অনেক আগে যখন রাশিয়ায় জারের শাষন চলছিলো তখন রাশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাইমন নামে এক ভীষন দরিদ্র মুচি বাস করত। একটা উদাহরন দিলেই বোজা যাবে সাইমন কি রকম গরীব ছিল, তার ছিল মাত্র একটা ওভারকোট। সাইমনের বউ যখন ঝরনায় পানি আনতে যেত তখন সে ওভারকোটটি পরে যেত, আবার সাইমন যখন জুতা সেলাইয়ের পাওনা টাকা আদায়ে যেত তখন ওই একই ওভার কোট পরে যেত এত গরীব ছিল তারা।
যাই হোক এক দিন, সাইমনের ঘরে প্রায় কিছু নেই, তাই সাইমনের বউ জোর করে সাইমনকে জুতা সেলাই বাবদ পাওনা আদায় করতে পাঠাল। অনেক রুবল পাওনা হয়েছিল। ধারে জুতা বানানোর সময় বানাবে কিন্তু তারপর আর টাকা দেবার নাম নেই। কত রুবল আদায় হবে আর তার থেকে কত রুবলের ময়দা কিনবে, কত রুবলের সব্জি কিনবে আর কি কি কিনবে তার ফর্দ করে দিল মুচি সাইমনের বউ। বের হবার সময় বউ বলে দিল “সব কিনে বেলাবেলি যেন বাড়ি ফিরে আসে।”
সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ল সাইমন।
তারপর?
তারপর যা হয়, যার যত টাকা সে তত বেশী ঘোরায়।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে সাইমন প্রাপ্য টাকার অতি অল্পই আদায় করতে পারল। মনের দুঃখে সেই সামান্য টাকা নিয়ে শুড়িখানায় গিয়ে সাইমন ভদকা খেয়ে মাতাল হয়ে গেল। সব দেশের গরীবেরই একই হাল। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছিলো, বরফ পড়তে শুরু করছিলো। সাইমনও ওভার কোটের কলার টেনে সোজা করে ঘাড় ঢেকে সেটা কান অবধি তুলে টলতে টলতে গ্রামের দিকে রওনা দিল। ঘোর অন্ধকারে পা টেনে টেনে সাইমন বাড়ীর দিকে এগোচ্ছিল।
সাইমন দেখল সামনে একটা বাঁক। সেই বাঁক ঘুরতেই সে অবাক হয়ে গেল, পথের ওপর এক নগ্ন যুবক শুয়ে আছে তুষারপাতের মাঝে। তাকে দেখেই সাইমনের বুক ছাৎ করে উঠল, কেবা কারা তাকে খুন করে ফেলে রেখে গেছে। ঝামেলায় তাকে পড়তে হবে যদি পুলিশ এখন দেখে। সব দেশের পুলিশই তো সমান।
এই ভেবেই সে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু আবার ভাবল যদি মারা না গিয়ে থাকে তবে নির্ঘাৎ ঠান্ডায় মারা যাবে, দেখাই যাক মরে গেছে না বেচে আছে। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখল তখনো উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে এবং শরীর তখনো গরম আছে। তার মানে অতি অল্প ক্ষন আগে কেউ তাকে ফেলে গেছে। তার শরীরে কোন ক্ষত নেই।
ঝামেলা এড়িয়ে সাইমন আবারো চলে যাবার জন্য মনস্থ করল, কিন্তু ওর বিবেক বলল, এখন যদি এই মানুষ টাকে ঠান্ডায় ফেলে যায় তবে নিশ্চয়ই মরে যাবে। ওদিকে খালি হাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরছে। বাড়িতে নিজেদের খাবারই নেই, তার ওপর বাড়তি বোঝা এই উলঙ্গ মানুষটি। নিশ্চয়ই স্ত্রী তুলকালাম কান্ড ঘটাবে। এত সব ভেবেও সাইমন মানুষটিকে ফেলে রেখে যেতে পারল না। তাকে হাত ধরে টেনে তুলল। তুলতেই মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত হাসি দিল।
