীয় খলিফাগনের নিষ্ঠুর ও অমানবিক কার্যকালাপের দরুন হাইয়ান উমাইয়া বংশের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করতেন । সেহেতু তিনি পারস্যের কয়েকটি প্রভাবশালী বংশের সঙ্গে পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করবার জন্য আব্বাসীয়দের দূত হিসাবে কুফা ত্যাগ করে তুস নগরে গমন করেন । এ তুস নগরেই জাবিরের জন্ম হয় । হাইয়ানের ষড়যন্ত্রের কথা অতি শীঘ্রই তৎকালীন খলিফার দৃষ্টিগোচর হয় । খলিফা তাঁকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদন্ড দেন । হাইয়ানের পরিবার পরিজনদের পুনরায় দক্ষিণ আরবে প্রেরণ করেন ।
দক্ষিন আরবেই জাবির ইবনে হাইয়ানের শিক্ষা লাভ শুরু । শিক্ষা লাভের প্রতি তার ছিল পরম আগ্রহ। যে কোন বিষয়ে বই পেলে তিনি তা পড়ে শেষ করে ফেলতেন এবং এর উপর গবেষনা চালাতেন । খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি এখানে গণিতের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ পারদর্শী বলে খ্যাত হয়ে উঠেন । শিক্ষা সমাপ্তির পর জাবির ইবনে হাইয়ান পিতার কর্মস্থান কুফা নগরীতে গিয়ে বসবাস শুরু করেন । সেখানে তিনি প্রথমে চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করেন এবং এ সূত্রেই তৎকালীন বিখ্যাত পন্ডিত ইমাম জাফর সাদিকের অনুপ্রেরণায় তিনি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষনা শুরু করেন । কারো মতে জাবির ইবনে হাইয়ান খলিফা খালিদ বিন ইয়াজিদের নিকট রসায়ন বিদ্যা শিক্ষা লাভ করেছিলেন । কিন্তু এই কথার কোন সত্যতা খুজে পাওয়া যায়নি । কারন জাবির ইবনে হাইয়ানের কার্যাবলীর সময় কাল ছিল কলিফা হারুন অর রশীদের রাজত্বকালে । অথচ কলিফা খালিদ বিন ইয়াজিদ , হারুন ওর রশীদের বহু পূর্বেই ইন্তেকাল করেন । যতদূর জানা যায়, জাবির ছিলেন ইমাম জাফর সাদিকেরই শিষ্য । খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসাবে তাঁর সুখ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে । এ সময় ছিলো আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশীদের রাজত্বকাল । কিন্তু খলিফা হারুণ অর রশীদের সাথে তাঁর তেমন কোণ পরিচয় ও সাক্ষাৎ হয়নি । কিন্তু খলিফা বারমাক বংশীয় কয়েকজন মন্ত্রীর সাথে তাঁর গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো । ইমাম জাফর সাকিকই জাবিরকে বারমাক বংশীয় কয়েকজন মন্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন ।
একবার ইয়াহিয়া বিন খালিদ নামক জনৈক বারমাক মন্ত্রীর এক সুন্দরী দাসী মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে । তৎকালীন দেশের সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসকগণ তাঁর চিকিৎসা করে ব্যর্থ হন । এ সময় মন্ত্রী প্রাসাদে চিকিৎসার জন্য ডাক পড়ে জাবির ইবনে হাইয়ানের । জাবির মাত্র কয়েকদিনের চিকিতসার মাধ্যমে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন । এতে ইয়াহিয়া বিন খালিদ খুব সন্তুষ্ট এবং জাবিরের সাথে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । বারমাক