এটি একটি ১৮+ পোস্ট। পোস্টের বিষয়বস্তু এবং ব্যাবহৃত ছবি বা ভিডিও ক্লিপস গুলো ভায়োলেন্সে এবং ক্ষেত্র বিশেষে কঠোর। সবার জন্যে উপযুক্ত নাও হতে পারে। তাই নিজ দায়িত্বে দেখেন।

চড়কে ঝুলন্ত একজন।
পহেলা বৈশাখের দিন মঙ্গল যাত্রার মধ্যে হঠাত ইশতিয়াককে পেয়ে গেলাম। ঢোলের তালে তালে নেচে কুদে একাকার। আমাকে বললো, সৌম্য ভাই চড়ক পুজা দেখতে যাবেন আমাদের এলাকায়?
কিছু না ভেবেই বললাম, ১০০ বার যাব। ছোট বেলায় দুবার চড়ক পুজা দেখেছিলাম। একবার জলপাইগুড়িতে আরেকবার নীলফামারীতে। ছোটবেলায় নার্ভ শক্ত ছিল। কিছু টের পাইনি। এখন কেমন লাগে দেখতে কে জানে।
দোশরা বৈশাখের দিন চড়ক পুজার শেষ পর্ব হয়। প্রথম পর্ব চৈত্র সংক্রান্তির রাতে। আর ২রা বৈশাখ সন্ধ্যায় শেষ হয়। ঘুম ভাংলো দুপুর একটায়। ভাত খেয়ে বাড়ি থেকে কোন রকমে দৌড়ে বের হলাম। বাস খালীই ছিল। খুব দ্রুতই ঢাকা শহরের সীমানা পেড়িয়ে এলাম।
ইশতিয়াকদের বাসায় গিয়ে দেখি মনা ভাই হাজির। আন্টি খুব রিকোয়েস্ট করলেন খাওয়া দাওয়া করার জন্যে। হাতে সময় নাই। আমরা তাড়াতাড়ি এলাম চড়কের ওখানে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ইশতিয়াক নিয়ে এল নিতাইয়ের বাড়িতে। এখানেই পিঠে বর্শি গাঁথা হবে। নিতাইয়ের উঠানে দাঁড়ানোরও যায়গা নেই। এর মাঝে ৫/৬জন ক্যামেরা ম্যান হাজির। ইয়া বড় বড় লেন্স লাগানো ক্যামেরা আর হ্যান্ডি ক্যাম নিয়ে। মহিলা ফটোগ্রাফারই ২ জন। আমরা ৩জনও ধাক্কা ধাক্কি করে ঢুকে গেলাম। উঠোনে এক চালা ঘরের নিচে দেব-দেবীর মুর্তি। লাল ফেট্টি আর লাল একখন্ড কোমড়ে বাধা কিছু অল্প বয়ষ্ক ছেলে। কয়েকজন পুরোহিত, জটাধারী তান্ত্রিক। কয়েকজনের হাতে ত্রিশুল। তিন সুচালো মাথায় কাঁচা আম গাঁথা। কয়েকজনের হাতে মোশের শিংএর শিঙ্গা। মহিলারা শাঁখ বাজাচ্ছে। কান ফাটানো ঢোলের দ্রিম দ্রিম তাল। এর মাঝে মাঝে শাখের গম্ভীর ডাকের পাশে পাশে শিঙ্গার রহস্যময় আওয়াজ, নাকড়া।

পুরোহিতের সামনে স্বেচ্ছা সেবী শুয়েছে।

পুরোহিত মন্ত্র পড়ছে।
মাঝখানে একটা ভয়ালদর্শন পশু বলীদেবার খড়গ উপুর করে মাটিতে গাথা। সেটা বরাবর মাটিতে লাল কাপড়ের বিছানা। একটা কমবয়সী তরুন, কোমড়ে লাল একখন্ড কাপড় জড়ানো, পায়ে ঘুঙ্গুর বেধে শুয়ে পড়লো। চারপাশে ধুপ ধুনোর গন্ধে জায়গাটা দিন মানেই ভৌতিক হয়ে উঠে। মনা ভাই আমার হাত চেপে ধরে বলে, সৌম্য, আমি পইড়া গেলে একটু ধইরো। মহিলাদের উলু ধ্বনির সাথে পাল্লা দিয়ে শাখ আর শিঙ্গার আওয়াজ জোড়ালো হয়ে উঠে। ঢোলের তাল দ্রুত হয়। দুজন পুরোহিত ছেলেটার পিঠে মন্ত্র পড়তে পড়তে হাত বুলায়। বসার আগে পিঠে সালাম করে নেয়। এর পরে একজন পুরোহিত সিঁদুর ম্যাচের কাঠির আগায় লাগিয়ে নির্দিরষ্ট দুরত্বে ২টা করে চারটা দাগ দেয়। এরপরে আরেকজন পুরোহিত মন্ত্র পড়তে পড়তে লম্বা হুকের মতো বর্শি (কসাইয়ের দোকানে যেগুলো মাংসপিন্ড ঝুলিয়ে রাখতে ব্যাবহার করে) ঢুকিয়ে দেয় মাংস ফুরে। দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি ভীর ঠেলে বাইরে এসে খোলা বাতাসে বসি।

আত্মীয় স্বজনেরা।

পিঠে হুক গাঁথার আগে মন্ত্র জপ করছে।

সিঁদুর দিয়ে মার্কিং করা হচ্ছে কোথায় ছিদ্র করবে।
দুজন বাচ্চার সাথে কথা হচ্ছিলো। ফার্স্ট ফেস অর্থাৎ হাজড়ার রাতের কথা বলছিলো। ইশতিয়াকও জয়েন করলো। সে স্থানীয়। জানলাম হাজড়ার রাতে নাকি কালী এবং শিব বের হয়। মুখে কালী কিংবা শিবের মুখোশ, বাঘের ছাল, গলার নরমুন্ডের মালা, মুখে করোটি কামড়ে ধরে আর হাতে উদ্যত খরগ। এই খরগ দিয়ে নাকি নিজেরাই নিজেদের পিঠে কুপিয়ে ফালা ফালা করে।

একটা হুক ঢুকানো হলো, ইচ্ছে করেই এরচেয়ে বেশী জুম করলাম না।

২য় হুকটা গেঁথে দেয়া হলো।
কিছুক্ষন সুস্থির হয়ে গেলাম আবার। প্রথম ছেলেটার গায়ে হুক গাঁথার পরে দ্বীতিয় আরেকজনের গায়েও গাঁথা হয়েছে। তৃতীয় জন ধুতী পড়া। ধুতীর কালার শীবের পরনের বাঘের ছালের মতো। সবাই হুক গাঁথার সময় ঢোলের তালে তালে ঘুঙ্গুর পড়া পা ঠুকছে। তৃতীয় জনেরও পিঠে হুক গাঁথা হলো একই ভাবে। এরপরে আরো কিছু মন্ত্রপাঠ পুজা অর্চণার পরে ঢোলের কাড়া নাকড়ার সাথে শোভা যাত্রা আসলো চড়কের পাঠে। চড়ক হচ্ছে মেরী গো রাউন্ড টাইপের একটা কাঠের লম্বা খুটি। দুপাশে দুটো দন্ড ফ্যানের মতো ঘুরে। চড়কের মাঝে সিঁদুর মাখিয়ে মহিলা এবং পুরোহিতেরা বিভিন্ন পুজা করলেন। ঘটি ভড়ে দুধ ঢালা হলো।

পিঠের হুক থেকে রশি বেড়িয়ে এসেছে। স্বেচ্ছাসেবী পার্ফর্মারেরা ঢোলের তালে পিঠে হুক গেঁথে নাচছে।

পিঠে হুক গাড়া তিনজন নাকী সারাদিন উপবাস। ওদেরকে অপ্রকৃতস্থ লাগলো। ঢোলের তালে তালে নেচে নেচে চড়কের দুপাশে ঘুরছে। এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে কালী দেবী বের হলো। কালী সাঁওতালদের দেবী। শুধু মাত্র বাঙ্গালী হিন্দুরাই কালীকে গ্রহন করেছে দেবী হিসাবে। হিন্দু অন্যান্যরা সম্ভবত কালীকে দেবী মানে না। কালী মুর্তী দেখতেই ভয়ঙ্কর। কৃষ্ণবর্ন নগ্ন এক সাওতাল তরুনী, রক্তাক্ত জীব বের করা হাতে রক্তাক্ত খঞ্জর। গলায় নরমুন্ডের মালা। এখানে এক লোক কালো কাপড় পেচিয়ে আর মুখে মুখোশ পড়ে কালী সেজেছে। সম্ভবত এই খঞ্জরেই পাঠা বলি হয়েছে, রক্তাক্ত। কালী দেবী ঢোলের তালে তালে খঞ্জর উঠিয়ে ভয়ঙ্কর নাচ। ক্যামেরা হাতে ভিডিও ক্লিপস নিচ্ছিলাম। হঠাত সামনে লাল জীব বের করা হাতে রক্তাক্ত খঞ্জর নিয়ে ছুটে আসা কালীকে দেখে আরেকটু হলেই হাত থেকে ক্যামেরা পড়ে যেত ধরলো।
কালীর নাচ শেষ হবার পড়ে কয়েকজন ধরা ধরি করে পালাক্রমে হুক গাঁথা তিনতরুনকে চড়কে উঠিয়ে দিল। পিঠের বর্শির সাথে দড়ি বেধে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপরে ফ্যানের মতো করে ঘুড়ানো। কখনো এমনি কখনো ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে (নীলফামারীতে যেটা দেখেছিলাম সেখানে সাথে সাইকেল নিয়েও ঝুলছিলো)। ঘুরার সময় দর্শকদের দিকে প্রসাদ ছুড়ে দেয়। সন্ধ্যার সময় ওদেরকে চড়ক থেকে নামানো হলো। পিঠে বর্শি বাধানো অবস্থায় নাচতে নাচতে ওরা চলে গেল বাজারের মধ্যে দিয়ে। দোকানের লোকেরা সবাই চাঁদা দিচ্ছিলো।
সবার সাথে আমরাও ঢাকার পথ ধরলাম।

চড়কে ঝুলে পড়ার আগে চড়ক জড়িয়ে ধরে সম্মান প্রদর্শন।

চড়ক।


খঞ্জর হাতে কালী দেবী।

চড়কে ঝুলন্ত/ঘুরন্ত অবস্থায় ভক্তদের দিকে প্রসাদ ছুড়ে মারছে (হাতের ত্রিশুলে কাঁচা আম)।



কোলে শিশু সহ চড়কে ঘুরছে।

অগুনিত দর্শকের উপরে।
উল্লেখ্য আমি হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কিছুই জানি না। তাই তাদের পুজার রীতি নীতি সম্পর্কে ভুল হতে পারে। কয়েকজন হিন্দু বন্ধু বান্ধবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম চড়ক পুজা সম্পর্কে, তারাও তেমন কিছু বলতে পারলো না। বেশীরভাগই এই পুজার কথাই জানেনা। একজনের কাছে শুনলাম এটা নাকী সাওতাল কিংবা এরকম আদীবাসীদের পুজা (কালী সাওতাল এবং বাংলার প্রাচীনতম গোষ্ঠীগুলোর দেবী। হিন্দু ধর্মে কালী অনুপ্রবেশ করে। হয়তো এভাবেই বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলের নিম্নবর্ণের হিন্দুরা চড়ক পুজা করে। মুল সম্প্রদায়ের সাথে মনে হয় এর যোগসুত্র তেমন নাই।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১০ রাত ৯:৪৯