জন্ম ১৯০৪ সালের ২২ শে এপ্রিল। নিউইয়র্ক শহরে। বাবা জুলিয়াস ওপেনহাইমার ১৮৮৮ সালে জার্মানি থেকে নিউইয়র্ক শহরে পাড়ি জমান ১৭ বছর বয়সে এবং সেখানেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। জুলিয়াস বিয়ে করেন এলা ফ্রিডম্যানকে, জুলিয়াসের মতই জার্মান ইহুদি উদ্ধাস্তু। ১৯০৪ সালে তাদের ঘর আলো করে রবার্ট ওপেনহাইমার নামে পুত্র সন্তান। এর আট বছর পর তাদের আর এক পুত্র সন্তান জন্ম নেয় নাম ফ্রাংক। স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে জুলিয়াস এবং এলার সুখের সংসার। ছোট বেলায় রবার্টকে পড়তে পাঠান এথিকাল কালচার স্কুলে যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ফেলিক্স এ্যাডলার। ফেলিক্স জন্মসুত্রে ইহুদি হলেও গোড়া ধর্মচিন্তা থেকে দূরে ছিলেন। তিনি ডারউইনের বিবর্তনবাদের এক জন সমর্থক ছিলেন। এ্যাডলার বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কারের ফলে ধর্ম বিশ্বাসও পরিবর্তিত হতে হবে। ছাত্রদের এক শোষনহীন সাম্যবাদী সমাজ ব্যাবস্থার স্বপ্ন দেখাতেন এ্যাডলার। এহেন শিক্ষা ব্যাবস্থার আদর্শ নিয়ে রবার্ট ওপেনহাইমার বড় হচ্ছিলেন।
ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরি
এ্যাটম বোমার জনক হিসাবে ওপেনহাইমারের পরিচয়টা এত জোরালো হয়ে গেছে তার আড়ালে তিনি যে একজন প্রথম শ্রেনীর তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ছিলেন সেটা এখন প্রায় কেউই জানে না। সে আমলের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মত ওপেনহাইমারের গবেষনায় প্রবেশ ফিজিক্স দিয়ে নয়, কেমিষ্ট্রি দিয়ে। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ওপেনহাইমার প্রথমে যার কাছে রসায়নে পাঠ নেন তার নাম পার্সি ব্রিজম্যান। তার বিষয় ছিল প্রচন্ড চাপে পদার্থের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে? ওপেনহাইমারের ইচ্ছা ছিল স্নাতকোত্তর পর্বে গবেষনা করবেন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে আর্নেষ্ট রাদারফোর্ডের কাছে। কিন্তু রাদারফোর্ড তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর তিনি যান ক্যাভেন্ডিশের আর এক অধ্যাপক জন টমসনের কাছে। এখানে কাজ করতে গিয়ে তিনি ইউরোপের প্রায় সব বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সাথে পরিচিত হন নীলস বোর, ষ্টুয়ার্ট ব্লাকেট, মরিস ডিরাক, ম্যাক্স বর্ন, র্যালফ ফাওলার সহ আরো অনেকের। এরা বিভিন্ন সময় ক্যাভেন্ডিশে ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে আসেন। এ পর্যায়ে ম্যাক্স বর্নের বেশ পছন্দ হয়ে যায় উঠতি গবেষক ওপেনহাইমারকে। তিনি তার গবেষনাগার গর্টিংজেনে পি এইচ ডির সুবিধা করে দেন রবার্টকে। সময় ১৯২৬ সাল।