লোকটার দু চোখে তখন ঘোর লাগা দৃষ্টি। সাইমন তার গায়ে শতছিন্ন কোটটি পড়িয়ে দিল। তার পর লোকটিকে নিজের কাধে ভর দিয়ে সাহায্য করে গ্রামের দিকে এগোল।
“তোমার নাম কি?” সাইমন জিজ্ঞেস করল। লোকটি নিরুত্তর।
“তোমার বাড়ী কোথায়?” লোকটি তখনো নিরুত্তর।
“তোমার পেশা কি?” কোন জবাব নেই।
লোকটি কি তবে বোবা? সাইমন ভাবল। ভারী বিপদেই পড়া গেল।
বাড়ীতেই আসতেই স্ত্রীর শত লাঞ্চনার মধ্যে লোকটি বসার আর খাবার ঘরে দু হাটুর মধ্যে মাথা গুজে বসে রইল। বাড়ীতে ময়দা যেটুকু ছিল, তা দিয়ে সাইমনের স্ত্রী রুটি আর বাধাকপি দিয়ে একটা স্যুপ রেধে সাইমন, সন্তান এবং আগন্তুককে খেতে ডাকল।
সেই প্রথমবার আগন্তুক দু হাটু দিয়ে মাথা তুলে সাইমনের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একবার হাসল। তারপর খেতে আসল।
পরদিন সাইমন লোকটাকে জুতা সেলাই শিখিয়ে দিলে। সাইমন আশ্চর্য্য হয়ে দেখল সে পাকা মুচির মত খুব অল্পতেই সব শিখে নিল। সাইমন ভাবল, বাহ বেশতো, এখন থেকে সে বাড়ী বাড়ী ঘুরে অর্ডার নেবে আর লোকটা জুতা সেলাই করবে।
দেখতে দেখতে সাইমনের জুতার কদর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল, তার অবস্থাও ফিরে গেল। সাইমন এখন স্বচ্ছ্বল। কিন্তু সব থেকে আশ্চর্য্য ব্যাপার মানুষটা কারো সাথে কথা বলে না এক মনে ঘাড় গুজে কাজ করে যায় আর দুবেলা খাবার খেয়ে যায়। নির্বাক লোকটি কাজ, খাওয়া আর ঘুম এই করেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছে।
এক দিন সকালবেলা জারের একজন কর্মচারী এক দুস্প্রাপ্য হরিনের চামড়া দিয়ে বলে গেল তার জন্য যেন শিকারের একটা বুট তৈরী করে। যদি ঠিক মত না হয় তবে কেউ তার হান্টারের বাড়ি থেকে রেহাই পাবে না।
যখন রাজ পরিবারের কর্মচারী এই সব বলছিলো তখন মাথা নীচু আগন্তুক মুখ ওপরে তুলে সেই প্রভাবশালী কর্মচারীর দিক তাকিয়ে একটু হেসে দিল।
যেদিন বুট ডেলিভারি দেবার কথা সেদিন সাইমন দেখল আগন্তুক বুট না বানিয়ে এক জোড়া চটি বানিয়ে দিয়েছে। সাইমনের হায় হায় করে উঠল। নিজের ঘাড় বাচানো নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়ল। এমন সময় ঝুম ঝুম করে ঘন্টি বাজিয়ে সেই কর্মচারীর ঘোড়ার গাড়ি হাজির। রাজ কর্মচারীর চাকর গাড়ী থেকে নেমে দৌড়ে এসে বলল, তার প্রভু মারা গেছে, বুট লাগবে না, চটি বানিয়ে দিতে হবে কফিন পরে শোবার জন্য।
সাইমন তখন চটি জোড়া বের করে সেই রাজপুরুষের চাকরের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর আশ্চর্য্য চোখে চেয়ে রইল আগন্তুকের দিকে। মানুষটি তখনো মাথা নীচু করে কাজ করে যাচ্ছিল।
আরো অনেকদিন পর সাইমন তখন রীতিমত কেউকেটা। অনেক ধনী। এমন সময় এক মহিলা ফুট ফুটে দুটো জময বাচ্চাকে নিয়ে সাইমনের দোকানে আসল জুতা সেলাইয়ের জন্য। তার মাঝে একটা মেয়ে একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটে। সাইমনের স্ত্রী জিজ্ঞাস করলেন, “ওর পায়ে কি হয়েছে?”
“ও জন্মাবার সময় ওর জন্মদাত্রী মা গড়িয়ে ওর ওপর উঠে যাওয়ায় ওর পা ভেঙ্গে যায়।” মেয়ে দুটোর মা জবাব দিল।
“সে কি আপনি ওদের মা নন?” সাইমনের স্ত্রী জিজ্ঞাস করলেন।
“না, তবে আমি ওদের মা ই হয়ে গেছি, ওরাই আমার সব।”
“কি ব্যাপার একটু খুলে বলুন তো আমার বেশ কৌতুহল হচ্ছে” সাইমনের স্ত্রী বললেন।
“আমরা খুব গরীব ছিলাম” বাচ্চা দুটোর পালক মা বলতে লাগল “আমাদের গ্রামে আমাদের থেকেও এক গরীব কাঠুরে ছিল, সেই কাঠুরে গাছ কাটতে গিয়ে গাছের নীচে চাপা পড়ে মারা যায়। আর সেই রাতেই কাঠুরের স্ত্রী প্রসব যন্ত্রনায় বেদনায় ছটফট করতে করতে দুটো যমজ কন্যা জন্ম দেয়। প্রসবকালে ছটফট করতে করতে মৃতপ্রায় কাঠুরের স্ত্রী একটা নব জাতকের পায়ের ওপর উঠে যাওয়ায় সে পা খোড়া হয়ে যায় এবং ওদের মা মারা যায়।”
“তারপর” সাইমনের স্ত্রী আবার জানতে চায়
“তারপর আর কি” মহিলা আবার বলল “ আমার কয়দিন আগে একটা কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ায় আমার বুকে দুধ ছিল তাই গ্রাম বাসী সালিশী করে মেয়ে দুটোকে আমার কাছে রাখে যেন আমি ওদের আমার মেয়েদের সাথে বড় করতে পারি। আমি তাই করছিলাম, কিন্তু কিছুদিনের মাঝে আমার নিজের সন্তান মারা গেলে ওরাই আমার মেয়ে হয়ে যায়।”
“ইতিমধ্যে আমার স্বামী ব্যাবসায়ে উন্নতি করছে, আমাদের অবস্থাও ফিরে গেল” মহিলা বলেই চলল “মেয়েরাও স্বচ্ছ্বলতার মাঝে বড় হতে লাগল। আজকে ঈশ্বরের দয়াতে আমাদের যেমন কোন অভাব নেই, এদেরো নেই। আমার মেয়েরা যেমন খুশী মা পেয়ে আমিও খুশী দুই মেয়ে পেয়ে”
ভদ্রমহিলা যখন এই গল্প বলছিলো, সাইমনের সেই আগন্তুক জুতা সেলাইকারী মুখ তুলে আবারো হাসল। ভদ্রমহিলা যখন মেয়েদের জুতার মাপ দিয়ে চলে গেল, এইবার সাইমন, আগন্তুককে চেপে ধরল বলল, “আজ তোমাকে বলতেই হবে তুমি কে? কি তোমার পরিচয়?”
লোকটা মাথা উচু করে সাইমনের দিকে তাকিয়ে এক স্বর্গীয় হাসিতে চারিদিক ভরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি বলব, সবই বলব, কারন আজকে আমার শিক্ষাশেষ হয়েছে আমার ফিরে যাবার সময় হয়েছে।”
অবাক সাইমন এবং তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল “কি শিক্ষা?”
এইবার অগন্তুক নিস্কম্প গলাতে বলতে লাগল, “আমি ছিলাম যমদুত। এক ঝড় বৃষ্টির রাতে ঈশ্বর একদিন আমাকে একটি আত্মা আনতে পৃথিবীতে পাঠাল, পৃথিবীতে যেন তখন যেন প্রলয় নাচন হচ্ছে, সেদিন সকালেই আমার এক সহকর্মী তার কাঠুরে স্বামীর আত্মা নিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। সেই দুর্যোগের মাঝে আমি উপস্থিত হয়ে দেখলাম যে, সেই নারী সদ্য দুটো যমজ কন্যা সন্তান প্রসব করছে, আমি ভাবলাম আমি যদি এখন এই নারীর জীবন নিয়ে যাই তবে সদ্যজাত সন্তান দুটোর কি হবে? তাদের মৃত্যুও অনিবার্য। আমার মন বিদ্রোহ করে উঠল। ঠিক করলাম আমার দ্ধারা এই নিষ্ঠুর কাজ হবে না, সব জেনে শুনে আমি এত নিষ্ঠুর হতে পারব না। আমি স্বর্গে ফিরে গেলাম
ঈশ্বর বললেন, “প্রান এনেছ?”
আমি বললাম, “না, পারিনি এত নিষ্ঠুর হতে, আমি যদি ওই নারীর প্রান নিয়ে যাই তবে বাচ্চা দুটোর কি হবে?”
ঈশ্বর বললেন, “তুমি একটু বেশী বুঝেছ। তোমার শিক্ষা এখনো সম্পূর্ন হয় নি” এই বলে তিনি আমরা পাখা কেটে দিলেন। এবং আর একজন যম দুত কে পাঠালেন ওই নারীর জীবন নিয়ে আসার জন্য।
সাইমন বলল, “তারপর?”
“তারপর সেই ডানাকাটা অবস্থাতে আমি পৃথিবীতে যেখানে পড়েছিলাম, সেখানে আপনি আমাকে দেখতে পান, প্রচন্ড তুষারপাতে আমি মৃতপ্রায়। আপনি যদি সেখানে না আসতেন তবে হয়ত আমি সেই ভয়ঙ্কর তুষারপাতে সেখানে মরে থাকতাম মরা পাখির মত। আমি ভেবছিলাম ঈশ্বর বোধ হয় আমার মৃত্যুদন্ডই দিয়েছেন তার অমান্যতার শাস্তি স্বরূপ” দেবদুত বলতে থাকে “আপনার তেমন গরম পোষাক না থাকার পরো অত্যান্ত গরীব থাকার পরও আপনি চলে গিয়েও যেতে পারেন নি”
“আমাকে হাত ধরে টেনে তুললেন”
“আপনি তখন হাসছিলেন কেন?” সাইমন জিজ্ঞাস করে
“হাসলাম এই কারনে যে ঈশ্বর মানুষকে সহমর্মিতা দিয়েছে। সে হাসি সেই সহমর্মিতা আবিস্কারের হাসি, ঈশ্বরের ক্রিয়াকান্ড বোঝার ক্ষমতা আমার নেই সে কথা হৃদয়ঙ্গম করার হাসি” দেব দুত আবারো পবিত্র হাসি দিল।
“আমার স্ত্রী যখন আপনাকে খেতে দিয়েছিল তখন কেন হেসেছিলেন?” সাইমন আবারো জিজ্ঞাস করল।
“খাবারের অভাব থাকা সত্ত্বেও আপনার স্ত্রী আমাকে খাবার দিয়েছিল, সেই মুহুর্তে আমি বুঝেছিলাম ঈশ্বর মানুষকে মমতা দিয়েছে, সেটা উপলদ্ধি করে আমি হেসেছিলাম” দেবদুতের চোখ দুটো মমতায় আর্দ্র হয়ে উঠল।
“জারের রাজ পুরুষ যখন হান্টার নেড়ে কথা বলছিলো তখন আপনি হেসেছিলেন কেন?” সাইমন বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল।
“কারন আমি দেখছিলাম জারের রাজপুরুষের পেছনে আমার সহকর্মী দাঁড়িয়ে আছে তার জীবন নেবার জন্য। আমি জানতাম বুট জুতা তার পায়ে ঊঠবে না তার লাগবে কফিনে শোবার জন্য এক জোড়া চটি”
তারপর কিছুক্ষন চুপ থেকে দেবদুত বললেন, “সেই মুহুর্তে আমি বুজতে পারাছিলাম যে ঈশ্বর মানুষকে অনেক কিছু দিয়েছেন, কিন্তু জানতে দেন নি পরমুহুর্তে কি ঘটবে। জানতে দেন নি মৃত্যু এসে কখন তাকে উঠিয়ে নেবে। মানুষের সব জ্ঞান বুদ্ধি এই ক্ষেত্রে বিফল। তাই সেই মুর্খ রাজ পুরুষের ঔদ্ধত্য দেখে হেসেছিলাম, ঈশ্বর কেন কি করেন, কখন করেন তা শুধু তিনিই জানেন। আমার শিক্ষা সম্পূর্ন হয়েছে। আমার বিদায় নেবার সময় হয়েছে।” এই বলতে বলতে সাইমনের ঘরের ছাদ ফাক হয়ে গেল এবং দেব দুত সেই ফাক দিয়ে এক ঝলক আলোর মত উর্ধ্বলোকে মিলিয়ে গেল।
(লিও তলস্তয়ের এই লেখা পড়ার সময় মনে রাখবেন এই মানুষটাই ওয়ার এ্যান্ড পীস লিখছেন। আর কিছু বলার নেই। শুধু আছে ভাবনার)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০২০ রাত ৮:৫৪