বেচে থাকা না থাকা নিয়ে আইনষ্টাইনের এক রকম উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে শেষ বয়েসে। আশ্চর্য্যের ব্যাপার এই যে এই প্রজ্ঞার মুলেও কিন্তু সেই একই বিজ্ঞান চিন্তা। পদার্থবিদ্যা তাকে বুজিয়ে দিয়েছে সময় একটা মায়া মাত্র। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত এগুলো আসলে সাধারনের বিভ্রম। ১৯৫৫ সালের ১৫ই মার্চ মারা যায় তার প্রিয় বন্ধু মিশেল বেসো। মহাবিজ্ঞানী নিজের মৃত্যুর এক মাস আগে বিধবা মিসেস বেসোকে স্বান্ত্বনা জানিয়ে লিখলেন, “আমরা যারা বিশ্বাস করি ফিজিক্সে, তাদের কাছে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত যতই জোরদার হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত নেহাতই তা একটা মায়া।" আইনষ্টাইনের এই মন্তব্যে মাঝেও নিহিত আছে ফিজিক্সের এক চিরন্তন তত্ত্ব।
আমাদের মত সাধারন মানুষের কাছে, সময় যেন একটা নদীর স্রোতের মত। তা বয়ে চলার একটা নির্দিষ্ট দিক আছে। আমাদের জন্মের পর শৈশব, কৈশর, যৌবন, বার্ধক্য এবং সব শেষে মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা সাধারন মানুষ সময় নিয়ে একটা ধারনা মনের মাঝে লালন করে বেড়ে উঠি যা কাল থেকে কালান্তরে বদ্ধমুলভাবে আমাদের মনের মাঝে প্রোত্থিত। অথচ পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন সূত্রের দিকে তাকালে এই বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেতে বাধ্য। বোঝা যায় সময় জিনিসটা আমরা যেভাবে দেখি তা আসলে সে রকম কিছু না, তার থেকে অনেক রহস্যময় এবং জটিল।
একটা উদাহরন দিলে বোঝা যাবে, ধরা যাক কোন একটা দিক দিয়ে দেখলে দেখা যাবে চাঁদটা পৃথিবীর চারদিকে ঘড়ির কাটা যেদিকে ঘোরে সেদিকে ঘুরছে এবং ঘুরছে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র মেনে। এখন নিউটনের সূত্রের মাঝে কিন্তু এমন কিছু বলা নেই যে চাঁদটাকে পৃথিবীর চারিদিকে ঘড়ির কাটার দিকে ঘুরতে হবে। নিউটনের সুত্র মেনেই কিন্তু চাঁদটা ঘড়ির কাটার উল্টো দিকেও ঘুরতে পারত। তাতে কিন্তু নিউটনের সুত্রের কোন ব্যাঘাত ঘটত না। অর্থ্যাৎ পৃথিবীর এই উপগ্রহটা এখন যে দিকে আমরা আপাত দৃষ্টিতে সামনের দিক বলে ভাবছি সেদিকে না ঘুরে এর উল্টো মানে পেছনের দিকেও ছুটতে পারত যাতে বর্তমান বিজ্ঞানের নিয়মের কোন হের ফের হত না, কিন্তু চাদের ওই ঘড়ির কাটার বিপরীতে ছোটাতো সময়ের উল্টা দিকে হাটা হত বর্তমান ঘোরার সাপেক্ষে। মানেটা তাহলে দাড়াচ্ছে এই যে সময়ের গতিমুখ ভবিষ্যত থেকে বর্তমান সেখান থেকে অতীত হলেও বিজ্ঞানের কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হত না। মানে সময়ের আগে পরে বলে কোন কথা নেই।
যদিও আইনষ্টাইনের মৃত্যুর পর আবিস্কার হয়েছে কিছু পার্টিকেলের (কনার) ক্ষয়ের ব্যাপারে এই সুত্র খাটে না। ওখানে সময় একটা নির্দিষ্ট অভিমুখেই চলছে। কিন্তু গ্রহ নক্ষত্র চলাফেরায় সময় ব্যাপারটা আসলে বিদঘুটে, সেখানে সময়ের দিক থাকা না থাকা একটা অবান্তর। নিজের আয়ূস্কাল কে আইনষ্টাইন দেখছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের এই দৃষ্টিতে। যার কারনে মৃত্যুর আগ দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে না চেয়ে আইনষ্টাইন তার সেক্রেটারিকে হেলেন ডুকাশ কে বলছিলেন “আমি মরতে চাই ডাক্তারদের সাহায্য ছাড়া”।
মৃত্যু সম্পর্কে আইনষ্টাইন ছিলেন উদাসীন। প্রায় ক্ষেত্রেই মহাপুরুষরা এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিতেন। বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ জেমস ফ্রেজার তার “গোল্ডেন বাও” বইতে দীর্ঘ আলোচনা টানছেন ধর্ম এবং ম্যাজিক নিয়ে। এক বন্ধু একবার আইনষ্টাইনকে স্মরন করিয়ে দিলেন মৃত্যু নিয়ে সে বইর এক প্রতিপাদ্যে যাতে ফ্রেজার লিখেছিলেন প্রাগৈতিহাসিক যুগে ধর্মের উৎপত্তির মুলে ছিল মানুষের মৃত্যু ভয়। ফ্রেজারের ওই সিদ্ধান্তের কথা বলে বন্ধুটি মন্তব্য করেছিলেন “মৃত্যু ব্যাপারটা আসলেই একটা রহস্য।” এর জবাবে আইনষ্টাইন বলেছিলেন, “এবং একটা পরিত্রান।” মজার ব্যাপার হল বিজ্ঞান বলতে আমরা যেভাবে প্লেন, এসি, মাইক্রোওভেন, গাড়ী, ওষুধ, টিকা আবিস্কার বুজি তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞান বা আরো এ্যাডভান্স পদার্থ বিজ্ঞান কিন্তু আরো অনেক গভীর ভাবে বিজ্ঞানকে দেখে, যা সাধারন মানুষের বোধের বাইরে কিছু একটা চলে আসছে ধীরে ধীরে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স, প্যারালাল ইউনিভার্স, মিরর ওয়ার্ল্ড, ষ্ট্রিং থিওরী এগুলো কিন্তু স্রেফ কিছু আবিস্কার না তার থেকেও অনেক বড় কিছু (সমস্যা হল আমি নিজেও এগুলো প্রায় কিছুই বুজি না যে ব্যাখ্যা দেব, তবে যেটুকু বুজি তা সাধারন আবিস্কারের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না, অনেকটা উপলদ্ধির জগতকে ধাক্কা দেয়।)
আইনষ্টাইন নিজেও মনে হয় মহাবিশ্বের এই সব অশৈলী কান্ড কারখানা দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যেতেন! কিভাবে একটু আলোচনা করি সোজা সাপ্টা ভাবে। ১৯১৬ সালে আইনষ্টাইন যখন তার “জেনারেল থিওরী অভ রিলেটিভি” আবিস্কার করেন তখন তার সেই তত্ত্বের সমীকরনকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বিভিন্ন চরিত্র নির্নয়ে নেমে পড়েন। থিওরী অভ রিলেটিভি কি? পদার্থ, শুন্যস্থান এবং সময়কে এক সুত্রে বেধে ফেলার সুত্র। শুনলেই কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে, কোথায় ম্যাটার, কোথায় টাইম আর কোথায় স্পেস! এই তিনকে আবার সুত্রের মাধ্যমে বেধে ফেলা। যাক অত চিন্তার কিছু নাই, আপনি আমি বাধা ছাদার আগে আইনষ্টাইন সুত্র দিয়ে এই তিনটাকে এক করে কষে বেধে দেয়।
তিনটে আপাতদৃষ্টিতে আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ন ব্যাপার মনে হলেও আসলে যে তারা আলাদা না, বরং এদের বাড়া কমার ব্যাপার একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল এটাই থিওরী অভ রিলেটিভিটির মুল প্রতিপাদ্য। স্পেস, টাইম এবং ম্যাটারকে সুত্র দিয়ে বেধে ফেলে আইনষ্টাইন যে শুধু মহাবিশ্বের বিভিন্ন চলাফেরা বুজতে সাহায্য করেন তা নয় বরং পুরা ব্রাক্ষ্মান্ডের ভুত ভবিষ্যত সন্মন্ধ্যেও একটা ধারনা দেন।
অথচ মজার ব্যাপার কি জানেন, এই ধারনাটা আইনষ্টাইনের নিজেরই পছন্দ হয় নি। পদার্থ একে অন্যকে আকর্ষন করে এটা এখন ক্লাশ ফাইভের একটা বাচ্চাও জানে। এই আকর্ষন বলের কারনে মহাবিশ্বের ছোট হয়ে আসার কথা, তার নিজের তত্ত্বের এই সিদ্ধান্ত মানতে চাননি আইনষ্টাইন নিজেই, যেহেতু আইনষ্টাইনের বিশ্বাস ছিল মহাবিশ্ব স্থির তাই নিজের সিদ্ধান্তকে আগ্রাহ্য করে নিজের উদ্ভাবিত সমীকরনকে একটু বদলে দেন। একদিকে থিওরী অভ রিলেটিভিটি বলছে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হবে ওদিকে তার মন বলছে না তার আকার অপরিবর্তিত থাকবে – এই ভয়াবহ দোটানায় পড়ে নিজের সমীকরনে জুড়ে দেন একটা নতুন জিনিস যাকে তিনি বলেন “কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্ট”।
এই “কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্ট” আনার কারনটা কি? এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুজে গেছেন? এই জিনিস তার থিওরীকে সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্যই আনা হল। এই জিনিস আমদানী করে আইনষ্টাইন এক নতুন ধরনের ফোর্স নিয়ে আসেন যা মহাবিশ্বকে তার থিওরী অনুযায়ী সংকুচিত হওয়া থেকে বাধা দিয়ে একে প্রসারিত করে। অনেকটা তার থিওরী যদি মাইনাস হয় তবে এই কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্ট হল প্লাস। দুই ধরনের বলের কারনে মহাবিশ্ব স্থির আছে।
আইনষ্টাইন এই মহাবিশ্বকে অপরিবর্তিত রাখতে চাইলেন তার থিওরী অভ রিলেটিভিতে এই কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্ট এনে! কিন্তু আস্তে ধীরে এটা নিয়ে যখন অন্যান্য বিজ্ঞানীরা কাজ করতে শুরু করলেন তখন থেকে ফিসফাস গুঞ্জন শুরু হল না এই মহাবিশ্ব অপরিবর্তনশীল না, এই মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে, অনেকটা একটা বেলুনকে কন্টিনিউয়াসলি ফুলালে যেভাবে বাড়ে সেভাবে। নিজের উদ্ভাবিত সুত্রে কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্ট আনা যে এক বিরাট ভুল “বিগেষ্ট ব্লান্ডার” তা ওর মনে হয়। ১৯২৩ সালে জার্মান গনিতজ্ঞ হারম্যান ওয়েইলকে এক চিঠিতে আইনষ্টাইন লিখলেন “মহাবিশ্ব যদি আপাত স্থির নাই থাকে তবে দূর হয়ে যাক কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্ট।” ১৯২৯ সালে হাবল টেলিস্কোপ নিশ্চিত প্রমান দেয় মাহবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে।
আইনষ্টাইনের নিজের ইচ্ছায় বাদ দেয়া কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্ট আবারো ফিরে আসল। বিজ্ঞানীরা ধারনা করলেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারনে আইনষ্টাইনের কল্পিত ওই কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্টই দায়ী। তাদের দাবী এরকম একটা বলের জন্যই গ্রাভিটি তার নিজের চেষ্টায় মহাবিশ্বের সংকোচন ঘটাতে পারছে না। বরং গ্রাভিটির আকর্ষন উপেক্ষা করে বেড়ে চলছে মহাবিশ্ব। এজন্য বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এই কসমোলজিক্যাল কনষ্ট্যান্টকে “এ্যান্টি গ্রাভিটি” নাম দিয়েছেন। এ এক অদ্ভুত জিনিস। (কয়েক দিন আগে এ্যান্টিগ্রাভিটি নিয়ে একটা পোষ্ট দিয়েছিলাম চাইলে এক পাক দেখে আসতে পারেন এ্যান্টিগ্রাভিটি যা এখনো গবেষনার পর্যায়ে )
এই এ্যান্টি গ্রাভিটি এক অদ্ভুত জিনিস মহাশুন্যের এক বিশুদ্ধ শুন্য স্থান, যার মাঝে এক কনাও পদার্থ নেই অথচ তারও একটা নিজস্ব বিকর্ষন বল আছে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে আশেপাশের স্পেস কে। এক ভুতুড়ে কান্ড। ধাক্কা মানে তো এনার্জি আবার ম্যাটার ছাড়া এ্যানার্জি!! না তা সম্ভব না। এনিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে এখনো কোন সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায় নি, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ডাঃ মাইকেল টার্নার বলেন, “বিষয়টা তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের সব থেকে বড় প্রহেলিকা।”
ভ্যাকুয়ামেরও যে এনার্জি থাকতে পারে এরকম একটা ইঙ্গিত ১৯৩০ এর দশকে প্রথম পাওয়া যায় কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষনায়, তারা কিন্তু আবার মহাকাশ নিয়ে গবেষনা করছিলেন না, তারা গবেষনা করছিলেন পার্টিকেল ফিজিক্স বা কনাপদার্থবিদ্যা নিয়ে। পল এ্যাড্রিয়েন, মরিস ডিরাক, রিচার্ড ফাইনম্যান, জুলিয়ান সুইংগার, মিনিচিরো টোমোনগোর মত বিজ্ঞানীরা কাজ করছিলেন আইনষ্টাইনের রিলেটিভিটির সাথে পদার্থবিদ্যার আর এক শাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর যোগাযোগ নিয়ে, এব্যাপারে গবেষনা করতে গিয়ে তারা দেখলেন শুন্যস্থান মোটেই শুন্য নয়, আমরা যাকে শুন্যস্থান মনে করছি তার মাঝে আপনা থেকে বা শুন্য থেকে আবির্ভুত হতে পারে অতিক্ষুদ্র কনা!
পারে, তবে একটা শর্তে, আবির্ভাবের সাথে সাথে মানে অকল্পনীয় অল্প সময়ের মাঝেই তা আবার ফের মিলিয়ে যাবে। উপস্থিতিটা যদি এমন হয় কখন সৃষ্টি হল কখন মিলিয়ে গেল তা যদি ধরাই না পরে তবে শুন্য স্থানের মাঝেই জন্ম এবং মৃত্যু নিতে পারে তারা। এরকম কনাদের বিজ্ঞানীরা বলেছেন “ভার্চুয়াল পার্টিকেল”। হ্যা এই ভার্চুয়াল পার্টিকেলের অস্তিত্ব নিয়েও গবেষনা হচ্ছে তবে সে আলাপ আজকের মত তুলে রাখি। অন্য দিন সে গল্প বলা যাবে।
শোনা কথা আপাতত করোনা ভাইরাসের মধ্যে একটা বড় আবিস্কার নাকি হয়েছে পুরুষ জাতি দ্ধারা আর সেটা হল ঘর ঝাড়ু দেবার সময় সামনে আগাতে হয় আর ঘর মোছার সময় নাকি পেছনে যেতে হয়। অনেকেই হয়ত হাতে নাতে এর প্রমান দিয়েছেন, আর যারা দেন নি তারা কি একবার চেষ্টা করবেন?
ছবিঃ অন্তর্জাল। সূত্রঃ লেখায় বিভিন্ন স্থানে নীল রংয়ের শব্দে লিংক যুক্ত করা হল। এর বাইরেও বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকি থেকে সংগৃহিত
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২০ রাত ১২:২৬