::::হিমালয়ান ডায়েরী৩, স্তোক কাংড়ির পথে::::
স্তোক কাংড়ি।
স্তোক কাংড়ি, হিমালয়ের লাদাখ রেঞ্জের একটা শ্বেত শুভ্র চুড়া। দৈত্যাকার পর্বত চুড়াটার উচ্চতা বিশ হাজার একশ সাইত্রিশ ফুট বা ৬১৩৫ মিটার। প্রচন্ড ঠান্ডা আর পাতলা বাতাসে অক্সিজেন স্বল্পতাই চুড়াটাতে পা রাখতে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু স্তোক উপত্যকার আশ্চর্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ওয়াইল্ড লাইফ আর তিব্বতী সংস্কৃতি ভুলিয়ে দেয় সব। আগের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করেন।
লাদাখিরা সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেক দেরীতে। আবার সন্ধ্যা হতে না হতেই রাস্তা ঘাট সব খালি। পথে ঘাটে দেখা যায় শুধু ইয়ুরোপিয়ান আর ভারতীয় ট্যুরিস্টের দল। ঢাকায় এমনিতে দশটার আগে ঘুম ভাঙ্গে না। কিন্তু হিমালয়ের পরিবেশে যেন যাদু আছে। ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিচ্ছু করার থাকে না, তাই একা একাই হিম ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে নিচের ভ্যালিতে বসে কারাকোরামের শুভ্র গায়ে সুর্যদয়ের বর্ণচ্ছটা দেখি।হাড়কাঁপানো শীতে পাগল ছাড়া মর্ণিং ওয়াকে কেউ বেরোয় না। হোটেলের একটা বয় সেও সকালে উঠে। তাই সবার আগেই পাউরুটিতে পুরু করে লাগানো ইয়াকের মাখনের টোস্ট খেয়ে দিন শুরু করতে পারি। ছেলেটা দেরাদুনের বাসিন্দা, নাম ভিভেক। আমাকে বার বার শুধরে দেয়,বিবেক নয় বলো ভিভেক।
একটু বেলা হলে রাস্তায় স্কুলগামী বাচ্চাদের ভীর। তিব্বতী কনকনে হাওয়ায় মঙ্গোলয়েড গাল গুলো যেন রুজ মাখানো লাল। হাটতে হাটতে চষে বেড়ালাম ফোর্ট রোড, ওল্ড লেহ স্ট্রিট, জার্মান বেকারী, জামে মসজিদ এলাকার সবগুলো ট্রাভেল এজেন্সি। অফ সীজন তাই কেউই নিয়মিত দল পাঠাচ্ছে না স্তোকে। আমি একা শুনে যেই রকম বাজেট দিল সেটা আমার আয়ত্বের অনেক অনেক বাইরে। দুটো এজেন্সিকে বোঝাতে পারলাম, আমার এত কিছু লাগবে না। শুধু একটা তাবু আর একজন গাইড হলেই চলবে। ঘোড়া কিংবা খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা নিজেই করতে পারবো। ওরা আশা দিল খুঁজে দেখবে। জামে মসজিদের পিছনের রাস্তা দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখি হঠাত এক টিপিক্যাল তিব্বতী বস্তিতে হাজির। তিব্বতী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতো অনেক দেখলাম। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত না হতে পারলে অনেক কিছুই যেন বাকী থেকে যায়। তিব্বতী বাড়ি গুলো সবই প্রায় একই রকম। পাহাড়ের গায়ে ভাজে ভাজে থরে থরে খেলনার মতো বাড়ি। নিরেট পাথরের স্ল্যাব দিয়ে বানানো। একটা রোমশ তিব্বতী পুডল টাইপ কুকুর পিছু নিয়েছিল, একটু তুতু করতেই দেখি আদুরে ভঙ্গিতে কু কু করতে করতে পথ দেখিয়ে চলতে শুরু করলো।উপরে তাকিয়ে দেখলাম এই রাস্তাটাই ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পাহাড়ের উপরে লেহ প্রাসাদের দিকে।
