চিন্ময়
কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে যা প্রায়ই গলায় কাটার মত আটকে যায় কোন একটা সময়ে। নিঃসন্দেহে তা গলার প্রকৃত স্বত্তাধীকারী এবং কাটা দুটোর জন্যই ভয়ংকর হয়ে দাড়ায়। তবে কাটার এই অত্যাচার কখনোই সুখকর হয় না। তার চাইতেও ভয়ংকর ব্যাপার হল বেশীরভাগ মানুষ বুঝতেই পারেনা যে একটা কাটা বিধেছে। আমি ভাগ্যবান কারন আমি নির্বোধ নই। একসময়কার নির্বুদ্ধিতার জন্য এখনো নিজেকে তিরষ্কার করি প্রায়ই। তবে এখন বুঝতে পারছি, এবং বেশ ভালোমতই কাটাটা আমাকে জানান দিচ্ছে সময়ে অসময়ে। সমস্যা হল কাটাটা ফেলেও দেয়া যাচ্ছে না আবার ঢোক গিলতেও পারা যাচ্ছে না। এই অবস্থার বর্ণনার জন্য কোন সুনার্দিষ্ট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। "হস্তাপদাদ্বীশৃঙ্খলাবদ্ধাবস্থা" ব্যাকরণের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখালে হয়তো এই শব্দটা দিয়ে এককথায় প্রকাশ করতে পারতাম।
বিকেলের রোদ এখনো কিছুটা আছে। অদ্ভূত সোনালী রোদ এসে পড়ছে উর্মির একপাশের গালে। উর্মি, আমার স্ত্রী।
বিকালবেলায় সে কখনোই ঘুমায় না তবে আজকের বিকালটা অন্যদিনের মত না। উর্মির চোখ বন্ধ। গালে এসে পড়ছে শেষ বিকেলের আলো। রহস্যময় বিকালের সোনালী আলো খেলা করছে সেখানে। বারান্দার দরজার পাশেই বসে দেখছি আমি। হঠাত করেই বড় ড্রেসিংটেবিলের সামনের আয়নাটায চোখ গেল। নিজেকে দেখে নিজেই আতকে উঠলাম। অনেকদিনের পুরনো গর্বিত এবং বিজয়ী নিজেকে দেখতে পেলাম।
শুধু আমিই না যেকোন পুরুষই এমন একটা স্ত্রী পেয়ে গর্বিত হতে পারে।
উর্মির দেহবর্ণনার জন্য কোন শ্লীল ভাষা এই মুহূর্তে অর্থহীন। সামাজিক অবস্থানভেদে ভাষার প্রয়োগ পরিবর্তনীয়। তাই বর্ণনা উহ্য তবে এতটুকু নিশ্চিত করা যায় উর্মির মত একটা মেয়েকে দেখার পর যদি আপনি প্রেমে না পরেন তাহলে অতি অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
আর সেজন্য একটু গর্বিতবোধ আমার মধ্যে জেগে উঠলে নিজেকে দোষী ভাবতে পারি না।
উঠে গিয়ে উর্মির কপালে হাত দেই। এখনো একটু একটু গরম। আশ্চর্য এখনতো শীতকাল এখনো তাপমাত্রা কমতে এতো দেরী হচ্ছে কেন। ঘড়ির দিকে তাকালাম। এতো সময় পার হয়েছে তাও ঠিক প্ল্যানমত কাজটা হচ্ছে না। এখন বাজে সাড়ে পাচটা।
প্রায় ঘন্টাখানিক আগে উর্মি মারা গিয়েছে। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়লাম ইন্না লিল্লাহে....
কেউ মারা গেলে এই দুআ পড়ার নিয়ম। অবশ্য তার আগে মৃত্যু নিশ্চিত করার ব্যবস্থাটা করেছি নিজেই। কাটাকাটির ঝামেলায় যাই নি। রক্তারক্তি করাটা অমানবিকও বটে। বালিশ দিয়েই কাজটা করেছি।
একটু খাটনি গিয়েছে তবে কাজটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে তাও বা কম কিসে।
রক্তারক্তি ভালো না লাগলেও করতে হবে। আর সেজন্যই চাচ্ছি একটু ঠান্ডা হবার পর কাজটা সারতে। কিছুসময় গেলে ব্লাড আপনাআপনি ক্লট করবে। গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম।
বাথরুমটা বেশ বড়ই এখানে কাজটা সারতে তেমন কোন ঝামেলা পোহাতে হবে না।
প্যাকেট করে বাড্ডার দিকে নিয়ে যাবো। একটা মাগুরের খামার আছে।
নির্বোধ মাছেদের আহারের ব্যবস্থা করতে পারাটাও কম কৃতিত্বের কথা না।
আরেকটু সময় কাটানোর জন্য বারান্দায় গিয়ে দাড়িয়ে থাকি। নিচের লনে বাচ্চাকাচ্চারা খেলাধুলায় মগ্ন। আজকালকার বাচ্চারা অবশ্য বাইরে খেলাধুলার চেয়ে ঘরে বসে কম্পিউটারের সামনে বসে থাকতেই আগ্রহ বোধ করে। কে জানে আজকে হয়তো তাদের বাইরে গিয়ে ছুটাছুটি করতে ইচ্ছা করছে।
হঠাত করেই যেন চমকে উঠি একটু। এমন একটা ঘটনার মাঝখানে কিসব চিন্তা শুরু করেছি।
এখন একমাত্র উর্মির সুষ্ঠু সত্কারের বিষয়েই ভাবা উচিত।
সন্ধ্যা হলেই কাজটা শুরু করব।
এইসময় একটু ফায়ারওয়ার্ক করলে কেমন হয়? তামাকপাতার সাথে টেনশান পুড়ানো। অবশ্য আমি তেমন টেনশান বোধ করছি না। তবুও এখন টেনশানের একটা ভাব নিয়ে আসার জন্য সিগারেট ধরালাম।
ঠিক পাশের বারান্দায় সনি দাড়িয়ে আছে।
কার সাথে যেন কথা বলছে ফোনে।
কথা না বলে ঝগড়াই বলা ভালো। হয়তো কাউকে বুঝাতে চাইছে তোমার জীবনে আমিই প্রথম।
অবশ্য আজকালকালকার মেয়েরা এইসব সস্তা বাক্যের আশপাশ দিয়ে যায় না।
আমি এমনই, থাকলে থাকো নাহয় ফুট।
উর্মি অবশ্য একটু আলাদা ছিল। তার জীবনে আমিই প্রথম এবং একমাত্র।
সিগারেটের আচ লাগলো আঙুলে ঝেড়ে ফেলে দিলাম।
সময়টাকে এখন সন্ধ্যা বলা যায়। রুমে ঢুকে লাইট জালিয়ে দিলাম। এই আলোতে উর্মিকে একটু ফ্যাকাশে দেখা যাচ্ছে। নাহ আর উর্মি বলাটা ঠিক হচ্ছে না। বলা উচিত লাশ। লাশ লাশ একটা ভাব চলে এসেছে।
সত্কারের জন্য প্রস্তুত হওয়া লাশ।
এখনি কাটাকুটির কাজটা শুরু করব। যতটা সম্ভব নিরুদ্বেগ থাকার চেষ্টা করছি। সম্ভব হচ্ছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছে। অসহ্য!
একটু পানি খাই।
ভেতরটা কেমন ফাকা ফাকা লাগছে। গলা থেকে হঠাত কাটা বেরিয়ে গেলে যেমন একটা অনুভূতি হয় সেইরকম।
ঠিক এ পর্যায়ে এসেই ঘুমটা ভেঙ্গে যায়।
স্মৃতির কৌটা খুলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি কিছুক্ষণ।
একটুও ফিকে না হওয়া স্মৃতিগুলো ফিরে আসে চোখের সামনে। অন্তুর ভাইয়ের বিয়েতে পরিচয় উর্মির সাথে।
অল্পদিনেই অনেকটা কাছাকাছি চলে আসা অতঃপর শুভ পরিণতি।
সবকিছু স্বপ্নের মতই দ্রুত ও আনন্দময়।
বাইরে কোথাও যেতে চেয়েছিল হানিমুনে। নেপাল গিয়েছিলাম আমরা।
স্বপ্নময় রঙিন বাস্তবতা!
তবে কঠিন বাস্তবতাও থাকবে একটু আধটু। উর্মি কোনভাবেই মানিয়ে নিতে পারছিল না আমার ফ্যামিলিতে। বাধ্য হয়েই আলাদা ফ্ল্যাট নিয়েছি। আর কোন সমস্যাই রইল না।
কিছুদিন পরেই উর্মি খুব বিষন্ন এবং ভীত মুখে বাবা হওয়ার সংবাদটা দিল। আনন্দের ষোলকলা পূর্ণ হবার কথা থাকলেও উর্মি চাইল এবোরশান করাতে।
সে চাচ্ছে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করতে। তার আগে বাচ্চাকাচ্চার ঝামেলায় যেতে চাচ্ছে না।
নিতান্ত অনিচ্ছা আর হতাশা নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার নিরুত্সাহিত করলেন। কিন্তু উর্মি কোনভাবেই বাচ্চা নিতে তৈরি না। শেষে কিছু টেস্ট দিলেন।
যেদিন ডাক্তার রিপোর্ট দেয়ার কথা সেদিন কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে চিটাংয়ে ছিলাম।
ফোনে উর্মি জানালো একটু দ্রুতই কাজটা সেরে ফেলতে হবে।
এসেই ডাক্তারের কাছে গেলাম আমি একাই।
ডাক্তারের কথা শুনে নিজের কানকেও অবিশ্বাস করতে হলো।
দ্বিতীয়বার এবোরশান করানো কিরকম রিস্কি সেটা আমাকে বুঝালেন।
দ্বিতীয়বার?
আপনাদের বিয়ের আগে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন তো আর কম করেন নি! এইরকম অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্য ছেলেরাই দায়ী এবং পুরুষশাসিত সমাজের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতেও ছাড়লেননা গাইনোকোলোজিস্ট।
আমার কান দিয়ে তখন কিছু ঢুকছিল না।
আমি ভাবছিলাম মিথ্যেবাদী উর্মির কথা।
ডাক্তার তখন ধর্মীয় বিধিনিষেধের উপরেও আলোকপাত করেই যাচ্ছেন। আমি শুধু কোনরকম ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এসেছিলাম।
ছেলেদের কান্নাকাটি করা নিষেধ তাই তারা কখনো কাদে না। তবে তা প্রচ্ছন্ন করে রাখার জন্য অনেক আয়োজন করে। আমিও তেমন কিছুই ভাবছিলাম। রাস্তায় হাটতে হাটতে অচেনা কোন পিচ্চি মেয়ের দিকে চোখ চলে গেল। ঐতো আমারই মেয়ে আমার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করছে।
কখনযে রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েছি বলতেই পারি নি। শেষমূহুর্তে দেখতে পেলাম একটা গাড়ি ঠিক আমার সামনেই আশেপাশের কিছুলোক চিত্কার করছে এইইইইইইই এইইইই।
কেমন যেন মেয়েলী গলায় সুর করে ডাকছে!
চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলাম উর্মি ডাকছে। তার পরনে একটা কালো শাড়ি। কপালের মাঝখানে একটা কালো টিপও আছে। কোথাও যাচ্ছে মনে হলো।
-ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাইসিলা নাকি? কতক্ষণ ধরে ডাকতেসি!
আমি কেবল শূন্য দৃষ্টিতে তাকালাম।
"আরে আজকে অমিত ভাইয়ের জন্মদিন না। ওনার অনারে একটা পার্টি দিচ্ছি। সবাই এসে যাবে এখুনি। তুমি উঠো। আমি আজহারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।"
আজহার ছেলেটা সবসময়ই আমার কাছাকাছি থাকে। এক্সিডেন্টের পর যখন থেকে পাদুটো প্রতারণা করে তখন থেকেই একটা হুইল চেয়ার আর আজহার কাছাকাছি থাকে সবসময়।
এবোরশানটা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছিল। উর্মির প্রথম এবং দ্বিতীয় এবোরশান দুটোই সফল।
এবং সেইসাথে ভবিষ্যতেও কখনো বাচ্চা নিতে পারার কোন সম্ভাবনাও নেই। মাতৃত্ব জিনিসটা বোধহয় সবার জন্য আসে নি।
সময় কাটানোর জন্য দিনরাত কত কিছু যে করে।
আমার ফ্ল্যাটটা এখন উর্মির বন্ধুদের আড্ডা দেয়ার জায়গা। সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু শোভন। প্রায়ই বেশী রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেলে উর্মি আর শোভনকে চলে যেতে দেয় না। শোভন থেকে যায় গেস্টরুমে এবং তাতে আমিও অশোভনীয় কিছু খুজে পাই না। এমনকি গভীর রাতে অতি সন্তর্পণে উর্মি যখন আমার পাশ থেকে উঠে গেস্টরুমে যায় তাতেও কোন দোষ খুজে পাই না।
নিজের স্ত্রীর দোষ খুজে বেড়ানোর মত পরাজিত আমি না। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে যাওয়াও যে অনুচিত সেটা আমি ভালো করেই জানি। তাই চোখ বন্ধ করে থাকি। কিছুটা লজ্জায় আর কিছুটা শংকায়।
আমি গলার কাটাটা অনুভব করি যেটা গিলে ফেলে যায় না আবার চাইলেই উগড়ে ফেলা যায় না।
অবশ্য কাটাটা উপড়ে ফেলার সাহসও আজকাল হারিয়ে ফেলেছি। থাক না কিছু যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি!
প্রাসঙ্গিকঃ কাল্পনিক_ভালোবাসা ভাইয়ের বিবর্ন প্রতিশোধ পড়ে ভাল্লাগসিল তাই নিজেও লিখলাম!
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন