একটি ল্যাপটপ, একটি মোবাইল ফোন: খুন হওয়ার যত কারণ
ফারুক ওয়াসিফ | তারিখ: ২৯-১২-২০১১
একটি ল্যাপটপ সমান এক তরুণের আস্ত জীবন, একটি নতুন মোবাইল ফোনসেটের বিনিময়ে তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী; নইলে দুজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের জীবন। এই হলো কনজিউমারিজম—এই হলো পণ্যাসক্তি আর অপরাধের অশুভ বিবাহের সংসার।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনার কথাই বলছি। আট শিক্ষার্থী যাঁর নৌকা ভাড়া করেছিলেন; নতুন মোবাইলের টোপে সেই মাঝিকে আগেভাগেই পটানো হয়েছিল। তাই জায়গামতো নৌকাটি থামান যাতে মাস্তানরা শিকারদের নাগাল পায়। শত্রুতা বা মুক্তিপণ আদায় তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা শাবিপ্রবির তিন ছাত্রীকে পড়ে পাওয়া চৌদ্দআনার মতো খরচ করতে চেয়েছিল। তাতে ব্যর্থ হওয়ায় খরচ করে দিল দুটি তাজা জীবন। ডিজিটাল যুগে এই হলো ‘এ জার্নি বাই বোটের’ নতুন সংস্করণ।
এই গল্পের মুখ্য চরিত্র একটি মোবাইল ফোনসেট। মোবাইল ফোনসেটের লোভে মাঝি বশ না মানলে হয়তো বখাটেরা মওকা পেত না। লোহা বিদ্যুতায়িত হলে মারণাস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। ক্ষমতায়িত যৌনতা বা যৌনায়িত ক্ষমতা তেমনই মারাত্মক। সিলেটে তিন ছাত্রীকে অপহরণের চেষ্টা এবং দুই ছাত্রকে পানিতে ফেলে হত্যার ঘটনা—এই ভয়াবহতার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মুখ ফেরানোর উপায় নেই।
মোবাইল ফোনসেট জড় বস্তু, যার হাতেই থাকুক হুকুমের দাস। কিন্তু মানুষ যন্ত্র বা পণ্য নয়, মানুষ নির্যাতিত হতে বা অনিচ্ছায় অন্যের আনন্দের খোরাক হতে ঘৃণা করে। কিন্তু ওই বখাটেরা ছাত্রীদের মোবাইল ফোনসেটগুলোর মতোই দখলের সামগ্রীর বেশি কিছু ভাবেনি। তাদের চোখে উভয়ই ছিনতাইযোগ্য। ক্রয়ের সামর্থ্য থাকলে তারা হয়তো তাদের কিনতেই চাইতো। কিনবার পর্যাপ্ত টাকা থাকলে সম্ভবত মাঝি লোকটাও আদিম বিনিময় প্রথার কায়দায় মোবাইল সেটের বিনিময়ে মেয়েদের তুলে দিতে রাজি হতো না। এদের সবার মনের চালিকাশক্তি হিসেবে তাই নির্ভুলভাবে পণ্য মানসিকতাকে (কনজিউমারিজম) শনাক্ত করা যায়।
পরের ঘটনাটি চট্টগ্রামের। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কফিলউদ্দিন বন্ধুর হাতে খুন হন। খুনের মোটিভ, কফিলউদ্দিনের দামি ল্যাপটপটি বাগানো। বন্ধুত্ব বা জীবনের থেকে বাহারি পণ্যের আকর্ষণ এতটাই জোরালো যে তার জন্য অবলীলায় খুন-খারাবি পর্যন্ত ঘটতে পারে! আমাদের চারপাশে এরকম ঘটনা বিস্তর।
অনেকের কাছেই এখন মুঠোফোন, ল্যাপটপ, আইপড ইত্যাদি কেবল প্রয়োজন নয়, স্টাইল-স্ট্যাটাস-স্মার্টনেস অর্জনের উপায়। সিলেটের ওই মাঝির একটি ফোনসেট ছিল। তার পরও নতুন আরেকটি ফোনসেটের লোভ তাঁকে ধুরন্ধর করেছে। চট্টগ্রামের খুনি বন্ধু জাহেদের কাছেও ল্যাপটপের প্রয়োজনটা মারাত্মক ছিল না। তবুও মোহ তাঁকে উন্মত্ত করে। উল্টো ঘটনাও ঘটে। পছন্দের ভিডিও গেম কিনে দেওয়া হয়নি বলে কিশোরের আত্মহত্যার সংবাদও আমরা পড়েছি।
এসব ঘটনায় কেবল প্রাণই যায়নি, বিশ্বাসও গেছে। বন্ধুত্বের মধ্যে, পারস্পরিক লেনদেনার মধ্যে ঢুকে গেছে মোহের কাঁটা। মানুষে মানুষে সম্পর্কের থেকে, আদর-স্নেহ-ভালোবাসার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে পণ্য এবং তা পাওয়ার বাসনা। একেই বলা হচ্ছে কনজিউমারিজম বা পণ্যাসক্তি বা পণ্যপূজা। পণ্যপূজা নতুন ধর্ম, শপিং মল তার তীর্থকেন্দ্র, ক্রেতারা তার তীর্থযাত্রী। এই প্রেমে সবার অধিকার সমান নয়। এই অসম ক্রয়ক্ষমতা এবং অক্ষমতাজনিত হতাশা জন্ম দিচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, বাড়াচ্ছে অপরাধপ্রবণতা।
এসব ঘটনার পেছনে অভাবের তাড়না বা ক্ষুধার জ্বালা পাওয়া যাচ্ছে না। যে জ্বালায় তারা পুড়েছে, তার নাম পণ্যাসক্তি। ফরাসি বিপ্লবের কারণ ছিল ক্ষুধার জ্বালা আর সাম্প্রতিক প্যারিস বা লন্ডনের দাঙ্গার পেছনে ছিল কিনতে না পারার জ্বালা। সমাজবিশ্লেষকেরা এর পেছনে কনজিউমারিজমের প্ররোচনাকে দায়ী করেছেন। পোলিশ সমাজবিজ্ঞানী জিগমুন্ট বওম্যান যেমন বলেছেন, ‘এগুলো রুটি-রুজির হাঙ্গামা নয়। এটা হলো অসমর্থ ও বাতিল ক্রেতাদের দাঙ্গা।’ তিনি এদের বলছেন ‘নতুন গরিব’। এই ‘নতুন গরিবরা ভুখা-নাঙ্গা না হলেও পছন্দসই জিনিস কেনার মতো আয়রোজগার তাদের নেই। শ্রমিকদের মতো শ্রেণীবোধ এদের নেই, এরা পরস্পরের দুঃখ-কষ্টে একও হতে পারে না। যা পাওয়ার জন্য তারা অস্থির, সেটা হয়তো একটা ল্যাপটপ বা একটা আই ফোন বা কোনো দামি ব্র্যান্ডের পোশাক। এসবই তাদের জীবনের সুখ, এসবই পাত্তা পাওয়ার উপায়; না পেলে মন দমে যায়, নিঃসঙ্গতায় পায়।
ইউরোপীয় কমিশনের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, শেষবিন্দু পর্যন্ত কেনাকাটা করার সংস্কৃতি পশ্চিমা সমাজে অপরাধপ্রবণতা, সামাজিক উত্তেজনা ও অবিশ্বাসকে চরমে তুলছে। কনজিউমার ক্যাপিটালিজম: দ্য ওয়ে ফরওয়ার্ড নামে গবেষণাভিত্তিক একটা বইও প্রকাশিত হয়েছে, যার মূল কথাও এটাই। ক্রয়ক্ষমতা যেখানে যত কম, সেখানে ততই ছিনতাই-ক্ষমতার বিস্তার ঘটে।
দোলনা থেকে কফিন পর্যন্ত কেনাকাটার সংস্কৃতির এই আবেশে শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই বদলাচ্ছে। যে বদলাতে চাইছে না, তাকে ভাবা হচ্ছে পিছিয়ে পড়া, আনফিট-আনস্মার্ট। ছোটবেলায় একটি লাটিম বা একটি ঘুড়ি, বেশি হলে তিন চাকার খেলনা সাইকেলের বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না আমাদের। আজকের সচ্ছল পরিবারের শিশু চায় মোটরসাইকেল, কম্পিউটার, ভিডিও গেম, মোবাইল, সেরা ব্র্যান্ডের জামা-জুতা। আমাদের প্রয়োজন সীমিত কিন্তু চাওয়া অসীম। পণ্য এবং তার বিজ্ঞাপনের যেহেতু শেষ নেই, সেহেতু চাইবারও কোনো শেষবিন্দু নেই। অবিরত নতুন পণ্যের হাতছানিতে চাওয়া যেমন থিতু হচ্ছে না, তেমনি একটা কিছু পেয়ে তৃপ্তও হওয়া যাচ্ছে না। পণ্য-সংস্কৃতির চোরাবালিতে নিমজ্জিত মানুষের কাছে পণ্যও আসলে মুখ্য নয়, মুখ্য হলো পণ্যভোগের সাধ, পণ্যার্জনের অফুরান ইচ্ছা। এই ইচ্ছা যখন সরল পথে মেটে না, তখনই অপরাধমূলক প্রক্রিয়ায় পাওয়ার দিকে ছোটে অনেকে। কিশোর-তরুণেরা যে বেশি হারে অপরাধে জড়াচ্ছে, এমনকি সচ্ছল ও ধনীর দুলাল-দুলালিরাও যে বিভিন্ন রকম অপরাধে শামিল হচ্ছে, তার একটা কারণ এই বিচার-বিবেচনাহীন পণ্যবাসনা। এ কারণেই বলা হচ্ছে, কনজিউমারিজমের সঙ্গে অপরাধ বিস্তারের সম্পর্কটা সমানুপাতিক; একটি বাড়লে অন্যটাও বাড়বে।
দুর্নীতির সঙ্গেও এর যোগাযোগটা ঘনিষ্ঠই বটে। বৈধ আয়ের মাধ্যমে বিলাসী পণ্যের চাহিদা মেটানো বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞাপন হাতছানি দিচ্ছে, প্রতিবেশীর কেনাকাটায় চোখ টাটাচ্ছে, দোকানের কাচের শোকেসে সাজানো সামগ্রীগুলো মনে এমন বিরহ ভাব জাগাচ্ছে, এমন হীনম্মন্য করে তুলছে যে এত সব ভোগান্তি এড়াতে একটা ঘুষ নেয়া বা একটা দুর্নীতির সহায় তো হওয়াই যায়, তাই না? এবং একবার কিনলে যেমন বারেবারে কিনতে হয়, তেমনি একবার বেপথে গেলে সে পথেই থাকতে হয়। অপরাধের বিস্তারের সঙ্গে যেমন থানা-পুলিশের সংখ্যা ও কালাকানুনও বাড়ে; তেমনি করেই দুর্নীতির বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে শপিং মল ও ক্রেতার সংখ্যা। বেশি শপিং মল করলে যেমন দুর্নীতি কমবে না, তেমনি পুলিশি ব্যবস্থা দিয়ে বা তরুণদের ‘অপরাধী প্রজন্ম’ ভাবার মধ্য দিয়েও সমাধান আসবে না। পণ্য ও ভোগের রাডারহীন এই যাত্রাকে তাই সংযত করতেই হবে।
স্প্যানিশ দার্শনিক দেকার্তে বলেছিলেন, ‘আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি’, অর্থাৎ চিন্তাশীলতাই মানুষের অস্তিত্বের মূল। শিল্পবিপ্লব-যুগের প্রধান বাণী ছিল, ‘আমি উৎপাদন করি, তাই আমি আছি।’ আফ্রিকার একটি লোকপ্রবাদ বলে অন্য কথা, ‘সবাই আছে বলেই আমি আছি।’ কনজিউমারিজম বলে: যতক্ষণ কিনছো, ততক্ষণ তুমি আছো। এরই উল্টোপিঠে ব্যর্থ ক্রেতারাও পণ্যের জন্য খুন করে বা পণ্য ছিনতাই করে জানিয়ে দিচ্ছে, তারাও আছে।
এখন আর আমি কিছু বলি না, আমার হয়ে কথা বলে আমার পোশাক, আমার মোবাইল ফোন, আমার সানগ্লাস, আমার ইলেকট্রনিক গেজেট। আমার ব্র্যান্ডই আমি। আমাদের বলা হচ্ছে, বেছে নেওয়ার বিপুল স্বাধীনতা তোমার। কিন্তু দিনশেষে দেখছি, পণ্যভোগের নেশার বাইরে যাওয়া কত কঠিন। এর খাতিরে দু-একটা খুন-খারাবি বা ছিনতাই বা দুর্নীতি করতেও পরোয়া নেই। কিন্তু চিন্তার ক্ষমতার জোরে নয়, কর্মের আত্মবিশ্বাসে নয়, সামাজিকতার শক্তিতে নয়, যে নিজেকে চেনে ভোগের ক্ষুধা দিয়ে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে ফিরে পেতে তাকে তাই ফিরতে হবে মানুষের কাছে, সম্পর্কের কাছে, বন্ধুত্বের কাছে, প্রকৃতির কাছে। তাকে বিশ্বাস করতে হবে, যা কেনা যায় না, তা-ই সবচেয়ে মূল্যবান।
ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোনের জন্য যারা খুন করেছে, তাদের শাস্তি হোক। কিন্তু পণ্যপূজার এই সংস্কৃতিও যেন দায়মুক্তি না পায়।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:০৪