একটা তিব্বতী গুম্ফা থেকে লেহ উপত্যকা।
লাদাখের ঐতিহাসিক লেহ দূর্গ।
শহরের ঠিক মধ্যিখানে লেহ প্রাসাদ।একটা পাহাড়ের চুড়ায়। লাদাখের ইতিহাসে এর ভুমিকা অনেক। সেই সিল্ক রুটের যুগে চিনের সাথে মধ্য এশিয়ার বানিজ্যরুট ছিল। চিনের সিল্ক যেত এই পথে পাকিস্তান হয়ে খাইবার পাড়ি দিয়ে আফগান হয়ে ইরান, তুর্কি, কাশগড়, আজারবাইজান এমনকি রুশদেশে। ভারত বর্ষে আসার জনপ্রিয় রাস্তা ছিল খাইবার পাস। কিন্তু ফ্রন্টিয়ারের পাঠান উপজাতিদের (আফ্রিদি, খুগিয়ানি, শিনওয়ারি)দস্যুতা পেশায় আন্তরিক আগ্রহ থাকায় অনেকেই দুর্গম মধ্যএশিয়ার তিব্বত হয়ে ঢুকতো ভারতে। পর্যটক ফাহিয়েন খাইবার উপত্যকা বাদ দিয়ে আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসার সময় পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে খামোখাই তিব্বত দিয়ে ভারতে ঢুকেননি (সুত্র-সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে)। মঙ্গোল ডাকাতদের থেকে সওদাগরদের নিরাপত্তা দেয়া আর সিল্করুটের বণিকদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের জন্যে তিব্বত রাজ লেহ’তে সামরিক দুর্গ তৈরি করেন। তিব্বত রাজার বংশধররাই উত্তরাধিকার সুত্রে লেহ দুর্গের প্রাসাদের থাকতেন।প্রতিবেশী কাশ্মীর, কিংবা শিখ রাজারা নিয়মিত হামলা করলেও প্রাকৃতিক দুর্ভেদ্যতার জন্যে লাদাখ দখল করতে পারেনি। পরে মোঙ্গল ডাকাতরাও সাইজ হয়ে থাকে। কিন্তু দিল্লী সহ সারা ভারত বর্ষেই মোগলরা জেঁকে বসলে লাদাখেও চোখ পড়ে। কিন্তু ব্যাপক পরিশ্রমের কাজ বরফ মোড়া প্রানশুন্য এই উষর মরুভুমি দখলে নেয়া, আর দখল করে লুঠতরাজের জন্যে কিছু ভেরার লোম আর শুকন পাথরের খন্ড ছাড়া কিছুই থাকেনা। লাদাখ রাজ মোগলদের সাথে সন্ধি করে অনিয়মিত ভাবে ট্যাক্স দিতে রাজি হয়। লাদাখে বিশাল অংশ মুসলমান হয়ে যায়। এরপরে ইংরেজরা শিমলা’তে শীতকালীন রাজধানী করে। এসময়ই কাশ্মীর রাজ লাদাখ আক্রমন করে লেহ দুর্গ দখল করে, লাদাখ তিব্বতের থেকে আলাদা হয়ে কাশ্মীরের অংশ হয়ে যায়। তিব্বতী রাজা লেহ দুর্গ ছেড়ে দূরে আরো উপরে দুর্গম স্তোক উপত্যকায় সুরম্য স্তোক প্যালেসে চলে যান।
ইন্ডাস ভ্যালিতে লাদাখ স্কাউটের রেজিমেন্টাল সেন্টার, বিশ্বের হাইয়েস্ট ট্রেনিং গ্রাউন্ড।
গোধুলীর আলোয় সোনা রঙ ধরা স্তোক কাংড়ির তুষার শৃঙ্গ।