ওই সময়টা কিন্তু অত্যান্ত উল্লেখ্যযোগ্য, কারন অনু পরমানুর অন্দর মহল আবিস্কার করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করছিলেন বিজ্ঞানের বিচিত্র সব নিয়ম কানুন। যেমন কোয়ান্টাম মেকানিক্স, যার প্রতিপাদ্য আমাদের বাস্তব জীবন থেকে এতটাই আলাদা যে সত্যি বলে মানতে কষ্ট হয়। ওপেনহাইমারের মত তরুন বিজ্ঞানীদের হাত ধরে বিজ্ঞানের জয় যাত্রা এগিয়ে যাচ্ছিল। পরমানুর ঘোরটেপের মাঝে কিভাবে ইলেকট্রন পালায় তা দেখালেন ওপেনহাইমার, আবার ইলেক্ট্রনের পাল্টা কনা পজিট্রন এর অস্তিত্ব যে সম্ভব তা অনুমানের খুব কাছাকাছি চলে গেলেন ওপেনহাইমার তবে শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারে সাফল্যের মালা ডিরাকের গলায়। আরো একটা ব্যাপারে ওপেনহাইমারের অবদান বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন, অতিকায় ভারী নক্ষত্রগুলো যে মৃত্যুর পর যে ব্লাক হোল হয়ে যাবে সে ব্যাপারে প্রথম উচ্চারন কিন্তু এই বিজ্ঞানীই করেছিলেন এভাবে “অতিকায় দানব, যার থাবা এড়িয়ে পালাতে পারবে না আলোও”।
ফিশন বা পরমানু বিভাজন পদার্থবিদ্যা গবেষনার এক মাইল ফলক। এই পরমানু বিভাজন আবিস্কারের আগে বিজ্ঞানীদের মাঝে কোন দেশের সীমারেখা ছিলনা, সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন তাত্ত্বিক আলোচনার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক আবিস্কারগুলো শেয়ার করত কিন্তু ফিশন আবিস্কারের পর মুহুর্তে সব চেঞ্জ হয়ে গেল। কি সে আবিস্কার যা বিজ্ঞানকে রাজনৈতিক বিভাজন এনে দিল? এ প্রশ্নের জবাব কিছুটা দীর্ঘ কিন্তু সংক্ষিপ্ত হলেও কিছুটা আলোচনার দাবী রাখে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা-র রেডিয়াম ইনিষ্টিটিউট, ২৫০ মিলিগ্রাম তেজস্ক্রিয় মৌল রেডিয়াম ধার দিয়েছিল ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজের অধ্যাপক রাদারফোর্ডকে। যুদ্ধের পর, পরীক্ষার কাজ শেষ হলে রাদারফোর্ড সেই রেডিয়াম ফেরত দিতে চান অষ্ট্রিয়াকে। ভিয়েনা থেকে জানানো হয় ফেরত দেবার দরকার নাই কারন তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং সবার স্বার্থে গবেষনা করছেন। আশ্চর্য্যের ব্যাপারটা এখানেই, এর মাঝেই অষ্ট্রিয়া আর ইংল্যান্ডের মাঝে বিরাট যুদ্ধ হয়ে গেছে। পদার্থবিদ্যায় রাদারফোর্ডের বড় আবিস্কার ১৯১০ সালে। যার মুল প্রতিপাদ্য হল পরমানুর প্রায় সমস্ত ভরটাই তার কেন্দ্রে অর্থ্যাৎ নিউক্লিয়াসে।
বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আইনষ্টাইন
ততদিনে আইনষ্টাইনের বিখ্যাত সমীকরন E= mc² আবিস্কার হয়ে গেছে। জানা গেছে পদার্থের ভর (m) আর এনার্জি (E) আসলে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। জিনিস একই শুধু রূপান্তর। যেমন কাঠ পোড়ালে কয়লা হয়। ফলে ভর কে বদলানো যায় এনার্জিতে অথবা এনার্জিকে বদলানো যায় ভরে। কি পরিমান ভর থেকে কি পরিমান এনার্জি পাওয়া যাবে তাও বলে দিয়েছে আইনষ্টাইনের ওই সুত্র। সমীকরনে c হল আলোর বেগ। অর্থ্যাৎ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। এর আবার বর্গ। মানে ৯ এর পর দশটা শুন্য দিলে যা দাড়ায় তাই। ৯০,০০০,০০০,০০০। এখানে একটা ব্যাপার খুব পরিস্কার সামান্য পরিমান ভরকে এনার্জিতে পরিনত করতে পারলে বিশাল পরিমান এনার্জি পাওয়া যাবে। এনার্জি মানে শক্তি। তাহলে কি হল? কোন পরমানুর ভরকে (m) এনার্জি (E) মানে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারলে মিলবে এ্যাটম বোমা। সাইন্সফিকশান লেখক এইচ জি ওয়েলস ১৯১৪ সালে প্রকাশিত তার “দ্য ওয়ার্ল্ড সেট ফ্রি” উপন্যাসে আনলেন এ্যাটম বোমার প্রসঙ্গ। সে গল্পে দুই শহরের মধ্যে যুদ্ধে এ্যাটম বোমা ব্যাবহৃত হয়েছে।
পরমানুর ভর খরচ করে এনার্জি মিলতে পারে কিন্তু সে তো তত্ত্বকথায়, কিন্তু বাস্তবে কিভাবে পাবে? সে আর এক ইতিহাস ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস চ্যাডউইক পরমানুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন আবিস্কার করেন উজ্জ্বল হয় বোমা তৈরীর সম্ভাবনা। কিভাবে? একটা পরমানুতে থাকে ইলেকট্রন, প্রোটন এবং নিউট্রন। এখানে নিউট্রন কনা নিউট্রাল ( অর্থ্যাৎ এদের ভর আছে কিন্তু চার্জ নাই, নামটাও এখান থেকে দেয়া)। প্রোটন ভর আছে কিন্তু পজিটিভ চার্জ বিশিষ্ট। আর ইলেকট্রন ভর আছে কিন্তু নেগেটিভ চার্জ বিশিষ্ট। নিউট্রনে চার্জ না থাকায় কি সুবিধা? সুবিধা এই যে প্রোটন এবং ইলেকট্রনে চার্জ থাকায় তা সরাসরি ছুটতে পারে না, একের প্রভাবে অন্যের গতিপথ বেকে যায়। চুম্বকের মত চার্জের বেলায়ও আকর্ষন, বিকর্ষন ঘটে। যেহেতু নিউট্রনের ভর আছে কিন্তু চার্জ নেই তাই সে কোন পরমানুকে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলতে পারে (ব্যাপারটার সহজ ব্যাখ্যা দিলাম, কিন্তু মুল ব্যাপারটা আরো জটিল)। এদিকে পজিটিভ চার্জ বিশিষ্ট প্রোটন আর চার্জ হীন নিউট্রনের ভর কিন্তু সমান কিন্তু এদের তুলনায় নেগেটিভ চার্জ বিশিষ্ট ইলেকট্রনের ভর অনেক কম। এই যে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে পরমানু ভেঙ্গে ফেলার প্রক্রিয়া একেই বলে ফিশন।
এই ফিশন আবার পরমানু বোমা তৈরীতে কোন থিওরীতে কাজে লাগে? দেখা যায় যে সব পরমানু বেশী ভারী (অর্থ্যাৎ যাদের প্রোটন, ইলেকট্রন, নিউট্রন অনেক গুলো) তাদের বিভাজন ঘটলে যে টুকরা পাওয়া যায় তাদের মোট ভর মুল পরমানুর ভরের চেয়ে কম। তার মানে মুল পরমানুর ভর এবং টুকরাগুলোর ভরের কিছু গড় মিল হচ্ছে। টুকরা হয়ে গেলে কিছু ভর হারিয়ে যাচ্ছে! বিজ্ঞানের নিয়মে তা তো হতে পারে না। ঠিক এটাই ফিশন এর মুল কথা। হারিয়ে যাওয়া বাড়তি ওই ভরটুকু আসলে আইনষ্টাইনের সুত্র মেনে এনার্জিতে পরিনত হচ্ছে। এ্যাটম বোমার ধাক্কা বা শক্তি আসলে ওই ফিশন প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যাওয়া ভর থেকে পাওয়া এনার্জি!!
নিউট্রন কনার সাহায্যে পরমানুর বিভাজনে প্রথম সাফল্য আসে ১৯৩৮ সালে বার্লিনে অটোহ্যান এবং ফ্রিৎজ ষ্ট্রাসম্যানের গবেষনাগারে। ওই জার্মান বিজ্ঞানী নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়াম মৌলের পরমানুকে আঘাত করছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল নিজেদের পরীক্ষার ফলাফলের গুরুত্ব তারা বুজতে পারে নি। বাস্তবে যে তারা পরমানু বিভাজন ঘটিয়েছেন এর ব্যাখ্যা দেন অটোহান এর প্রাক্তন সহকর্মী লিজে মিৎনার এবং তার ভাইপো অটো ফ্রিৎশ। ওদের ব্যাখ্যায় আর একটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার জানা যায়, ফিশন থেকে এনার্জি পেতে হলে শুধু একটা পরমানু বিভাজন ঘটালেই হবে না দরকার হবে অনেক অনেক বিভাজন মানে অনেক অনে নিউট্রন। কোথা থেকে আসবে এই নিউট্রন? এই সমস্যার সমাধানও নিহিত ছিল ফিশনে। কোন নিউট্রন কনা যখন কোন ইউরেনিয়াম পরমানুকে আঘাত করে তখন তার নিউক্লিয়াস থেকে নতুন কিছু নিউট্রন বের হয়, যা আবার নতুন পরমানুকে আঘাত করে, মানে যত পরমানুকে আঘাত করছে অটোমেটিক ভাবে আরো নিউট্রন বের হয়ে আরো নতুন পরমানুকে আঘাত করছে। মানে প্রতি বিভাজনে নতুন নিউট্রন আর নতুন নিউট্রন মানে নতুন বিভাজন। এভাবেই এগিয়ে যায় ফিশন বিক্রিয়া। তৈরী হয় ভয়াবহ এনার্জি। এটাই এ্যাটম বোমার বিধ্বংসী ক্ষমতার মুল উৎস।
তত্ত্ব এই সব বললেও বাস্তবে কিন্তু তখনো ব্যাপারটা অনেক কঠিন ছিল। কতটা কঠিন ছিল? আইনষ্টাইনের মত বিজ্ঞানী এ্যাটম বোমা বানানো নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “যে জঙ্গলে পাখি কম, অন্ধকারে সে জঙ্গলে পাখি শিকার যতখানি সম্ভাবনা থাকে ঠিক ততটা।” আইনষ্টাইন এমনটা ভাবলেও গবেষনা কিন্তু থেকে থাকে নি। হান এবং ষ্ট্র্যাসের সাফল্যের পর বিজ্ঞান যেন হারিয়ে ফেলল তার আন্তর্জাতিক চরিত্র। খোলামেলা, বিভিন্ন ধরনের সহায়তার আন্তর্জাতিক মানসিকতা যেন উবে গেল গবেষনাগার গুলো থেকে। সেখানে চলে গোপনীয়তা এবং অন্ধ দেশ ভক্তি। সোজা ভাষায় বিজ্ঞান চলে আসল রাজনীতির কুটিল অন্ধকার রাজার অধীনে। ওদিকে ইউরোপ এবং আমেরিকার বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করলেন জার্মানির বিজ্ঞানীরা পরমানু সংক্রান্ত কোন গবেষনা ছাপাচ্ছেন না কোন বিজ্ঞান জার্নালে। ওদিকে হিটলারের তখন জয় জয়কার সময় ১৯৩৯ সাল। জার্মানির দখলে থাকে চেকশ্লোভাকিয়ার খনি থেকে ইউরোনিয়াম বিক্রি তখন বন্ধ। বিপদের গন্ধ পেয়ে আইনষ্টাইনের কাছে ছুটে আসলেন তিন বিজ্ঞানী লিও ঝালার্ড, ইউজিন উইগনার এবং এডোয়ার্ড টেলার। হাংগেরিয়ান ইহুদি সবাই। ওরাও হিটলারের ইহুদী নিধনের ভয়ে ইউরোপ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় এসেছিলেন।
ওপেনহাইমার এবং জেনারেল গ্রোভস
একটি নয় দুটি চিঠি লেখেন আইনষ্টাইন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে ২ রা আগষ্ট ১৯৩৯ সালে এবং ৭ ই মার্চ ১৯৪০ সালে। না শুধু আইনষ্টাইনের চিঠিতেই বোমা বানানোতে উদ্যেগী হননি রুজভেল্ট তবে নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়েছিলেন, সেরা বিজ্ঞানীর চিঠি দ্ধারা। বিজ্ঞানীদের নয় বোমা তৈরীর নির্দেশ দেন সেনাবাহিনীকে কারন একাজে অনেক কিছুর সমন্বয়ের প্রয়োজন ছিল যুদ্ধকালীন দ্রুততায়। সেনাবাহিনী কর্তৃক তৈরী হয় “ম্যানহাটন ইঞ্জিনিয়ার ডিষ্ট্রিক্ট” যাকে সবাই “ম্যানহাটন প্রজেক্ট” নামেই চেনে। এর প্রধান হন জেনারেল লেসলি রিচার্ড গ্রোভস। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে তিনি বোমা তৈরীর প্রধান বিজ্ঞানী হিসাবে নিয়োগ দেন রবার্ট ওপেনহাইমার কে যা অনেককেই অবাক করছিল, কারন ওপেনহাইমার ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানী না। তবে জেনারেল গ্রোভস যে মূল্যায়নে ভুল করেন নি, তার প্রমান ওপেনহাইমার দিলেন অতি অল্প সময়ের মধ্যে বোমা তৈরী করে। ওপেনহাইমারের জায়গায় অন্য কাউকেও নির্বাচন করলে যে বোমা তৈরী হত না, তা না। হত, কিন্তু তাতে আরো সময় লাগত।
অপারেশান ট্রিনিটি
প্রানপন চেষ্টায় বোমা তৈরী হল। এইবার পরীক্ষার পালা। সেনা কর্মকর্তারা দিনক্ষণ আর স্থান ঠিক করেন। হোয়াইট হাউসে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এই মিশনের নাম দেয়া হয় ‘ট্রিনিটি’। তত দিনে অবশ্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে হ্যারল্ড ট্রুম্যান চলে এসেছেন। কড়া নিরাপত্তায় ‘গ্যাজেট’ নামক পারমাণবিক বোমাটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর আলামোগোরডো পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। বিজ্ঞানীগণ বেশ কয়েকবার সতর্কতার সাথে বোমাটি পরীক্ষা করে শেষ পর্যন্ত সবুজ সংকেত প্রেরণ করেন। সংকেত পাওয়ামাত্র নিরাপদ দূরত্ব থেকে পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে যেন পৃথিবী কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন মার্কিন সেনা কর্মকর্তা টি এফ ফ্যারেল। তিনি তার সুদীর্ঘ সামরিক জীবনে এর আগে কখনো এমন কিছু দেখেননি। সেদিনের বিস্ফোরণে পুরো মাঠ জুড়ে প্রায় ৩০০ মিটার দীর্ঘ একটি খাতের সৃষ্টি হয়। নিউ মেক্সিকোর সেই অন্ধকার খাতের দিকে তাকিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফ্যারেল বুঝতে পারেন, পৃথিবীর বুকে এক নতুন অভিশাপের আগমন ঘটেছে। সেই অভিশাপের হাত ধরে শুরু হয় এক নতুন যুগ, যার নাম ‘পারমাণবিক যুগ’।
ওদিকে পারমানবিক বোমার প্রলয় নাচন দেখে প্রধান বৈজ্ঞানিক ওপেনহাইমারের মনে পড়ে গেল কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের সামনে শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপের উপমা। “এখন আমি হলাম মৃত্যু, এই পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত ধ্বংসকারী”। ইনিই আবার হিরোশিমা নাগাশাকির ধ্বংসকান্ডের পর বনে যান অন্য মানুষ। ১৯৪৫ সালের ৬ ই আগষ্ট সকাল ৮ টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমার আকাশে “এনোলা গে” নামক বিমান থেকে মাটিতে ফেলা হয় “লিটল বয়” নামক এ্যাটম বোমাটি, তেতাল্লিশ সেকেন্ড পর হিরোশিমার আকাশে যখন বোমাটি বিস্ফোরিত হয় তখন তার দিকে তাকিয়ে ওই প্লেনের কো পাইলট রবার্ট লুইস মন্তব্য করেন, “মাই গড হোয়াট হ্যাভ উই ডান!” প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল ওপেনহাইমার, প্রায় ১৩ কিলোটন বলের সেই বিস্ফোরণে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারালো। হিরোশিমার পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লো। এর ফলে আরও ১০ হাজার মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লো।। এরপর ৯ আগস্ট ‘ফ্যাট ম্যান’ নামক দ্বিতীয় বোমাটি নিক্ষেপ করা হয় নাগাসাকি শহরে। হতভাগা নাগাসাকির বুকে নরকের অবতার হলো। প্রায় ৪০ হাজার মানুষের প্রাণহানি হলো। আগস্টের ১৪ তারিখ সম্রাট হিরোহিতো জাপানের পক্ষে আত্মসমর্পণ করেন। মাত্র দুটি পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতায় সমাপ্তি ঘটলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। নাগাসাকির ক্ষয়ক্ষতির বিবরন দেখে ওপেনহাইমারের মন্তব্য ছিলঃ “শত নীচতা, ব্যাঙ্গ কিংবা অতিকথনে যে সত্যটা ঢাকা যাবে না তাহল, পদার্থবিজ্ঞানীরা পাপের সন্ধান পেয়ে গিয়েছে। এই জ্ঞান থেকে তাদের আর মুক্তি নেই।”
যে মানুষটার হাত ধরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামক দানবকে পরাস্ত করতে তার থেকেও বড় দানব পারমানবিক বোমার আবির্ভাব হয়, যুদ্ধের পর সেই মানুষটি কিন্তু ভালো ছিল না। তাকে অভিযুক্ত হতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহী কম্যুনিষ্ট চর হিসাবে। যে মানুষটা ছিল সে সময়ের বিশ্বের সব থেকে গোপন প্রোজেক্টের সর্বেসর্বা সেই মানুষটিকেই এক সময় দাড়াতে হয় এটমিক এনার্জি কমিশনের পার্সোনাল সিক্যুউরিটি বোর্ডের সামনে। কেড়ে নেয়া হয় তার সব রকম সিক্যুউরিটি ক্লিয়ারেন্স। তবে সে আর এক গল্প, আর এক মহাদানব হাইড্রোজেন বোমার আবির্ভাবের সাথে সম্পৃক্ত। যদি চান তো সে গল্প অন্য আর এক দিন শোনাব।
নীচে দেখেন বিশ্বের প্রথম পারমানবিক বোমার পরীক্ষামুলক বিস্ফোরন, কোড নেম অপারেশান ট্রিনিটি
ছবিঃ অন্তর্জাল। সুত্রঃ অন্তর্জালের বিভিন্ন নিবন্ধ এবং পথিক গুহের সহস্র সুর্যের নীচে প্রবন্ধ
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১৭