বংশীয় কয়েকজন মন্ত্রীর মধ্যস্থতায় তিনি রাষ্ট্রীয় কিছু সুযোগ সুবিধা লাভ করেন । এর ফলে তিনি রসায়ন বিজ্ঞান সম্পর্কে ব্যাপক গবেষনা করার সুযোগ পান । মন্ত্রী ইয়াহিয়া এবং তাঁর পুত্র জাবিরের নিকট রসায়ন বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করেন । তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য ও বিভিন্ন পদার্থ আবিষ্কার করতে আরম্ভ করেন । খুব অল্প দিনের মধ্যেই তিনি শ্রেষ্ঠ রসায়ন বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত হন । জাবির ইবনে হাইয়ান প্রতিটি বিষয়ই যুক্তির সাহায্যে বুঝবার ও অনুধাবন করার চেষ্টা করেছেন । আধ্যাত্মিকতার দোহাই দিয়ে তিনি কোন কাজে অগ্রসর হননি । তিনি সর্বদা হাতে কলমে কাজে করতেন । প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানমুঙ্খ রূপে পর্যবেক্ষণ করে তার ফলাফল লিখে রাখতেন । তিনি তাঁর 'কিতাবুত তাজে' পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন , " রাসায়নিকের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাজ হলো হাতে কলমে পরীক্ষা চালানো । যে হাতে কলমে কিংবা পরীক্ষামূলক কাজ করে না , তার পক্ষে সামান্যতম পারদর্শীতা লাভ করাও সম্ভবপর নয় । "
জাবির তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই বাগদাদে কাটিয়েছেন । কিতাবুল খাওয়াসের ঘটনাবলী থেকে বুঝা যায় যে অষ্টম শতাব্দীর শেষ দিকে বাগদাদেই তিনি রসায়ন ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাঁর গবেষণা চালিয়েছিলেন । বাগদাদেই তাঁর রসাওয়নাগার স্থাপিত ছিল । উল্লেখ্য যে , জাবিরের মৃত্যুর ১০০ বছর পরে কুফায় অবস্থিত দামাস্কাস গেটের নিকট রাস্তা নতুন করে তৈরী করতে কতকগুলো ঘর ভেঙ্গে ফেলার সময় একটি ঘরে ২০০ পাউন্ডের একটি সোনার থাল ও একটি খল পাওয়া যায় । ফিহরিস্তের মতে এটি ছিল জাবিরের বাসস্থান ও ল্যবরেটরী । ঐতিহাসিক হিস্ট্রিও এ ঘটনার সত্যতা শিকার করেন ।
জাবির ইবনে হাইয়ানের অবদান মৌলিক । তিনি বস্তু জগতকে প্রধানতঃ তিন ভাগে বিভক্ত করেন । প্রথম ভাগে স্পিরিট , দ্বিতীয় ভাগে ধাতু এবং তৃতীয় ভাগে যৌগিক পদার্থ । তাঁর এ আবিষ্কারের উপর নির্ভর করেই পরবর্তী বিজ্ঞানীরা বস্তুজগৎকে তিনটি ভাগে ভাগ করেন । যথা - বাষ্পীয়, পদার্থ ও পদার্থ বহির্ভূত । জাবির এমন সব বস্তু বিশ্ব সভ্যতার সামনে তুলে ধরেন , যেগুলোকে তাপ দিলে বাষ্পায়িত হয় । এ পর্যায়ে আছে কর্পূর , আর্সেনিক ও এমোনিয়া ক্লোরাইড । তিনি দেখান কিছু মিশ্র ও যৌগিক পদার্থ; যেগুলোকে অনায়েসে চূর্নে পরিনত করা যায় । নির্ভেজাল বস্তুর পর্যায়ে তিনি তুলে ধরেন । সনা রূপা , তামা , লোহা , দস্তা প্রভৃতি ।
জাবির ইবনে হাইয়ানই সর্ব প্রথম নাইট্রিক এসিড আবিষ্কার করেন । সালফিউরিক এসিডও তাঁর আবিষ্কার । তিনি 'কিতাবুল ইসতিতমাস' এ নাইট্রিক এসিড প্রস্তুত করার ফর্মুলা বর্ণনা করেন । নাইট্রিক এসিডে স্বর্ণ গলে না । নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডের মিশ্রনে স্বর্ণ গলানোর ফরমুলা তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন । নাইট্রিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডের মিশ্রনে স্বর্ণ গলানোর পদার্থটির নাম যে " একোয়া রিজিয়া " এ নামটিও তাঁর প্রদত্ত । জাবির ইবনে হাইয়ান নানাভাবেই তাঁর রাসায়নিক বিশ্লেষণ বা সংশ্লেষনের নামকরণ বা সজ্ঞা উল্লেখ করেছেন । পাতন , উর্ধ্বপাতন , পরিস্রাবণ , দ্রবণ , কেলাসন , ভস্মীকরণ , গলন , বাষ্পীভবন ইত্যাদি রাসায়নিক সংশ্লেষণ বা অনুশীলন গবেষণার কি কি রূপান্তর হয় এবং তাঁর ফল কি তিনি তাও বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছেন । তিনি চামড়া ও কাপড়ে রঙ করার প্রনালী , ইস্পাত প্রস্তুত করার পদ্ধতি , লোহা , ওয়াটার প্রুফ কাপড়ে বার্নিশ করার উপায় , সোনার জলে পুস্তকে নাম লাখার জন্য লৌহের ব্যবহার ইত্যাদি আবিষ্কার করেন ।
জাবির ইবনে হাইয়ান স্বর্ণ ও পরশ পাথর তৈরী করতে পারতেন । কিন্তু তিনি স্বর্ণ কিংবা পরশ পাথরের লোভী ছিলেন না । ধন সম্পদের লোভ লালসা তাঁকে সভ্যতা উন্নয়নে ও গবেষণার আদর্শ থেকে বিন্দু মাত্র্ব পদস্খলন ঘটাতে পারেনি । দুর্দান্ত সাহসী জাবির ইবনে হাইয়ান স্বর্ণ ও পরশ পাথর তৈরী করতে গিয়ে আজীবন যেখানেই গিয়েছেন দুর্যোগ , দুশ্চিন্তা ও মৃত্যুর সাথে লড়াই ছাড়া সুখ শান্তির মুখ দেখতে পারেননি । জাবিরের মতে সোনা , রূপা , লোহা প্রভৃতি যত প্রকার ধাতু আছে , কোন ধাতুরই মৌলিকতা নেই । এসব ধাতুই পারদ আর গন্ধকের সমন্বয়ে গঠিত । খনিজ ধাতু খনিতে যে নিয়মে গঠিত হয় সে নিয়মে মানুষও ঐ সব ধাতু তৈরী করতে পারে । অন্য ধাতুর সংগে মিশ্র স্বর্ণকে Cupellation পদ্ধতিতে অর্থাৎ মীগারের সংগে মিশিয়ে স্বর্ণ বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি তিনিই আবিষ্কার করেন ।
জাবির এপোলিয়ানের আধ্যাত্মিকবাদ , প্লেটো , সক্রেটিস , এরিস্টটল , পিথাগোরাস , ডিমোক্রিটিস প্রমুখের গ্রন্থের সংগে পরিচিত এবং গ্রীক ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন । তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র , ইউক্লিড ও আল মাজেস্টের ভাষ্য , দর্শন , যুদ্ধবিদ্যা , রসায়ন , জ্যামিতি , জ্যোতির্বিজ্ঞান ও কাব্য সম্পর্কে বিভিন্না গ্রন্থ প্রণয়ন করেন । তিনি দুই হাজারেরও বেশী গ্রন্থ রচনা করেন । তবে তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ । তিনি বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যা পেয়েছেন , তাঁর ফলাফলই ছিল গ্রন্থের বিষয়বস্তু । বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রণীত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রসায়ন ২৬৭ টি , যুদ্ধাস্ত্রাদি ৩০০টি , চিকিৎসা ৫০০টি দর্শনে ৩০০ টি , কিতাবুত তাগিদের ৩০০টি , জ্যোতির্বিজ্ঞান ত০০ পৃষ্ঠার ১টি , দার্শনিক যুক্তি খন্ড ৫০০টি উল্লেখযোগ্য । এসব গ্রন্থ সংখ্যায় অধিক পৃষ্ঠা সংখ্যায় ছিল কম । বিশ্ব বিখ্যাত এ মনীষীর মৃত্যু তারিখ নিয়েও মতভেদ আছে । যতদূর জানা যায় তিনি ৮০৩ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুবরন করেন ।