লাদাখের ইতিহাস নিয়ে কচকচানি বাদ দেই। মরুভুমির কড়া রোদ, কিন্তু পাহাড় বেয়ে দুর্গে যেতে খারাপ লাগছিলো না। সমস্যা একটাই এখানে আসবো প্ল্যান ছিল না। এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত নেই। উপরে উঠে দুর্গের গেটে দেখি সাইনবোর্ড-নির্মান কাজ চলিতেছে। ঢুকে দেখি দুর্গের অবস্থা করুন। কিন্তু ভেতরে থেকে দারুন সব ভিউ পাওয়া যায়। পুরো লেহ উপত্যকা একনজরে পুরোটাই দেখা যায়। চারদিকে উষর প্রাণহীন খা খা ধুসর প্রান্তরে সিন্ধুর পার ঘেসে ছোট্ট একটা সবুজ উপত্যকায় জীবনের চিহ্ন। সেটাই লেহ শহর। দুর্গের ভেতরেই গতকালের সেই মহিলা মার্গারেটের সাথে দেখা হয়ে গেল। পায়ে বুট, মাথায় বিশাল হ্যাট, থার্মাল ফ্লাস্কে পানি। পুরো হাইকিং এর গিয়ারে হাজির। আমি বাটার স্যান্ডাল আর শুধু মাত্র ক্যামেরা হাতে এসেছি খাবার পানি ছাড়া দেখে অবাক। দুর্গের উপরে কয়েকটা স্তুপা আর মন্দির আছে। রাজার পরিত্যাক্ত নিবাসও নাকি ওখানে। দুজনে মিলে হাটা শুরু করলাম। সে একটু পর পরেই পানি খাবার জন্যে জোরাজুরি শুরু করলো। পথে আরেক কমবয়সী ছেলে জুটে গেল দলে,নাম ভিন্স। ভিন্স পুরোদস্তুর বাউন্ডুলে। বাড়ি সিডনী’তে প্রতিবছর একমাসের জন্যে বেড়িয়ে পরে। গতবছর গেছিলো দক্ষিন আমেরিকায়। আমাজনের জংগল, মাচ্চু-পিচ্চু ভিন্সের অভিজ্ঞতা বিনিময়ে যেন হিংসায় জ্বলে পুরে মরি। ভিন্স এবছরে ভারতে এসেছিল ১মাসের ভিসায়। ভালো লাগায় ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছে। কোন নির্দিষ্ট প্ল্যান নাই পরিকল্পনা নেই। গতসপ্তায় ছিল কেদারনাথে। কেউ একজন লাদাখের কথা বলায় চলে এসেছে। আগামী সপ্তাতে কই থাকবে এখনো ঠিক করেনি। উপরের মন্দির গুলো ঘুরে উলটো পথে নামলাম শহরে। জার্মান বেকারী এলাকায় নেমে তিনজনে মিলে রুফটপ রেস্টুর্যারন্টে লাঞ্চ শেষে হোটেলে ফিরলাম তখন চারটা বাজতে ১৫ মিনিট বাকী। হোটেলের রিসেপশান থেকে চাবি নেবার সময় ভিবেক একটা নোট ধরিয়ে দিল।হাতের লেখা পড়তে ধস্তাধস্তি করতে হয়, যা বুঝলাম পিটারের লেখা। সে আমার মেইল পেয়ে হোটেলে এসে ঘণ্টাখানেক বসে চলে গেছে। তার হোটেলের এড্রেস দিয়ে গেছে।আবার ফিরলাম উলটো দিকে। একটু আগে জামে মসজিদ এলাকা দিয়ে বেড়িয়েছি, ওখানেই তস্যগলির ভেতরে একটা হোটেল। পিটারের রুমে গিয়ে দেখি দুনিয়ার মালপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পিটারের স্বদেশী বন্ধুর নাম ফিন্ট। সেও স্লোভাকিয়ান। সমস্যা তার ইংরেজী জ্ঞান ইয়েস নো ভেরী গুডের বেশী নয়। যা বুঝলাম তাদের এক্লামাইটেজশান প্ল্যান মাঠে মারা গেছে। ফিন্ট এর দিনের আদ্ধেকটা সময়ই কাটছে বাথরুমে। হাই অল্টিচিউড সিকনেসে প্রথম ধাক্কাতেই সমস্যা হয় বাথরুম ঘটিত। পিটারকে নিয়ে নিচের তিব্বতী রেস্তোরাতে বসলাম। আমি জানালাম ঘুম না হওয়া ছাড়া আমার আর কোন সমস্যা হচ্ছেনা। সে অভিজ্ঞ পর্বতারোহী, একটা স্ট্যাপলারের মতো যন্ত্র নিয়ে আমার আঙ্গুলে ঢুকিয়ে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাপ দেখিয়ে দিল। স্বাভাবিকের চেয়ে ১০% কম,অর্থাৎআমিও এক্লামাটাইজড হইনি। মাউন্টেন সিকনেস দুধরনের। একটাতে বোঝা যায়, অর্থাৎ পেট খারাপ, মাথা ব্যাথা এই লক্ষনগুলো দেখা যায়, আর অন্যটাতে কোন সিমটম না দিয়ে হঠাত করেই কলাপস করে। তবে পিটার আর তার সঙ্গীর অবস্থাও সঙ্গীন। ওরা মিনিমাম আরো এক সপ্তাহ লেহ’তে বসে থাকবে। এত দিন কেন? পিটার একতারা কাগজ বের করলো পকেট থেকে আজকেই সারাদিন সাইবার ক্যাফেতে বসে সে হিসাব করেছে। লাদাখ মরুঅঞ্চল, এখানে বৃষ্টি হয়না বললেই চলে। কিন্তু ওয়েদার ফোরকাস্ট বলছে দু তিনদিনের মাঝেই বৃষ্টি নামবে, আর সেটা আরো তিন চারদিন থাকবে। ও গতবছরেও স্তোক কাংড়ি সামিটের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেবারেও বৃষ্টি নেমেছিল। পুরো রাস্তায় কোমড় পর্যন্ত বরফ জমে কেলেংকারী অবস্থা। বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছিল, এবারে সেই সমস্যাতে পড়তে চায়না।
তিব্বতী কুকুর।
মনক্ষুন্ন হয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। আমার এক সপ্তাহ অপেক্ষা করার উপায় নেই। ঢাকায় ফিরে অফিস ধরতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলাম যা থাক কপালে ওদের ছাড়াই রওনা দেব। সন্ধ্যায় আবার ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সাথে কথা বললাম। একজনকে রাজী করালাম আমার শুধু একজন গাইড যোগার করে দাও। আর দরকার হবে আইসবুট, আইসএক্স, ক্রাম্পন (গ্লেসিয়ারে হাঁটার জন্যে বুটের নিচে লাগান একধরনের কাঁটার ফ্রেম)। একটা তাঁবুও লাগবে, আল্পাইন পোষাক আশাক, স্লিপিং ব্যাগ এসব ঢাকা থেকেই এনেছি।এজেন্সির মালিকের নাম রিনচেন ওয়াংচুক গোবা। চেহারা নামের মতো গোবেচারা হলেও বুঝলাম ধুরন্ধুর চালাক।আগে মাউন্টেন গাইড ছিল, এখন ট্রাভেল এজেন্সি খুলে বসেছে। দুনিয়ার দরদাম করে অবশেষে একটা যুক্তিসঙ্গত রেটে রফা হলো।
সকালে ঘুম ভাংলো ফোনের আওয়াজে, ভিভেক জানালো র্যা ফটিং এর টিম এসে হাজির। টাকা এডভান্স করেছিলাম আজকের ইন্ডাস উপত্যকায় হোয়াইট ওয়াটার র্যা ফটিং এর জন্যে। ওরা নির্ধারিত সময়ের আধাঘন্টা আগেই হাজির। এদিকে আমার ঘুম ভেঙ্গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে একঘন্টা পড়ে, কোন মতে রেডি হতে না হতেই দরজায় কড়া নারতে শুরু করলো, খুলে দেখি গাট্টা গোট্টা তিব্বতি ছেলে, সেই নাকি র্যা ফটিং টিমের লিডার। দুই লাফে নিচের মাইক্রোবাসে উঠলাম। বাসে যাত্রি বলতে র্যা ফটিং কোম্পানির ড্রাইভার আর লিডার আর একটা মেয়ে। কোনদেশী দেখে বোঝা গেল না, নাম জিজ্ঞেস করাতে জানালো সাবরিনা, এসেছে ইটালি থেকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, র্যা ফটিং খুব চ্যালেঞ্জিং হবার কথা, আমি আগে কখনো করিনি শুধু টিভিতেই দেখেছি, তুমি করছো?
সে বেকুবের মতো জিজ্ঞেস করলো, ব্যাথা লাগে নাকি?
