ক.
এইতো সেদিন, হলের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। আমার পাশাপাশি হাঁটছিলো আরো পাঁচজন:দুটি ছেলে, তিনটি মেয়ে। ওরা কোন বাজির টাকা নিয়ে তর্ক করছিলো । যেটুকু বুঝলাম তাতে স্পষ্টই ধরা গেলো, একটি মেয়ে বাজি হেরেছে এবং জিতেছে ওর বন্ধু:একটি ছেলে। মেয়ে টাকা শোধ দেয়নি। বন্ধুদের মধ্যে বাজির টাকা নিয়ে হরহামেশাই এমন হয়--ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু আমি থমকে গেলাম ছেলেটির কথা শুনে। সে ঐ বান্ধবীকে লক্ষ্য করে বলেলো,‘ টাকা দিবি নাকি তোকে রেইপ করবো ?’ আমি খুব আশা নিয়ে মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম, ও কিছু বলবে যা মুখের ভাষায় না হোক, অন্তত চোখের ভাষায় । মেয়েটি আমাকে পুরোপুরি হতাশ করলো । ও হাসলো । বিশ্বাস করুন, সে হাসিতে শ্লেষ ছিলো না । সম্পর্ক পূনর্মূল্যায়নের কোন ইঙ্গিত ছিলো না ।
খ.
সম্ভবত দুই দিন আগের ঘটনা । কার্জন হলে কথা বলছিলাম এক বান্ধবীর সাথে । সে ফেসবুকে আছে, সম্ভবত লেখাটা সে পড়বেও । কথায় কথায় ‘নারী অধিকার’ প্রসঙ্গ এলো । আমি বেশ ক্ষোভ নিয়েই বললাম,‘আমাদের সমাজের মেয়েরা ‘ধর্ষণ’ শব্দটাই অনুভব করতে পারলো না।’ সে একটু অপ্রস্তুত হলো কিন্তু হাসতে ভুললো না । একটু দম নিয়ে বললো,‘ কেনো? ‘ আমিও সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম ,‘ শব্দটি শুনে তুমিও হাসলে যে ! শব্দটা কি হাস্যকর ? আমাদের অনুভব করা উচিৎ, কী নিয়ে দুষ্টামী করা যায় আর কোন বিষয়ে কোন প্রকার মজা চলে না।
গ.
এক বান্ধবীর বাসা থেকে তাকে স্মার্ট হওয়ার জন্য তাগাদা দেয়া হয় । নিয়মিত বিউটি পার্লারে যাওয়ার জন্য, বাসায় রূপ চর্চার জন্য পরামর্শ ইত্যাদি ইত্যাদি। যতটুকু জানি, সে বান্ধবীও নিজের অনিচ্ছা (চাপা ইচ্ছাও হতে পারে) সত্ত্বেও পারিবারিক পরামর্শ মেনে নিতে শুরু করেছে । অনার্স ডিগ্রীটাতো খোঁপায় গুজেছে এবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে । তারজন্যে প্রস্তুতি মারাত্মক, দু চারটে ডিগ্রীর থেকে বেশ কঠিন এবং বেশ শ্রমসাধ্য ব্যাপার। ঐ বান্ধবীর দারুণ আফসোস যে স্বামী যদি তাকে একটু স্বাধীনতার স্বাদ দেয় ! পরিবার তাকে মূল্যায়ন করেনা , ইচ্ছার মূল্যায়ন দেয় না, ঘরের বাইরে পা ফেলার সুযোগ দেয় না। এমন নানাবিধ সমস্যার সমাধানের জন্য সে আকুল নয়নে স্বামীর পানে তাকিয়ে আছে । আমার ধারণা ঐ বান্ধবীটা ‘স্বামী’ শব্দের নৃ-তাত্ত্বিক অর্থ জানে না । জানানোর চেষ্টা করেছিলাম । লাভ হয়নি । সে স্পষ্ট করেই বলেছে, সে আশাহত হতে চায় না । তার ধারণা, পঙ্খিরাজের ঘোড়া নিয়ে না আসুক, অন্তত মোটর বাইক নিয়ে নিশ্চয়ই কেউ তাকে মুক্ত করতে আসবে ;ঠিকঠাক রূপকথার রাজপুত্রের মত ।
ঘ.
গত বৈশাখের ঘটনা । টুকটাক রাজপথে থাকার অভ্যাস আমারও আছে । তবে ঐ ইস্যুতে আমি ছিলাম না । Sifat Mohammed Istiak Bhuiyan , Stunning Koushik, Saeed Bilash , Aditto Mahmud সহ অনেকে আমাকে ডেকেছে । আমি যাইনি। রোকেয়া হলের একটু দুরেই ঘটনাটি ঘটেছে । শামসুন্নাহার হল দুরে নয় । বিষয়টি নারী নির্যাতনের সাথে সম্পর্কিত, নারী অধিকারের প্রশ্নের সাথে জড়িত । দু’ চার জন বান্ধবী/পরিচিত জনদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, ওরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না । আমিও আর গুরুত্ব দেইনি। কেনো দেবো ? বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা যদি ‘নির্যাতনের’ মত ঘটনায় নাড়া না খায় তবে কে খাবে ? কে তাদের ধ্বংস ঠেকাবে ? কে তাদের বিচার এনে দেবে ? ফরাসি পুরুষদের মত নাকে দড়ি বেঁধে পুরুষরা এদের বাইরে আনবে আবার যখন প্রয়োজন ফুরাবে তখন ভেতরে ঢুকিয়ে ঘরে শেকল দেবে । স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না, ওটা অজর্ন করতে হয় । ভিক্ষা করে স্বাধীনতার কথা গান্ধী ছাড়া সারাবিশ্বে আর কেউ বলেননি। এবং ভিক্ষায় যে স্বাধীনতা নয়, করুণা মেলে তা ভারত-পাকিস্থান মানচিত্রের দিকে চোখ ফেরালেই বুঝা যায় । এরা শিক্ষিত নারী । কেউ কেউ আবার তসলিমা নাসরিনের বই মুখস্ত বলতে পারে কিন্তু ‘মুক্তি’ বিষয়টি এখনো দেখেও পড়তে পারে না । শিক্ষা এদের স্নায়ুকে মুক্তি দেয় না, বাস্তবতা শেখায়, মানতে শেখায় । এদের স্নায়ু উন্মুক্ত নয়, হাজার বছরের পঁচা আবর্জনার স্তুপ নিয়ে সারা শহর চষে বেড়ায় কিন্তু রাজপথ চেনে না । আদতে এরা শিক্ষিতই নয় । শিক্ষা এদের আভূষণ বা অলঙ্কার , মেরুদণ্ড গঠনে শিক্ষার কোন ভূমিকাই নেই । এরা রাজপথ দেখে নাক সিঁটকায়, ডাস্টবিনকে মনে করে বৃন্দাবন । স্নায়ুগত বিকার এদের আক্রান্ত করবে না তো কাকে করবে ? নারী মুক্তির নেতৃত্বে যাদের থাকার কথা তারাই বিভ্রান্ত, এখানে সেখানে বসে সময় কাটায় যেনবা করার মত কিচ্ছু নেই, নিজেকে নিয়ে চিন্তা ছাড়া তাদের কোন ঐতিহাসিক কাজই নেই । কে তাঁদের উদ্ধার করবে ? রাজপুত্র কি আসবে ? কবে ? সে হয়তো নতুন কয়েদখানার নকশা নিয়ে দারুণ ব্যস্ত ।
ঙ.
তনুর লাশ পাওয়া গেছে সেনানিবাসে। ফেসবুক উত্তপ্ত । কয়েকজন নারীও দেখলাম বেশ রেগে আছেন । তাদের এই রাগ এখনো ক্ষোভে পরিণত হয়নি, আমি সে আশাও করিনা । কেউ কেউ দারুণ অভিমানী । রাষ্ট্রের সাথে, বিচার ব্যবস্থার সাথে বা রাজপুত্রদের সাথে তাদের অভিমান । তারা আর বিচার চায় না । কারণ রাষ্ট্র আজ অবধি কোন বিচার করেনি। আমার সোজা প্রশ্ন, ‘ ক’টা বিচার চেয়েছেন ? ‘ কিভাবে চেয়েছেন ? চাওয়ার মধ্যে ভিক্ষুকের সুর ছিলো নাকি অধিকারের দাবী ছিলো ? কোন সুরে কথা বলেছেন ? কাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন ? আপনার ইশতেহার কি ছিলো ? সত্যিকারার্থে চেয়েছেন কখনো ? যা করেছেন তাকে আদৌ চাওয়া বলে ? নারী অধিকার প্রশ্নে ক’টা ব্যারিকেড বাঙলাদেশে ভাঙা হয়েছে ? ক’টা ব্যারিকেডে নারীদের ইতিহাস লেখা আছে ? শূণ্য । পুরোপুরি শূণ্য । নারী অধিকার ঠেকানোর জন্য যত মানুষ রাস্তায় এসেছে ততজন নারী ‘নারী অধিকাররের’ দাবীতে রাজপথে আসেনি। যতদিন তারা তাদের দাবীতে ঐক্যমতে না আসবে ততদিন কিচ্ছু হবে না।
.
তনুরা ফিরে আসবে না । কাউকে ক্ষমাও করবে না । তনুদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের বিবেকের কাছে নির্দোষ হওয়ার কিচ্ছু নেই । ‘তনু হত্যা’র জন্য রাষ্ট্রের সব ধরণের প্রশাসন দায়ী । রাজপথ দায়ী,আবাসিক হল দায়ী। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দায়ী এবং বৈশাখের ঘটনায় যারা ব্যারিকেড ভাঙতে গিয়ে পুলিশের সাথে ঠাণ্ডা আইসক্রিম খেয়ে সচিবালয়ের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন তারাও দায়ী । বুদ্ধিজীবীরাতো বরাবরই হারামজাদা। মানবাধিকার কমিশনের লোকজন আজন্ম শুয়োর । মিডিয়াও তোমার সাথে থাকবে না । ওরা দারুণ ধান্ধাবাজ । ওরা সত্যের পথে নয়, বাণিজ্যের পথে ।
চ.
গ্রামের প্রবাদে শুনেছি ,‘ না কাঁদলে মা-ও দুধ দেয় না ।’
কাঁদো নারী । চিৎকার করো । রাজপথে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্বকে প্রশ্ন করো ......... বিউটি পার্লারে স্বাধীনতা থাকে না, মুক্তির জন্য রাজপথ, রাজপথ এবং রাজপথ !
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৬ ভোর ৪:৩৩