সূত্র: প্রথম আলো | তারিখ: ৩১-০১-২০১২
ব্যক্তি উদ্যোগে কাজের অনুমতিপত্র পেতেও এখন থেকে ওই দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশন থেকে নিয়োগসংক্রান্ত সব কাগজপত্র সত্যায়িত করাতে হবে। তা না হলে কর্মীরা চাকরি নিয়ে বিদেশে যেতে পারবেন না। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ নিয়ম কার্যকর হচ্ছে।
জনশক্তি রপ্তানি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে দেশের জনশক্তি রপ্তানিতে চরম ধস নামতে পারে। কারণ, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, একক ভিসা নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়ায় দেশের ৯০ শতাংশ জনশক্তি রপ্তানি হয়ে থাকে। আগে তাঁদের সত্যায়ন না লাগলেও নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে এখন তাঁরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়বেন এবং দ্বারে দ্বারে ঘুরে কাজ হাসিল করতে হবে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৬ লাখ ৯৯ হাজার ৯৫১ জন বিদেশে গেছেন। তাঁদের ৯০ শতাংশই গেছেন একক ভিসায়।
এত দিন পর্যন্ত দলগতভাবে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে কেবল এ ধরনের সত্যায়নের প্রয়োজন পড়ত। এ প্রক্রিয়ায় বিদেশে যান মাত্র ১০ শতাংশ লোক। মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারকদের আনা চাহিদাপত্রের সূত্রে নানা মাধ্যম ধরে তাঁরা বিদেশে যান। দূতাবাসের সত্যায়ন থাকার পরেও দালালের হাতে প্রতারিত হওয়া, নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি টাকা নেওয়া, বিদেশে গিয়ে কাজ না পাওয়া, কথা অনুযায়ী বেতন না পাওয়াসহ যেসব সমস্যা আলোচিত, এর বেশির ভাগই এই প্রক্রিয়ায় যাওয়া কর্মীদের বেলায় ঘটে। প্রতারিত ব্যক্তিরা এ ক্ষেত্রে জনশক্তি মন্ত্রণালয় থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো সহায়তা বা প্রতিকার পান না।
কিন্তু যাঁরা একক ভিসায় অর্থাৎ প্রবাসী আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশীর মাধ্যমে ভিসা এনে বিদেশে যান, তাঁদের ক্ষেত্রে এসব প্রতারণার ঘটনার হার হাতেগোনা। একক ভিসা পাওয়ার পর কর্মী নিজের উদ্যোগে দূতাবাসের কোনো সত্যায়ন ছাড়াই রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সির মাধ্যমে সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশে যেতে পারেন। কিন্তু নতুন সিদ্ধান্তের ফলে এখন তাঁদেরও একই ‘হয়রানিমূলক’ প্রক্রিয়ায় পড়তে হবে।
তবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়েছে, ‘বিদেশগামী কর্মীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই একক ভিসায় বিদেশে যান। এসব কর্মীর নিয়োগকর্তা, মজুরি, কাজের পরিবেশসহ নানা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস, বিএমইটি এবং মন্ত্রণালয় অবহিত নয় বিধায় কর্মীদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দূতাবাসও এসব কর্মীর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করতে পারছে না। এসব কর্মীর চাকরির নিরাপত্তা, প্রতিশ্রুত মজুরিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস বা হাইকমিশন থেকে নিয়োগসংক্রান্ত সব কাগজপত্র সত্যায়িত করাতে হবে। দূতাবাস ও হাইকমিশন কর্তৃক সত্যায়িত একক ভিসার তালিকা তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটিতে জানাতে হবে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে এ নিয়ম কার্যকর হবে।’
তবে জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, সরকার তথ্য রাখার কথা বলে সত্যায়ন করতে চাইছে। কিন্তু এখন প্রত্যেক কর্মীকে বিদেশে যেতে স্মার্ট কার্ড নিতে হয়। তাতে ওই কর্মী কোথায় যাচ্ছেন, কার অধীনে কাজ করছেন, সব তথ্যই থাকছে। কাজেই তথ্য সংরক্ষণের জন্য সত্যায়নের যে কথা বলা হচ্ছে, তা যুক্তিতে টেকে না।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দাবি, শুধু এই সত্যায়নের মতো ঝামেলা বাদ দেওয়াই নয়, মন্ত্রণালয়ের উচিত একক ভিসার ক্ষেত্রে বর্তমানে আটজনের সুবিধা ৫০ জনে উন্নীত করা।
জনশক্তি রপ্তানি বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও রামরুর সমন্বয়ক সি আর আবরার প্রথম আলোকে বলেন, সত্যায়ন করা মানে দায়িত্ব নেওয়া। কিন্তু দূতাবাস কখনো দায়িত্ব নেয় না। এবারও নেবে না। কাজেই একক ভিসার ক্ষেত্রে সত্যায়ন-প্রক্রিয়া চালু করায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি বাড়বে, জনশক্তি রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশের দূতাবাসগুলোতে এমনিতেই জনবল কম। দলগত ভিসার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভালো করে খোঁজখবর না করেই দূতাবাসের কর্মকর্তারা সত্যায়ন করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়মেরও অভিযোগ আছে। মালয়েশিয়া এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ। এখন একক ভিসার ক্ষেত্রেও সত্যায়ন-প্রক্রিয়া চালু করলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যেমন বাড়বে, তেমনি আর্থিক অনিয়মও বেড়ে যাবে। বিদেশে যেতে অর্থ খরচের হার বেড়ে যাবে।
জনশক্তি মন্ত্রণালয় নতুন আদেশের অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন দূতাবাস ও হাইকমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে পাঠিয়েছে। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের কথাবার্তা না বলেই মন্ত্রণালয় একা এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। আমরা এ ঘটনায় চরম ক্ষুব্ধ।’ নতুন এই নিয়মের ফলে জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নেমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
কেন ধস নেমে আসবে, জানতে চাইলে আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধরুন, সৌদি আরবের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে দুটি ভিসা পাঠানো হলো। এখন দূতাবাসের পক্ষে রিয়াদ থেকে এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে এ ব্যাপারে তথ্য যাচাই করা কি সম্ভব? নাকি তাঁরা দুটি ভিসার জন্য এমন কাজ করবেন? একই অবস্থা হবে সব দেশে। কারণ, দূতাবাসের সেই জনবল নেই। কাজেই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জনশক্তি রপ্তানির যা অবশিষ্ট আছে, তা-ও বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা এই আইন বাতিলের দাবি করছি।’
হঠাৎ কেন এমন নিয়ম করা হলো, জানতে চাইলে বিএমইটির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হযরত আলী সরকারি আদেশে যা বলা হয়েছে, সে যুক্তিই তুলে ধরলেন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক চাহিদাপত্র এনে একক ভিসায় লোক পাঠাচ্ছে রিত্রুদ্ধটিং এজেন্সিগুলো। এর ফলে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। মূলত সেটি বন্ধ করতেই এই উদ্যোগ।
তবে বায়রার সভাপতি আবুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি ধ্বংস করার যেসব চক্রান্ত চলছে, এটি তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। এমনিতেই এখন দূতাবাসগুলো তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই সত্যায়ন করে থাকে। নতুন এই নিয়মের ফলে কেবল সত্যায়ন করতে গিয়েও তাঁরা কূল পাবেন না। ফলে দুর্নীতি যেমন বাড়বে, তেমনি এই ব্যবসায় ধস নামবে।’ তিনি বলেন, ‘বাধ্য হয়ে তখন আমাদের এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যেতে হবে।’
অভিবাসনবিয়ষক বেসরকারি সংস্থা ইমা রিসার্চ ফাউন্ডেশনের জাতীয় সমন্বয়ক আনিসুর রহমান খান বলেন, ‘দূতাবাসের সেই দক্ষতা নেই, যাতে করে তারা চাহিদাপত্র যাচাই-বাছাই করতে পারে। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা, এখন একটি ভিসা নেওয়ার ক্ষেত্রেও মালিককে দূতাবাসে যেতে হবে। ছুটির দিন ছাড়া কারও পক্ষে সেটি করা কঠিন। ছুটির দিনে আবার দূতাবাস বন্ধ। সব মিলিয়ে জটিলতা আরও বাড়বে।’ তিনি বলেন, যাঁরা ১০ শতাংশ প্রবাসীর দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারেন না, তাঁরা ৯০ শতাংশ লোকের দায়িত্ব কেন নিচ্ছেন! শুধু কি তথ্য সংগ্রহে রাখার জন্য? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে?
জানতে চাইলে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যা করছি, ভালোর জন্যই করছি। এখন কারা একক ভিসা আনছে, তারা কোথায় যাচ্ছে, আমরা সে ব্যাপারে কিছুই জানতে পারছি না। প্রতারণা কমানোর জন্যই আমরা এই ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বছরে পাঁচ লাখ লোক বিদেশে গেলে চার লাখই যাচ্ছেন একক ভিসায়। একক ভিসায় এত লোক কী করে যান? এখন দলগত কাজের চাহিদা এনে তিন-চারজন করে একক ভিসা দেখিয়ে লোক পাঠানো হচ্ছে। আমরা সেটি বন্ধ করতে চাই। তাই নতুন এ ব্যবস্থা।’
কাগজপত্র সত্যায়নের জন্য দূতাবাসের যথেষ্ট লোকবল বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আছে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘বুদ্ধি খাটালেই কাজ করা যায়। সব জায়গায় তো আর যেতে হবে না। অনেক জায়গায় ফোন করেও খোঁজখবর নেওয়া যায়।’
এর ফলে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রথম প্রথম তো কমবেই। দেখি না কী হয়। আর যদি বেশি সমস্যা হয়, যদি দেখি লোক যাওয়া অনেক কমে গেছে, তখন অন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। নিয়ম বাতিল করতে তো আর সমস্যা নেই।’
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:৫৭