বাস এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে নিচের ক্যান্টমেন্ট এলাকায় নেমে এল, সিন্ধু উপত্যকা ঘিরে উষর মরুভুমির বুকে রাস্তা। একটু পর পর সেনা চৌকি। মাইক্রোটা নামলো একদম সিন্ধুর গা ঘেষে। পাথরের ফাঁকে ফাঁকে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে ছোট্ট পাহাড়ি নদী-সিন্ধু। সাইজে পদ্মা মেঘনা না, সাঙ্গু-রেমাক্রি (শুকনা মৌসুমের) সাথে পাল্লা দিতে পারে, কিন্তু উচ্ছলতা? আস্ত ডাকাতিয়া নদীকে যদি সাঙ্গু আকৃতির ফানেল দিয়ে বের করতে চাইলে যা হবে তেমন। সাবরিনা আর আমি নদির পাড়ে নামলাম। তার সাথে কথা বলা চরম বেকুবি, নির্বোধের মতো প্রশ্ন করে যে মাথা গরম হয়ে যায়। ড্রাইভার আর লিডার র্যা ফটে বাতাস ভরতে লাগলো। এসময় একটা হোটেলের গাড়িতে করে মাঝবয়সি এক চাইনিজ দম্পত্তি এসে হাজির। দুজনেই হাফপ্যান্ট বুশশার্ট আর হ্যাট পড়া, প্রচন্ড গোপ্পি। কথা বলার মানুষ পেয়ে যেন হাফ ছাড়লাম।
র্যা ফট লিডার সবার মাথায় হেলমেট আর হাতে প্যাডেল ধরিয়ে দিয়ে র্যা ফট পানিতে নামালো। আমাদের বলে দিল ভয়ের কিছু নেই, কিন্তু খুব দুঃখের ব্যাপার পানি খুব বেশী উথাল পাথাল তোমরা সহজে ছবি তোলার চান্স পাবানা। র্যা ফটের সাথে সেফটি বেল্ট দিয়ে তোমাদের বাইন্ধা রাখবো, তাই ভয়ের কিছু নেই, যদি তারপরেও ছিটকে পড়, আমরা দড়ি দেব, জাস্ট সেইটা ধরে ঝুইলা থাকবা,কিভাবে র্যা ফট থেকে পড়ে গেলে টেনে উঠাতে হয় সেটা কয়েকবার দেখিয়ে দিয়ে শুরু হলো রোমাঞ্চকর যাত্রা।
রয়াল এনফিল্ডের গর্জন তুলে মরুর বুকে উড়ে চলার নামই রোমাঞ্চ!
মোটর সাইকেলপ্রেমীদের জন্যে স্বপ্নের রুট।
সিন্ধু উপত্যকায় প্রচন্ড রোদ চামড়ায় কামড় ধরায়, অথচ নদীর বরফ গলা পানি হিম শিতল, বেশিক্ষন আঙ্গুল ডুবিয়ে রাখা যায়না, ঢেউ এসে বার বার শরীর ভিজিয়ে দেয়। প্রবল স্রোতের টানে র্যা ফট ভেসে যেতে লাগলো, তারপরে ধপ! লিটারেলি ধপ করে নদীর একটা স্লোপ থেকে আরেক স্লোপে। এখানে পানির রঙ সাদা। উত্তাল ঢেউ, জায়গায় জায়গায় পাথরের ফাঁকে ঘুর্ণি। র্যা ফট যেন পাগল হয়ে গেল।র্যা ফট লিডার খুব ভালো নিয়ন্ত্রনের মাঝে এর ফাঁক দিয়ে নৌকা টানতে লাগলো। আমাদের মাঝে মাঝে নির্দেশ দেয়। সামনে আমি আর ইটালিয়ান মেয়েটা (ওকে সামনে টানতে বললে পিছনে টানে, পুরো নৌকা চককর খেতে থাকে), আর পিছে সেই চাইনিজ দম্পত্তি। একটু পর পর হিমশিতল পানি মাথার উপর দিয়ে চলে যায়, নাক দিয়ে বরফ গলা পানি ঢুকে খাবি খাই, সবাই উত্তেজনায় গলা ফাটিয়ে চিতকার দেই, আর পিছের সেই চাইনিজ মহিলা গলা ফাটিয়ে হাহাহা করে হাসে- কি মজা কি মজা!!! রোলার কোষ্টার রাইডের সাথে এর কোন তফাত নেই, শুধু একটাই রোলার কোষ্টার মিনিট খানেকেই শেষ হয় আর এটা চলবে দুপুর পর্যন্ত। চারদিকে মাথা উচিয়ে দাঁড়ানো বিশাল বিশাল ন্যাড়া পাহাড়,প্রাণের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। প্রায় একঘন্টা চলার পরে একটা খাড়া দেয়ালের মতো পাহাড় পেলাম। একদল রক ক্লাইম্বার হার্নেসে ঝুলে ঝুলে ক্লাইম্বিং করছে। আরো পরে একটা উষর প্রান্তরে কয়েকটা তাঁবুও পেলাম, কজন ক্যাম্পিং এ এসেছে। ধারে কাছে মাইলের পর মাইলে কয়েকটা কাঁটাঝোপ ছাড়া গাছ গাছালিও নেই, এখানে কি করে? মাথার উপরে মরুভুমির সূর্য ঠাঠা রোদ ছড়াচ্ছে, কিন্তু এর মাঝেই কাঁপতে কাঁপতে প্যাডাল মারছি। প্রবল ঠান্ডা পানি একটু পর পরেই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে শরীরকে ভিজে একসা করে দিয়ে।
ন’টার দিকে শুরু করেছিলাম। একটার দিকে চাডার রিভারে এসে হাজির। সিন্ধুর স্বচ্ছ ঘোলা পানি চাডারের ধুসর পানির সাথে মিশেছে। জায়গাটাকে বলে সাঙ্গাম। দূরে গাছপালা ঢাকা একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। লাল লাল বিশাল পাহাড়গুলোর ছায়া পড়েছে চাডারের কাজল কালো পানিতে। লিডার ছেলেটা বললো, কেউ বাজি লাগবা আমার সাথে? এখান থেকে চাডারের পানিতে সাঁতরে পারে যাবে। মাথার উপর কড়া গনগনে রোদে হিমশিতল পানিতে সাতার? কি মনে করে হাত ডুবালাম পানিতে… প্রবল ঠান্ডায় আঙ্গুলের প্রতিটা গাঁট যেন কুকড়ে গেল।
র্যা ফটিং শেষ হলে সবাই মিলে গেলাম লাঞ্চে, নিম্বু গ্রামে। বড় বড় গাছে শোভিত ছোট্ট তিব্বতি গ্রাম নিম্বু। একটা বাড়ির পাথুরে দেয়ালের ভেতরে বিশাল উঠানের ভেতরে লাঞ্চ টেবিল। আমরা কাপড় চোপড় চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। চাইনিজ দম্পত্তিটার সাথে আলাপ করে অনেক মজা পেলাম। ওরা হংকং এর লোক। প্রচন্ড ঘুরতে ভালোবাসে। তিব্বত, লাসা, মঙ্গোলিয়া অনেক ঘুরেছে। ওরা জানাল তিব্বতের এক গুম্ফায় নাকি একটা ভেষজ ওষুধ পাওয়া যায়, যেটা খেলে অল্টিচিউড সিকনেস কিচ্ছু করতে পারেনা। ওরা এভারেস্ট বেজ ক্যাম্পেও গিয়েছিল (তিব্বতের সাইডেরটা)। ওখানে সবাই যখন অল্টিচিউড সিকনেসে কাইত ওরা তখন মজা করে ছবি তুলছিলো সেই ওষূধের কল্যানে। গল্প ঘুরতে ঘুরতে চলে গেল জেমস হিলটনের তিব্বত নিয়া অসামান্য সায়েন্স ফিকশান লস্ট হরাইজনে। শুনলাম তিব্বতে সত্যি সত্যি নাকি শাংড়ি লা নামের একটা উপত্যকা আছে। আগে অন্য নাম ছিল, ট্যুরিস্ট আকর্ষনের জন্যে এখন এই নাম নিয়েছে।
লেহ দূর্গের উঠান থেকে, পাখির চোখে লেহ নগর। পিছের নিচের অংশটা সিন্ধু উপত্যকা, এর পিছে ছোট পাহাড়গুলর পিছে আইসক্যাপ বসানো পর্বতচুড়াগুলোতে রয়েছে স্তোক কাংড়ি, গোলেপ কাংড়ি এবং দুর্ধর্ষ সাসের কাংড়ি।
মোটর সাইকেল রাইড।
দুটোর মধ্যে ফিরে এলাম হোটেলে। শুধু কাপড়টা চেঞ্জ করেই চলে গেলাম রিনচেন গোবা;র দোকানে। ওকে সাথে করে নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ার্স ফেডারেশনের অফিসে। ৫০ ডলার দিয়ে পারমিট নিলাম স্তোক ক্লাইম্বিং এর। আরো প্রায় শখানেক রুপি দিতে হলো বিভিন্ন প্রকৃতি রক্ষক ফাউন্ডেশানের চার্জ। ফেরার সময় ভিন্সের সাথে বেরুলাম মার্কেটে। লোভ সামলাতে না পেরে একটা রয়াল এনফিল্ড বুলেট বাইক ভাড়া করে ফেললাম। রাস্তায় গর্জন তুলে বেড়ানো দাপুটে বাইকগুলোর হার্লেডেভিডসন মার্কা রাজকীয় চেহারা, ইঞ্জিনের কানফাটানো হুঙ্কার দেখে আসলেই লোভ সামলানো দায়। রয়াল এনফিল্ড বুলেট বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন (এখন পর্যন্ত মার্কেটে থাকা) বাইকগুলোর একটা। সেই ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানীর আমল থেকেই ওরা এনফিল্ড বন্দুক, পিস্তল আর কামান বানাতো। গত শতাব্দিতে শুরু করে মোটর সাইকেল বানানো। কিন্তু পরে দেউলিয়া হয়ে কোম্পানীটাই হারিয়ে যায়, কিন্তু ভারতের চেন্নাইতে ওদের শাখাটা ঠিকই এখন বানিয়ে চলছে ক্লাসিক বাইকটা। অজ্ঞাত কারনে দেখলাম ভারতীয়রা এটা বাদ দিয়ে পালসারের পিছনে ছুটছে, ক্লাচ চেপে ধরে ইঞ্জিনে কয়েকটা গর্জন করাতেই শরীরের প্রতিটা রোমকুপ যেন রোমাঞ্চ অনুভব করলো।
শহরের বাইরে মরুপ্রান্তরে নেমে আসলাম। কই যাচ্ছি কিছুই জানিনা। একটু পড়েই অনেকগুল বাইকার গ্যাং পেলাম। হলিউডি সিনেমার হেল এঞ্জেল’রা যেন বাস্তবে… সবাই মাথায় চামড়ার হেলমেট, লেদার জ্যাকেট মুখে স্কাল আগা স্কার্ফ ঝুলিয়েছি, আর পিছে মিনিস্কার্ট পড়া হারজিরজিরে গার্লফেন্ড। আমি আর ভিন্স একলা। অজ্ঞতা ওদের সঙ্গ না নিয়ে নেমে পড়লাম মরুর বুকে, স্পিড নেই কিন্তু বাইকের ক্লাচ চাপতেই যে রকম একটা হুঙ্কার দেয় শক্তিশালী ইঞ্জিন নিজেকে হী-ম্যান মনে হয়।
রাতে একটা জামে মসজিদের নিচে একটা দোকানে বসে কাশ্মীরি কাবাব আর রুটি খেতে খেতে দেখি গায়ে টুক করে ক-ফোঁটা বৃষ্টি পড়লো। বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। কাল থেকে থাকবো পর্বতের গভীরে। ঐ উচ্চতায় ওরকম বৈরি পরিস্থিতি বৃষ্টি হলেই গেছি…
(আগামী পর্বে শেষ, আপাতত টুবি কন্টিনিউ)।
মাইলের পর মাইল শুধু জনশুন্য মরুপ্রান্তর।
লাল পাহাড়ির দেশে...
লেহ দূর্গ।
টিপিক্যাল তিব্বতী গ্রামের উপরে লাদাখ দূর্গ।
লেহ উপত্যকা।
লেহ দূর্গ।
চাডার উপত্যকা, একসময় ইয়েতি ল্যান্ড নামে ক্ষ্যাত ছিল, এখন বলে হোম অফ স্নো লেপার্ড।
সিন্দু (ইন্ডাস/ইন্দুজ) নদী।
মরুর বুকে স্বর্গদ্যান নিম্বু গ্রাম (সবুজ গাছ)
টাইম ফর হোয়াইট ওয়াটার র্র্যা ফটিং।
নিম্বু গ্রামের এই জায়গাটার নাম সাংগাম। সাদা পানির চাডার নদী আর বাঁ দিকের সিন্ধুর সংগমস্থল
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন